এফসিআরএ (Foreign Contribution Amendment Act)। ২০২০-তে সংশোধন করা হয়েছে এই আইনে (Foreign Contribution Amendment Act)। এটা করা হল ঠিক তখনই যখন সুশীল সমাজ কোভিড আক্রান্তদের ত্রাণ আর উদ্ধারে, সেবায় আর পরিষেবায় ব্যস্ত, এই সংশোধনী আনতে সংসদে বিতর্ক হয়েছে, এমনটাও নয়। সেই সুযোগ মেলেনি। এই সংশোধনীর ফলে অসরকারি সংস্থাগুলোর অর্থাৎ এনজিও-গুলোর প্রশাসনিক ব্যয় কোনওমতেই একটা সীমার বেশি হতে পারবে না। সমস্ত এনজিওগুলোর যাবতীয় লেনদেন স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার পার্লামেন্ট স্ট্রিট নতুন দিল্লির শাখা ছাড়া অন্য কোনও ব্যাঙ্কে করা যাব না। এর ফলে স্টেট ব্যাঙ্ক আরও বেশি করে এনজিওগুলোর লেনদেনের ওপর নজরদারি চালাতে পারবে।
যে-সমস্ত এনজিও দেশি টাকা নিয়ে কাজ করে তাদেরকেও কিন্তু ছাড় দেওয়া হয়নি। ২০২০-র বাজেট পেশের সময়েই কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন দেশীয় সংস্থায় দামের ক্ষেত্রে করের ছাড়ের বিষয়টা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পুনর্বিবেচনা করা হবে। এর পাশাপাশি সরকারি সাহায্যে কাটছাঁট চলে এসেছে। যেসব দেশীয় সংস্থা অসরকারি সংগঠনগুলোকে সাহায্য করে, সেগুলো হুমকির মুখে পড়ছে। এসব তো আছেই।
আরও পড়ুন: ‘আমি সবসময় বিবেকবানদের পক্ষে, বিত্তবানদের পক্ষে নই’ সাফ জানালেন মমতা
২০২০-র সংশোধনীর পরবর্তী পর্যায় মানে উত্তর-নোটবন্দি পর্ব। এই পর্বে সংখ্যালঘুদের সাহায্যকারী এনজিওগুলো, গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানো এনজিওগুলো টাকাকড়ি নিয়ে ভয়ঙ্কর সমস্যায় পড়েছে। এটা বাস্তব।
অক্সক্যামের লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ করতে দেওয়া হয়নি। এফসিআর-এ অর্থাৎ ফরেন কন্ট্রিবিউশনস (রেগুলেশন) অ্যাক্টে বলছে এই লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ একটা জরুরি বিষয়। অক্সক্যাম কী করেছে যার জন্য এই লাইসেন্স পুনর্নবীকরণে বাধা সৃষ্টি করা হল? পরিযায়ী শ্রমিক আর গরিবদের অতিমারির মরশুমে কী দশা হয়েছিল তা নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল এই এনজিওটি। সারা দুনিয়ার সামনে মোদি-শাহ সরকারের স্বরূপ ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। এই সংস্থা শ্রমিকদের অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করে।
যে-সব এনজিও সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাজ করে তাদের অবস্থা আরও খারাপ। কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভের এফসিআর-এ অনুমোদন কিছু সময়ের জন্য খারিজ করা হয়েছিল। তারপর, এ-বছর এই অসরকারি সংস্থার লাইসেন্স পুরোপুরি বাতিল করা হয়। একইভাবে ইনসাফ (আইএনএসএএফ) এবং পিপলস ওয়াচ-এর মতো অসরকারি সংস্থাগুলির এফসিআরে অনুমোদন বাতিল করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এগুলোও মানবাধিকারের বিষয়ে কাজ করে।
প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট, সংক্ষেপে পিএমএলএ-কে এখন সুশীল সমাজের নেতাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এই আইন মোতাবেক কয়েদ করাও যায়। এই ইডি বা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট পিএমএসএ প্রয়োগ করে তল্লাশি ও গ্রেফতার চালাতে পারে। অ্যামেনিস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং সেন্টার ফর ইক্যুইটি স্টাডিজ সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে ক্রমাগত কাজ করে চলেছে। সেন্টার ফর ইক্যুইটি স্টাডিজ-এর প্রতিষ্ঠাতা হর্ষ মান্দার। বস্ক অ্যাকাডেমির রিচার্ড ভন ওয়েইজ স্যাকার ফেলো। তাঁর বিরুদ্ধে ইডি হাত ধুয়ে নেমে পড়েছে। এমনটাই দেখা গিয়েছে।
ক’দিন আগেকার কথা, ২৫ জুন, ২০২২। গুজরাত দাঙ্গার ইস্যুতে গ্রেফতার হল এমন একজন আইনজীবী যিনি মানবাধিকার জনস্বার্থ বিষয়ক মামলা নেন। তিনি গুজরাত হত্যার (২০০২) বিষয়টাকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে আরও দুজন বরিষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিককে জেলে পোরা হয়েছে। ২৪ জুন, ২০২২-এ সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রকাশের পর পুলিশ এঁদের বিরুদ্ধে যে এফআইআর দায়ের করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে এঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এই তিন জন নিহত সাংসদ এহসান জাফরির স্ত্রীকে সাহায্য করেছিলেন। এহসান জাফরির স্ত্রী গুজরাত মুসলমান সম্প্রদায়য়ের গণহত্যা বিষয়ক একটা গল্প ফেঁদেছিলেন বলে অভিযোগ। সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে দেওয়া একটা সাক্ষাৎকারে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভিযোগ করেন, ওই গণহত্যার আখ্যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-সহ অনেকেরই মানহানির কারণ।
এইভাবে শুধু ইউএপিএ নয়, যুগপৎ এফসিআর-এ এবং পিএমএলএ-কে ব্যবহার করে সুশীল সমাজের কণ্ঠরোধের ব্যবস্থা জারি আছে। সম্প্রতি এই বিষয়টি ২০১০-এর আইন প্রয়োগ করে এখনকার কেন্দ্রীয় সরকার কী কী করে চলেছে তার একটি খতিয়ান সাম্প্রতিককালে একটি সর্বভারতীয় দৈনিকে তুলে ধরেছেন রাহুল মুখোপাধ্যায়। তিনি হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির বিষয়ে পড়ান।
তাঁর দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০১১-’১২ সালে ২০,৬৭৯টি সুশীল সমাজের নাগরিক সংগঠনের লাইসেন্স বাতিল হয়েছে। ২০১১-’১৪-র মধ্যে এরকম সংগঠনের সংখ্যা ছিল চার হাজারেরও কম। ২০১৫-’২২-এর মধ্যে লাইসেন্স বাতিল হওয়া এনজিও-র সংখ্যা ১৬,৬৯২। এফসিআরএ আইনে সংশোধনী আনার আগেই এই লাইসেন্স বাতিলের কাজটি সংঘটিত হয়েছিল।
এক কথায় ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় বহু স্তরকে দমন করার কাজে এফসিআরএ এবং পিএমএলএ-কে কাজে লাগানো হচ্ছে। এটি গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থী। এইভাবে নাগরিক সমাজকে চুপ করিয়ে দিয়ে মোদি-শাহ সরকার দেশটাকে স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রী শাসনব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।