প্রতিবেদন: মোদিরাজ্য গুজরাটকে নিয়ে বিজেপির বাগাড়ম্বরের ফানুস ফুটো করার মতো তথ্য উঠে এল সমীক্ষা-রিপোর্টে। জানা গিয়েছে, গুজরাটের যে উন্নয়ন মডেল শিল্প সম্প্রসারণের মাধ্যমে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করার প্রচার করে, তাতে আদতে বেড়ে চলেছে আর্থ-সামাজিক বৈষম্যও। মোদির মডেল রাজ্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং দারিদ্র্য ব্যবস্থাপনার মতো অন্যান্য সূচকে অনেকটাই অনগ্রসর রাজ্য বিহারের কাছাকাছি রয়েছে।
আরও পড়ুন-স্পষ্ট হয়ে গেল কেন্দ্রের স্বেচ্ছাচারী মনোভাব
একটি রাজ্যের আর্থিক সীমাবদ্ধতা, সামাজিক খাতে ব্যয়ের মূল্যায়নের মতো বেশ কিছু বিষয় এই নতুন সমীক্ষায় উঠে এসেছে। ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং ইন্ডোলজিস্ট দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তান বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফ জাফরেলট, রয়্যাল নেদারল্যান্ডস ইনস্টিটিউট অফ সাউথইস্ট এশিয়ান অ্যান্ড ক্যারিবিয়ান স্টাডিজের ভারতীয় এবং ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতি গবেষক ভিগনেশ রাজাহমানি এবং সহায়ক গবেষক নীল ভরদ্বাজের লেখা ‘ইন্ডিয়া : দ্য চ্যালেঞ্জ অব কন্ট্রাস্টেড রিজিওনাল ডায়নামিক্স’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্রে তিনটি রাজ্য— বিহার, গুজরাট এবং তামিলনাড়ুকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই গবেষণাপত্রে ‘ভারতের মধ্যে বিভিন্ন ভারত’ খোঁজার চেষ্টা হয়েছে এবং একইসঙ্গে বিভিন্ন রাজ্যের আর্থ-সামাজিক ও শাসননীতির পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে, যা তাদের উন্নয়নের পথকে পরিচালিত করছে। এই গবেষণাভিত্তিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিহার স্থায়ীভাবে অনুন্নত রাজ্যের উদাহরণ। অন্যদিকে গুজরাট মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে ধনী রাজ্য হলেও সামাজিক উন্নয়নের মানদণ্ডে কার্যত গুজরাটের সমতুল্য। বলা হয়েছে, মোদিরাজ্যের উন্নয়নের পথ মূলধন-নিবিড় শিল্প, অবকাঠামো বিনিয়োগ এবং ব্যবসা-বান্ধব নীতির মাধ্যমে দ্রুত শিল্প সম্প্রসারণের একটি মডেল। তবে শিক্ষায় কম বিনিয়োগের কারণে সামাজিক বৈষম্য তীব্র হচ্ছে। প্রতিবেদনে এই তিন রাজ্যের সামাজিক ব্যয়ের ধরন বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিহার, তার অপ্রতুল সম্পদ সত্ত্বেও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। অন্যদিকে, তামিলনাড়ু আরও বেশি বরাদ্দ দিচ্ছে। কিন্তু আমজনতার সার্বিক উন্নয়ন বা সামাজিক বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে গুজরাট পিছিয়ে আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং আবাসন-সহ অন্যান্য খাতের জন্য গুজরাটের বাজেট অনেক কম। সামাজিক উন্নয়নের মানদণ্ডে তামিলনাড়ুর তুলনায় তো বটেই, বিহারের তুলনাতেও পিছিয়ে গুজরাট।
আরও পড়ুন-অর্জুন বনাম অর্জুন, এফআইআর দায়ের স্ত্রীর
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনস্বাস্থ্য নীতির ফলপ্রসূ প্রয়োগ দেখা যায় না গুজরাটে। আর্থিক দিক থেকে ধনী হওয়া সত্ত্বেও জনস্বাস্থ্য ব্যয়ে পিছিয়ে আছে মোদিরাজ্য। স্বাস্থ্যখাতে ২০১২-১৩ এবং ২০১৯-২০-এর মধ্যে বৃদ্ধির হার মাত্র ১০.৫ শতাংশ। অথচ বিহারে এই বৃদ্ধি হয়েছে ২৯.৫ শতাংশ। তামিলনাড়ুতেও বৃদ্ধি হয়েছে ২০.৫ শতাংশ, যা গুজরাতের তুলনায় দ্বিগুণ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে বিহারের উচ্চ সামাজিক ব্যয় এটিকে হিন্দি বলয়ে একটি অনন্য অবস্থানে রাখে। বলা হয়েছে, বিহার তার জিএসডিপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সামাজিক খাতে ব্যয় করেছে সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও। এর বিপরীতে গুজরাট অবকাঠামো-নির্ভর প্রবৃদ্ধির জন্য পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও জনগণের সামাজিক উন্নয়ন খাতে তুলনামূলকভাবে কম ব্যয় করে, যা শেষপর্যন্ত বাড়িয়ে দিচ্ছে সমাজের বৈষম্যকেই। সামাজিক খাতে ২০২১-’২২ সালে গুজরাটের ব্যয় প্রায় ৪.৪৬ শতাংশেই স্থবির হয়ে আছে। উল্টোদিকে তামিলনাড়ু মানব উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে এই প্রবণতার মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, তামিলনাড়ু তার দক্ষিণি প্রতিপক্ষদের মতো সামাজিক কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, অন্যদিকে গুজরাট মডেল অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে ঝুঁকে প্রকারান্তরে সামাজিক বৈষম্য বাড়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাফরেলট বলেছেন, সম্ভবত নরেন্দ্র মোদি মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ আনার চেষ্টা করেছেন গুজরাটে। অথচ অপুষ্টি, সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের হার সহ অনেক দিক থেকেই মোদিরাজ্যের স্থান আসলে বিহারের কাছাকাছি। শিক্ষার হার মোটেও ভাল নয়, অন্তত ইংরেজিমাধ্যম শিক্ষা খুবই দুর্বল। এক্ষেত্রে তামিলনাড়ু এমন একটি রাজ্য, যেটি প্রায় দারিদ্র্য দূর করেছে, উচ্চগতিতে শিল্পায়ন করেছে এবং যেখানে পরিষেবা শিল্পকে প্রতিস্থাপন করছে। মডেল রাজ্যের প্রচার সত্ত্বেও গুজরাটে এরকম পরিস্থিতি দেখা যায়নি।