গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন শুধু নয়, দেশের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেই নরেন্দ্র মোদি ১০০ দিনের কর্মসংস্থান প্রকল্প চালু রাখার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পে অর্থবরাদ্দ ছেঁটেই চলেছে। বাজেটে এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ কমে যাওয়ায় রাজ্য সরকারগুলি পড়েছে মহাবিপদে। কারণ মনরেগা কেন্দ্রীয় ফ্ল্যাগশিপ প্রোগ্রাম হলেও রাজ্য সরকারেরও তাতে অংশীদারত্ব রয়েছে। রাজ্য সরকার উপভোক্তাদের প্রাপ্য মিটিয়ে দিলেও, কেন্দ্রীয় সরকার টাকা বাকি রাখায়, রাজ্যগুলি অর্থসংকটে পড়েছে। পিপলস অ্যাকশন ফর এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি নামক একটি সংগঠন হিসাবকষে দেখেছে গত অর্থবর্ষে রাজ্যগুলির মনরেগা খাতে বকেয়া ২১,০০০ কোটি টাকারও বেশি হতে পারে। ২০২১-’২২ সালে ইতিমধ্যেই ১২,৪৯৪ কোটি বকেয়া হয়ে গেছে। তাদের মতে অন্তত ২ লক্ষ ৬৪ হাজার কোটি টাকা বর্তমান অর্থবর্ষে এই প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ হলে, দেশের শ্রমিকরা ১০০ দিনের কাজের মজুরি পাবে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রী এবছরের বাজেটে বরাদ্দ করেছেন মাত্র ৭৩ হাজার কোটি টাকা। গতবছরের বরাদ্দ ছিল একই। ৮ শতাংশ খুচরো মূল্যবৃদ্ধি ধরলে প্রকৃত বরাদ্দ হবে ৬৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি বছরে যেখানে ২৫০ শতাংশ বৃদ্ধি হলে সাড়ে সাত কোটি শ্রমিক ১০০ দিন কাজ পেত, সেখানে প্রকৃত বরাদ্দ কমে গেল। বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০ শতাংশ বাজেটের টাকা পূর্ববর্তী বছরের বকেয়া শোধ করতেই খরচ হয়ে যায়। সেটা হিসেবের মধ্যে ধরলে মাত্র ৫৩ হাজার কোটি টাকা চলতি বছরে কেন্দ্র এই প্রকল্পে খরচ করবে। তাহলে ভূমিহীন কৃষকেরা বছরে ক’দিন কাজ পাবে?
২০০৫ সাল থেকে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় কর্মসংস্থান আইন চালু হলেও ১০০ দিন কাজ কোনও শ্রমিককেই কোনও রাজ্য দিতে পারেনি। বড়জোর গড়ে ৩০ দিন বছরে কোনও পরিবারের একজন কাজ পায়। গোটা দেশে যখন এরকম ছবি, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ একটি ব্যতিক্রমী রাজ্য। রাজ্য সরকার অন্তত ৫০ দিন বছরে একটি পরিবারকে কাজে নিযুক্ত করে মজুরি দিতে পেরেছে। ২০২১-এর মার্চ মাস পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ ৩৬,৪২,৪৮,৫৯৬টি কর্মদিবস বা মানবদিবস তৈরি করে দেশে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। কর্মশক্তির বিচারে অর্থাৎ কতজনকে নিযুক্ত করা গেছে, সেই হিসাবে দেশে প্রথম স্থানে রয়েছে আমাদের এই রাজ্য। ফলত ১০০ দিনের কাজে খরচও হয়েছে অনুপাতিক হারে।
স্টেট এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী ১০০ দিনের কাজে রাজ্যের শ্রমিকেরা দিনে ২২৩ টাকা মজুরি পাচ্ছেন। গত অর্থবর্ষে ১ কোটি ১ লক্ষ লোককে মজুরি দিতে গিয়ে রাজ্যের যা ব্যয় হয়েছে তার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বকেয়া রয়েছে ২,৮৭৬ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় সরকার যে ফান্ড ছাড়ে তাতে বছরের প্রথম ৪-৫ মাসেই ৮০-৮৫% টাকা খরচ হয়ে যায়। বছরের অর্ধেকের বেশি সময় তাই শ্রমিকদের মজুরি পেতে বিলম্ব হয়। অথচ এই সামান্য টাকার দিকেই তাকিয়ে বসে থাকে গরিব পরিবারগুলো। কর্পোরেট ফার্মিংয়ের জন্য এমনিতেই গ্রামে কৃষিকাজ এখন কমে আসছে। কেন্দ্রীয় সরকার রাজকোষ ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে সড়ক বা সেতু তৈরিতেও কাজ আর আগের মতো সুলভ নয়। তার ওপর করোনা-পরবর্তী সময়ে শ্রমিকেরা অন্য রাজ্যে গিয়ে কাজ খুঁজে নিতে পারছেন না। ফলে ১০০ দিনের কাজের চাহিদাও বেড়েছে। কিন্তু নামেই ১০০ দিন, মোদি সরকার সবাইকে ৩০ দিনের কাজেরও মজুরি আটকে রেখেছে। এভাবেই কি সবকা বিকাশ হবে? ২০২২-এর ৩১ মার্চ পর্যন্ত আনস্কিলড বা প্রশিক্ষণহীন কর্মী ২৮৭৬.২৮ কোটি টাকা এবং সেমি স্কিলড বা আংশিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাবদ ২৩৫১.৯৪ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রের কাছে মোট ৫২২৮.২২ কোটি টাকা পাবে। এই বিপুল বকেয়ার ফলে চলতি বছরে এই প্রকল্পে সরকার কাজের লক্ষ্যমাত্রা কী করে অর্জন করবে?
আরও পড়ুন- অভিষেক মাজিকে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্তেজনা তুঙ্গে, অবাধ ভোট হলে মুখ্যমন্ত্রীর হার নিয়ে সন্দেহ নেই
আরবান মনরেগা বহু চর্চিত বিষয়। কেন্দ্রীয় সরকার শহরে দরিদ্র পরিবারের জন্য মনরেগা ধাঁচে কোনও প্রকল্প করতে উদ্যোগী হয়নি। কিন্তু কলকাতা কর্পোরেশন ওয়েস্ট বেঙ্গল আরবান এমপ্লয়মেন্ট স্কিমের মাধ্যমে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে প্রতিটি ওয়ার্ড-পিছু একশো জনকে নিয়োগ করেছে। এরও ব্যয়ভার রাজ্য সরকারই বহন করে। কেন্দ্রীয় প্রকল্পে যেমন বকেয়া থাকে, সেরকম দৃষ্টান্ত কিন্তু এখান নেই।
গরিব মানুষদের কল্যাণই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর প্রাথমিক লক্ষ্য। তাই তিনি এই দাবি আদায়ে পথে নেমেছেন। তৃণমূল কংগ্রেসের সবস্তরের কর্মীদের আহ্বান করেছেন কেন্দ্রের এই শোষণনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে। কারণ গরিব মানুষের জন্য আন্দোলন করতে হলে জোট বাঁধতে হবে। মমতা ব্যানার্জির দেখানো পথে অন্য রাজ্যগুলোরও এগিয়ে আসা উচিত। সংসদে বারংবার সমালোচিত হলেও কেন্দ্রের টনক নড়েনি। এখন রাস্তা একটাই— কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলনের মাধ্যমে বাজেট-বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং রাজ্যের বকেয়া শোধ করার নিশ্চয়তা। এ-ছাড়া গ্রামের অর্থনীতির সংকট কাটবে না।