জুমলা থ্রি সরকার ক্রমশ বেসামাল হয়ে পড়ছে। প্রথম থেকেই চাপে পড়ে যাচ্ছে তারা সংসদের ভেতরে বাইরে। ভয় ছড়াচ্ছে ৫৬ ইঞ্চি বুকের শিরদাঁড়ায়।
আরও পড়ুন-মাত্র ২ ঘণ্টায় ৭ লক্ষ কোটি টাকার ধস নামল শেয়ার বাজারে
এর আগের দু’বারের সংসদে মোদিকে এভাবে আক্রমণের মুখে পড়তে হয়নি। এতদিন মূলত সরকার পক্ষ বলেছে, বিরোধী পক্ষ শুনেছে অথবা বিরোধীদের সংসদ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ১৪৬ জন সাংসদকে ‘অগণতান্ত্রিক ভাবে’ বের করে দেওয়া হয়েছিল। মোদি সরকার সংসদীয় গণতন্ত্রের কোনও ধার ধারেনি। নিজেকে তিনি দেবতার থেকেও শক্তিশালী প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। অবিচারের বলি হয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মহুয়া মৈত্র।
এবার কিন্তু অন্য ছবি। জুমলা থ্রি সরকারকে সংসদে প্রথম অধিবেশনেই বড় ধাক্কা দিলেন সেই মহুয়া মৈত্র। তাঁর বক্তৃতার কাছে মোদি-শাহরা গোহারান হেরেছেন। মোদির এমন ‘অপরাজেয়’ ব্যক্তিত্ব, পরমাত্মা সুলভ ভাবভঙ্গি, সব উধাও। উল্টে কপালে ভাঁজ। পালাতে পারলে বাঁচেন, এমন লক্ষণ। মুখে চিন্তা ও বিরক্তির ভাব। তিনি যে এভাবে আক্রমণ পছন্দ করছেন না, সেটা বোঝা যাচ্ছিল। সংসদীয় গণতন্ত্র যে স্বৈরাচারীরা পছন্দ করেন না, সেটা তো ইতিহাস স্বীকৃত। তারই প্রমাণ এবারের সংসদের প্রথম অধিবেশন।
আরও পড়ুন-তালাকপ্রাপ্ত মুসলিম মহিলা ভরণপোষণ দাবি করতে পারেন, বলল সুপ্রিম কোর্ট
মোদি যে এতদিন ধরে নিজেকে হিন্দু সমাজের প্রধান ঠিকাদার হিসাবে তুলে ধরতে চাইছিলেন, সেই বেলুনও ফুটো হয়ে গেছে। দেশের হিন্দু সমাজের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের কণ্ঠস্বরই যেন ধ্বনিত হয়ে সংসদকে শোনাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদি মানেই পুরো হিন্দু সমাজ নয়, বিজেপি মানেই পুরো হিন্দু সমাজ নয়, আরএসএস মানে পুরো হিন্দু সমাজ নয়। প্রকৃত হিন্দুত্ব মোটেই বিজেপির হিন্দুত্ব নয়। বিজেপি আপন স্বার্থে সমগ্র হিন্দু সমাজকে বিপথগামী করতে চাইছে। আমাদের কাছে হিন্দুত্বের দৃষ্টান্ত শঙ্করাচার্য, আমাদের কাছে হিন্দুত্বের দৃষ্টান্ত শ্রীচৈতন্য। আদ্বিজ চণ্ডালকে তিনি নিজের বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, হিন্দুধর্ম কোনও বিভেদ বা হিংসাকে স্বীকার করে না। আমাদের কাছে হিন্দুত্ব মানে শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ। তাই আমরা মনে করি, বিজেপির হিন্দুত্ব এক বিচ্যুত হিন্দুত্ব। সেই হিন্দুত্ব কখনওই ভারতাত্মার শক্তি হতে পারে না। উত্তরাখণ্ডের জ্যোতির্মঠের শঙ্করাচার্য স্বামী অবিমুক্তেশ্বরানন্দও বলেছেন, পুরো হিন্দু সমাজ নয়, বিজেপি হিংসাশ্রিত পার্টি।
মোদিবাহিনীকে এমন চাপের মুখে পড়তে দেখে মাঠে নেমে পড়েছেন নাইডু এবং নীতীশকুমার। লোকসভা ভোটের প্রচারে ৪০০ আসনের ঢাক পেটালেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা মেলেনি বিজেপির। নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডুর সমর্থনে সরকার গড়তে হয়েছে নরেন্দ্র মোদিকে। কিন্তু এবার সমর্থনের বিনিময়ে নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য চাপ বাড়াচ্ছে দুই শরিক নীতীশের জেডিইউ ও চন্দ্রবাবুর টিপিডি। এই পরিস্থিতিতে সরকার বাঁচাতে এখন জোট টিকিয়ে রাখার চিন্তাই কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে গেরুয়া শিবিরের। আর বাজেট এগিয়ে আসতেই ক্রমে যেন বেরিয়ে আসছে জোট রাজনীতির আসল রং। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু আগেই নিজের রাজ্যের জন্য আর্থিক দাবি পেশ করেছিলেন। এবার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশও হাঁটলেন সেই পথেই। নিজের রাজ্যের জন্য চেয়ে বসলেন তিরিশ হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা। কোষাগারে এমনিতেই ভাটার টান। তার উপর শরিকদের এই দাবিদাওয়া কার্যত অগ্নিপরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছে গেরুয়া শিবিরকে। গত মাসেই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের সঙ্গে প্রাক-বাজেট বৈঠকে ওই আর্থিক সহায়তার দাবি করেন নীতীশ। তবে বিহারকে কত টাকা বরাদ্দ করা হবে সে বিষয়ে কেন্দ্র এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। বাজেটকে সামনে রেখে বিহারের জন্য নীতীশ সরকারের দাবি দীর্ঘ। রাজ্যে ন’টি বিমান বন্দর, চারটি নতুন মেট্রো লাইন ও সাতটি মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণের পাশাপাশি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার মতো প্রকল্পের জন্য ওই বিপুল অর্থের দাবি জানানো হয়েছে। রয়েছে কুড়ি হাজার কিলোমিটার রাস্তা মেরামতের পরিকল্পনাও।
নীতীশের আগেই নিজের রাজ্যের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন চন্দ্রবাবু। এক লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ চেয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এই দাবি জানিয়েছেন তিনি। তাঁর এই দাবি নিয়ে এমনিতেই ঘুম উড়েছে মোদির। এই দাবি মেটাতে গেলে কেন্দ্রকে বার্ষিক খাদ্য ভর্তুকির অর্ধেকের বেশি অর্থ এই দুই রাজ্যকে দিতে হবে। কেন্দ্রের খাদ্য ভর্তুকির পরিমাণ বছরে প্রায় দু’লক্ষ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে উভয় রাজ্যের সরকারই নিজেদের দিকে বরাদ্দ টানতে তৎপর। কিন্তু কোনও বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া একটি নির্দিষ্ট রাজ্যকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ কি সম্ভব? তাহলে বাকি রাজ্যগুলির কী হবে? জোট সঙ্গীদের মন রাখতে না পারলে কিন্তু সরকার পতনের আশঙ্কা অমূলক নয়।