ফাঁকির ফাঁকে মোদি-নির্মলার বাজেট

শিশু-পিছু পুষ্টিমানের খরচ বাড়ানো হয়েছে মাত্র পাঁচ পয়সা! অতিরিক্ত পুষ্টির জন্য ব্যয়বিধি শেষ সংশোধিত হয়েছিল ২০১৭ সালে। সাত বছর পর এবার সেই বিধি ফের সংশোধিত হয়েছে। এ-কেমন বাজেট? জানতে চাইলেন দেবলীনা মুখোপাধ্যায়

Must read

একদিন সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। —কথাটা লিখেছিলেন হুমায়ুন আজাদ। বাংলাদেশের লেখক। কথাটার সত্যতা প্রমাণিত নরেন্দ্র মোদি, নির্মলার সীতারমনদের বাজেটে। মা ও শিশুদের জন্য বরাদ্দের ছিরি নজর করলে, এই কথাটা বলা ছাড়া উপায় নেই।
এবারের বাজেটে আপাতদৃষ্টিতে নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রকের বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। আসলে, এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটেও মহিলা বা শিশুদের দুরবস্থা ঘোচানোর কোনও চেষ্টাই করেননি অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। একদিকে যেমন মূল বাজেটে অতি সামান্য অংশ দেওয়া হয়েছে লিঙ্গভিত্তিক বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে, তেমনই যে সামাজিক প্রকল্পগুলি নারী ও শিশু কল্যাণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেখানে বরাদ্দ চোখে না দেখার মতোই। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, সহায়িকা-সহ কোনও প্রকল্প-কর্মীরই ভাতা বৃদ্ধির কথা ঘোষণা নেই এবারের সাধারণ বাজেটে।

আরও পড়ুন-জমে উঠেছে নাট্যমেলা

সীতারামন বাজেট পেশের সময় ‘সক্ষম অঙ্গনওয়াড়ি’ এবং ‘পোষণ ২.০’ প্রকল্প নিয়ে লোকদেখানো প্রশংসাসূচক মন্তব্য করলেও ব্যয় বরাদ্দে কানাকড়ি বৃদ্ধি করেই ছেড়ে দিয়েছেন। ২০২৫-’২৬ অর্থবর্ষের প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩-২৪ সালে ‘সক্ষম অঙ্গনওয়াড়ি’ এবং ‘পোষণ ২.০’ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ২১৮০৯.৬৪ কোটি টাকা। গত অর্থ বর্ষে বা ২০২৪-’২৫ সালে এই বরাদ্দ ছিল ২১২০০.০০ কোটি। আর এবার অর্থমন্ত্রী ২১৯৬০.০০ কোটি বরাদ্দ করেছেন এই দুই প্রকল্পে। অর্থাৎ মাত্র ১৫০.৩৬ কোটি বাড়ল এবার। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির নিরিখে বিচার করলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, আসলে এবারের বাজেটে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হল। কারণ এই সময়ে টাকার দাম কমেছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। শিশু, প্রসূতি এবং স্তন্যদায়ী মায়ের পুষ্টির বিষয়টিও স্বাভাবিকভাবেই উপেক্ষা করা হয়েছে। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, সহায়িকা এবং অন্যান্য প্রকল্প-কর্মীরা প্রাথমিকভাবে দেশের ভিত্তিগঠনে নিরলস পরিশ্রম করেন, নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। শিশু ও মহিলাদের অপুষ্টি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এই প্রকল্প-কর্মীরা। তাঁদের প্রতি বঞ্চনা আখেরে মহিলা ও শিশুদেরই উপেক্ষা করা। এই প্রকল্পে বহু মহিলার কর্মসংস্থানের জোগানও হয়। অথচ দীর্ঘদিন তাঁদের ভাতা বাড়ে না, যেটুকু ভাতা পাওয়ার কথা তা-ও অনেকসময়ই পান না।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

এই খাতে বরাদ্দ পর্যালোচনা করলে অত্যন্ত গুরুতর যে বিষয়টি দেখা যাচ্ছে, তা হল শিশু-পিছু পুষ্টিমানের খরচ বাড়ানো হয়েছে মাত্র পাঁচ পয়সা! অতিরিক্ত পুষ্টির জন্য ব্যয়বিধি শেষ সংশোধিত হয়েছিল ২০১৭ সালে। সাত বছর পর এবার সেই বিধি ফের সংশোধিত হয়েছে। যদি ১০ কোটি উপভোক্তার বিচারে হিসাব করা হয়, যার মধ্যে আট কোটি শিশু এবং বছরে তিনশো দিনের হিসাবে দু’কোটি অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদায়ী মা, তাহলে রূঢ় বাস্তবই উঠে আসছে। যেখানে সরকারের পরিসংখ্যানই বলছে, দেশে সদ্যোজাত থেকে ৬ বছর বয়সি শিশুদের ৩৭ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ছ’কোটির চেহারা খর্বকায় এবং ১৭ শতাংশ বা ২ কোটি ৭৯ লক্ষের ওজন কম, সেখানে কী করে এই অবহেলা সম্ভব? কীভাবে এত অমানবিক হতে পারছে সরকার? প্রশ্ন তুলেছে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এবং সহায়িকাদের সংগঠন। নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ‘মৌলিক পরিষেবা প্রকল্পগুলিতে বরাদ্দ না বাড়ানো হলে বিকশিত ভারত কখনওই সম্ভব হবে না।’
যে বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও প্রকল্প নিয়ে বুক বাজিয়ে প্রচার চালায় মোদিবাহিনী, কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রকের অধীনস্ত সেই প্রকল্পেও এক টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। মোট বাজেট বরাদ্দের মাত্র ০.৫৩ শতাংশ দেওয়া হয়েছে এই মন্ত্রককে। প্রস্তাবিত বাজেট বরাদ্দের মাত্র ২ শতাংশ বরাদ্দ হয়েছে মহিলাভিত্তিক প্রকল্পগুলির জন্য। সংশোধিত হিসাব থেকে জানা যাচ্ছে, মহিলাদের নির্যাতন প্রতিরোধী, নির্যাতিতাদের সুরক্ষা এবং পুনর্বাসনের জন্য ‘মিশন সম্বল’ ও ‘সামর্থ্য’ প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয় প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে। আগের বাজেটগুলির মতোই এবারেও মহিলাদের সমস্যায় কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। রেগাতেও বরাদ্দ বাড়েনি। নরেন্দ্র মোদির সরকার বিজ্ঞাপন দেওয়ার চেষ্টা করলেও বাস্তবে সেই ফাঁকিই দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টা হেলাফেলার নয়, উদ্বেগের। কারণ, ভারতে আঠারো বছরের কম বয়সিদের সংখ্যা এখন ৪০ কোটির বেশি। এই মাপকাঠিতে চিন দ্বিতীয়, সংখ্যা ৩০ কোটির কম। আগামী দু’তিন দশকে এই ব্যবধান আরও বাড়বে। অর্থাৎ, গোটা বিশ্বে ভারতীয় শিশু-কিশোরের সংখ্যা কেবল সর্বাধিক নয়, নিকটতম প্রতিযোগীর থেকে এই দেশ অনেক এগিয়ে এবং ব্যবধান ক্রমবর্ধমান। শিশু ও কিশোরদের ভাবী নাগরিক আখ্যা দেওয়া হয় এবং বিভিন্ন উপলক্ষে সেই আখ্যা নিয়ে বিস্তর বাগাড়ম্বর করা হয়। এমন একটি দেশ সব থেকে বেশি শিশুবহুল দেশ হলে বিশ্বের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তব সম্পূর্ণ বিপরীত।

আরও পড়ুন-পিএইচএ’র প্রথম বৈঠক

এ দেশের শিশুবহুলতা ভবিষ্যতের পক্ষে গভীর উদ্বেগজনক। তার কারণ, অগণন ভারতীয় শিশু জীবনের ন্যূনতম সুযোগ, সক্ষমতা ও অধিকার থেকে বহুলাংশে বঞ্চিত। শিশুদের পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি সূচকের বিচারে এই দেশ— চিন তো দূরস্থান— এমনকী সাহারার দক্ষিণবর্তী অনুন্নত আফ্রিকার অনেক দেশেরও পিছনে।
এমন একটি দেশের সরকার সর্বশক্তি দিয়ে শিশুদের হাল ফেরাতে তৎপর হবে, এমনটাই প্রত্যাশিত। সেই তৎপরতার একটি মাপকাঠি অবশ্যই বাজেট-বরাদ্দ। সুতরাং, প্রশ্ন করা যাক, গত শনিবার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যে বাজেট পেশ করেছেন তাতে শিশুদের জন্য বরাদ্দ কত? একটি বাজেটে কোন কোন খাতের কত টাকা ‘শিশুদের জন্য’ বরাদ্দ বলে গণ্য করা হবে তার হিসাব কষার নানা পদ্ধতি আছে, সুতরাং অঙ্কটি নিয়ে সব সময়েই তর্ক থাকে। কিন্তু বছরে বছরে সেই অঙ্ক কতটা বাড়ছে, সেটি শিশুদের প্রতি সরকারি দায়বোধের সূচক হিসাবে অবশ্যই প্রাসঙ্গিক এবং মূল্যবান। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় বাজেটে শিশুদের জন্য বরাদ্দ বেড়েছে ৫.৬৫ শতাংশ। কিন্তু এই পরিমাপ যথার্থ ছবিটি দেখায় না। প্রথমত, এই বৃদ্ধি টাকার অঙ্কে, অর্থাৎ, মূল্যবৃদ্ধির মাত্রা ধরে নেওয়ার পরে প্রকৃত বৃদ্ধি যৎসামান্য। দ্বিতীয়ত, এই ধরনের যে কোনও বরাদ্দের মতোই এ-ক্ষেত্রেও সরকারি ব্যয়ের অঙ্কটিকে জাতীয় আয় তথা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির অনুপাত হিসাবে দেখা বিধেয়। এবং সেই অনুপাতটি কষলেই উন্মোচিত হয় এক লজ্জাকর চিত্র : গত অর্থবর্ষে (২০২৩-২৪) ‘শিশু বাজেট’ ছিল জিডিপির ০.৩৪ শতাংশ, এ বছর সেই অনুপাত দাঁড়াতে চলেছে ০.৩৩ শতাংশে। অর্থাৎ, দুনিয়ার সর্বাধিক অপুষ্ট এবং শিক্ষাহীন স্বাস্থ্যহীন সম্ভাবনাহীন শিশুর দেশে যে কাজে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ঝাঁপিয়ে পড়া অত্যাবশ্যক, সেখানে শিশুদের জন্য বাজেটের বরাদ্দ আনুপাতিক বিচারে বাড়ছে না, কমছে!

Latest article