‘আমি হিন্দু-মুসলমান বিভাজন করি না।’
এবারের লোকসভা নির্বাচনের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং কৌতুককর বাণী বোধ হয় এই বাক্যটি। আর কেউ নন, এর স্রষ্টা হচ্ছেন শ্রীনরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। বিগত ১০ বছর যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। এবারও বারাণসী লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপি’র প্রার্থী।
মনোনয়নপত্র দেবার আগে যথারীতি পুজো-পার্বণ হয়েছে। পবিত্র গঙ্গায় স্নান সেরেছেন। হিন্দু ধর্মগুরুদের সঙ্গে নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেছেন। দেশের তাবড় তাবড় বিজেপি নেতা ও মুখ্যমন্ত্রীরা ছিলেন উপস্থিত। সঙ্গে গেছেন অবশ্য একমাত্র যোগী আদিত্যনাথ। মনোনয়নপত্র দিয়ে নিজেকে গঙ্গাপুত্র বলে অভিহিত করলেন। তারপর কী যে হল তাঁর— বিখ্যাত বাণীটি দিয়ে ফেললেন!
আরও পড়ুন-দুই ভারতীয় মশলায় নিষেধাজ্ঞা নেপালে, এভারেস্ট ও এমডিএইচ সংস্থার পণ্য
আমার প্রশ্ন এটাই— ১০ বছরে এবারই কেন কথাটি বলার দরকার পড়লে? আচ্ছা, সে-কথার জবাব বা আলোচনা না হয় পরে হবে। একটু স্মরণ করতে বলি যে, মনোনয়নপত্র জমা দেবার সময় যে নেতা সমাবেশ হয়েছিল তাতে কোনও খানে কোনও মুসলমান, খ্রিস্টান বা সংখ্যালঘু অন্য কোনও নেতাকে দেখা গেছে? একেবারেই না। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন যে, সবধর্ম মিলিয়ে নেতা নিয়ে যেতে হবে তার কি অর্থ আছে? একেবারে ন্যায্য প্রশ্ন? কিন্তু ওই যে বাধ সাধলো ‘বাণী’টি। আর তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশের প্রধানমন্ত্রী আর তিনি হিন্দু-মুসলমানে বিভাজন করেন না। গোল বেধেছে এখানেই। তাহলে কেবল হিন্দু ধর্মগুরুদের সঙ্গে নিয়ে, পাশে বসিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন কেন?
বেশির ভাগ দফার ভোট শেষ হয়ে গেছে। প্রথম থেকে উত্তাপ ছড়িয়ে ছিলেন যে এবার ৪০০ পার হবে। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে তত বুঝতে পারছেন মানুষের মনোভাব তাদের পক্ষে নেই। গলার স্বর ক্রমেই নিম্নগামী। প্রত্যেকটা সভাতে ফাঁকা চেয়ারের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ফলে বুঝতে পারছেন সেদিন আর নেই। সেই কারণে যে কোনও পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা করছেন না।
আরও পড়ুন-চারদিন পর চতুর্থ দফার ভোটের হার প্রকাশ কমিশনের, বাংলায় ভোটের হার বেড়েছে
মাত্র ক’দিন আগে সংখ্যালঘু মুসলমানদের সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য করেছেন রাজস্থানের বাঁশওয়াড়াতে। বরাবর এই কাজটা করে চলেন নরেন্দ্র মোদি। গোধরা কাণ্ডের পর গুজরাত দাঙ্গার সময় তিনি সেখানে মুখ্যমন্ত্রী। এহসান জাফরির ফোন ধরেননি। তাঁকে রক্ষা করেননি। এহসান জাফরি শহিদ হয়েছেন। রিলিফ ক্যাম্পগুলি সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য করেছেন। আর তিনিই আজ বলছেন হিন্দু-মুসলমানে বিভাজন করেন না।
অসমের কথা একটু বলা দরকার। বিজেপি’র সরকার চলছে। এককালের কংগ্রেস নেতা এখন বিজেপি’র মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা। তিনি তো যে কোনওভাবে মুসলমানদের তাড়াতে চান। মাদ্রাসাগুলোতে সরকারি সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছেন। মাদ্রাসা বোর্ড নেই। আরবি শিক্ষার ব্যবস্থা একে বারে সঙ্কুচিত। দেশের সংবিধানে লেখা আছে এই ভারতে যে কেউ তার নিজের ধর্মপালন, ধর্মপ্রচার এবং ধর্মশিক্ষা করতে পারবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দয়া করে আমাদের জানাবেন আপনার দলের শাসনে থাকা অসম রাজ্যে কী হচ্ছে? আপনারা বিভাজন মান্য করছেন, বাড়িয়ে দিচ্ছেন এবং স্থায়ী হতে বলছেন সে-কারণেই এসব হচ্ছে। আসলে ভোটের মুখে, আসন্ন ফলাফলের আশঙ্কায় ‘রা’ পাল্টাচ্ছেন।
আরও পড়ুন-ছিঁড়ল চটি, মঞ্চে বসেই লাগালেন সেফটিপিন
মাননীয় নরেন্দ্র মোদিজি, আপনার নিশ্চয় জানা আছে উত্তরপ্রদেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের বড় উৎসব বকরিদে পশুবলি বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আপনি কি জানেন, তাদের বলা হয়েছে কেক-এর উপর পশুর ছবি এঁকে সেটা কাটতে। কতবড় নিষ্ঠুর বিভাজন থাকলে এমন কাজ হতে পারে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীজি আপনি জানেন হরিয়ানা রাজ্যে প্রকাশ্যে নামাজ পড়তে সরকারি অনুমোদন লাগে? তার জন্য আইন হয়েছে। এই রাজ্যটিতে আপনার পার্টি ক্ষমতায় আছে। এবার নিশ্চিত হারের সামনে দাঁড়িয়ে।
নির্বাচনের দিন যত এগিয়েছে আপনি নিজে বিভাজনের তাস খেলেছেন। কোনও সময় আপনি পোশাক দেখে মানুষ চিনেছেন। কোনও সময় আপনি নাম দেখে দুষ্কৃতী আখ্যা দিয়েছেন, কোনও সময় সংখ্যালঘুদের জীবনযাত্রা, শিক্ষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি নিয়ে বিদ্রুপ করে বিভাজনের রেখাটিকে মোটা থেকে আরও মোটা করেছেন। আর আজ আপনি বলছেন বিভাজন মানেন না। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, আপনি সেটা বুঝবেন না, ঠ্যালায় না পড়লে বিড়াল গাছে ওঠে না। আপনার এ-রাজ্যের নন্দী-ভৃঙ্গীরা বুঝবে।
প্রধানমন্ত্রীজি, আপনি নিশ্চয় জানেন যে, আপনার রাজত্বকালে এই প্রিয় ভারতভূমিতে সঙ্কটময় একনায়কতন্ত্র চলছে। আপনার শাসনে গণতান্ত্রিক মানদণ্ডে ভারত দ্রুত নিচের দিকে নামছে। হিন্দু-মুসলমানে আপনার দ্বারা তৈরি করা বিভাজন একটি অন্যতম কারণ। এখানে বিগত ১০ বছরে নাগরিকদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে সব চাইতে বেশি। সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে বলা হয় দেশদ্রোহী। অথবা শহুরে নকশাল। সংখ্যাগুরুবাদের প্রতিষ্ঠা ও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন বেড়েছে সব চাইতে বেশি। নোটবন্দি, দু’হাজার টাকার নোট ফিরিয়ে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে আর্থিক দুর্নীতির দরজা গেছে খুলে। আজকের ভারতে ধর্মপরিচয় একটি মোক্ষম বিভেদাস্ত্র। বিশেষ করে শাসক ও তার অনুগামী ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সংগঠনগুলির হাতে। ব্যক্তি পরিচয় এবং ধর্মনিরপেক্ষতা দুটোই আজ ভারতে সংকটের সামনে। আপনি অস্বীকার করতে পারেন, বাড়িতে গোমাংস আছে এই মনগড়া অভিযোগে ব্যক্তিকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে একমাত্র ভারতে। বড় বিভাজন ছাড়া এটা সম্ভব নয়। আর এই বিভাজনকে চওড়া থেকে চওড়াতর করেছেন আপনি, আপনার দল, আপনার সরকার। আজ সাধু সাজছেন। কারণ হাওয়া উল্টো বইছে— তাই। যতই সাধু সাজুন, আপনার বিদায়ের ঘণ্টা বেজে গেছে। সময়ের অপেক্ষা।