নিজেদের দিকে তাকান মোদিজি, তারপর না হয় বাংলা নিয়ে মিথ্যাচার

বেঙ্গল মিনস বিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট মিনস বেঙ্গল। এটা জানা আছে তো! যদি জানা না থাকে, তবে মোদি ও তাঁর বাহিনী জেনে নিন। লিখেছেন অধ্যাপক ড. রূপক কর্মকার

Must read

সাম্প্রতিক কিছু বাক-বিতণ্ডায় একটা জিনিস পরিষ্কার হয়েছে, একটি রাজনৈতিক দলের প্রচারিত মুখের কথায় এবং প্রকাশিত তথ্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। আর একটি রাজনৈতিক দলের প্রচারিত মুখের কথায় এবং প্রকাশিত তথ্যের মধ্যে সিংহভাগ মিল রয়েছে। অবশ্যই আলোচনাটা রাজ্য সরকারের উন্নয়ন ও কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন নিয়ে। সেই উন্নয়নের পরিসংখ্যান কয়েকটি মাপকাঠির ওপর যে নির্ভর করে আছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তেমনি একটি মাপকাঠি হল বেকারত্বের হার। যা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কাটাছেঁড়া চলছে। পরিসংখ্যানটা বর্ণনা করলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে। ভারত সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ভারতবর্ষে বেকারত্বের হার বর্তমানে ৫.৬ শতাংশ, যা মে মাসেও সমান ছিল। এই তথ্য ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সি ব্যক্তিদের মধ্যে সার্ভের ফলাফল।

আরও পড়ুন-শেষ চারে উঠে নজির দিব্যার

আরও তথ্য বলছে বেকারত্বের হার বর্তমান সাপ্তাহিক অবস্থায় শহর ও গ্রামীণ এলাকা মিশিয়ে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়স পর্যন্ত ২০২৫ -এর এপ্রিলে ছিল ১৩.৮ শতাংশ, মে মাসে ছিল ১৫ শতাংশ এবং জুনে সর্বশেষ রেকর্ড হয়েছে ১৫.৩ শতাংশ। যদি সর্বতোভাবে বলি অর্থাৎ ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে বেকারত্বের হার ২০২৫-এর এপ্রিলে যা ছিল ৫.১ শতাংশ, মে মাসে বেড়ে হয়েছিল ৫.৬ শতাংশ এবং জুনেও সেই একই হার বজায় থেকে ৫.৬ শতাংশ রয়েছে। ২০২৫ জানুয়ারিতে CMIE তথ্য অনুযায়ী ভারতবর্ষের বেকারত্বের হার থেকে পশ্চিমবঙ্গে বেকারত্বের হার ছিল অনেকটাই কম। অতীত হোক বা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু আগেও এগিয়ে ছিল, এখনও এগিয়ে আছে, অর্থাৎ আমরা বলতেই পারি পশ্চিমবঙ্গ পথ দেখাচ্ছে কর্মসংস্থানের। কেন্দ্রের নীতি আয়োগও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছে।
তথ্যটা কয়েক বছরের পুরনো হলেও ২০২২-’২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে বেকারত্বের হার সর্বনিম্ন ২.২% যা জাতীয় হারের থেকেও উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। PLFS-এর মাসিক বুলেটিনের তথ্য বলছে গ্রামীণ মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ১ শতাংশের ও বেশি হ্রাস পেয়েছে অথচ পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের কর্মসংস্থানের জোয়ার আগের থেকে অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সকল তথ্য থেকে কর্মসংস্থানের দিশা কোন দিকে যাচ্ছে তা বোধহয় আলাদা করে আর বলতে হবে না। ভারত সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো ও তথ্য অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার বলছে ৫১০০০ যুবক-যুবতী-কে স্থায়ী চাকরির নিয়োগপত্র দিয়েছে। এই তথ্যে আরও বলা হয়েছে লক্ষ লক্ষ যুবক রোজগার মেলার মাধ্যমে নাকি কর্মসংস্থান পেয়েছেন। এখানেই প্রশ্ন, বিগত কত বছরে এই ৫১০০০ যুবক-যুবতীদের চাকরি হয়েছে? আর যদি সত্যিই সরকারি চাকরি পেয়ে থাকেন তাহলে কোন কোন ক্ষেত্রে সেই নিয়োগ হয়েছে? এই সকল প্রশ্নের কিন্তু কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে কেন্দ্রীয় সরকার বলছে বিগত ১১ বছরে ভারতবর্ষে নাকি ২২ লক্ষ সরকারি চাকরি হয়েছে, কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ অনুযায়ী বিগত ১১ বছরে ভারতবর্ষে ২২ কোটি চাকরি হওয়ার কথা। প্রতিবছর ২ কোটি করে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অর্থাৎ যা চাকরি হওয়ার কথা তার কিন্তু এক শতাংশই চাকরি হয়েছে। আরও কিছু তথ্য দিই, রাজ্যের শিল্পবান্ধব পরিবেশের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বহু শিল্পপতি আজ বাংলামুখী। সেই সূত্র ধরেই মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কাছে টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান এসেছিলেন সাক্ষাৎ করার জন্য আগামীর কিছু পরিকল্পনা নিয়ে।

আরও পড়ুন-ভাষা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন: বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি দিল্লিকো বদল ডালো

পশ্চিমবঙ্গে যে শিল্পের চাহিদা রয়েছে তা টাটা গোষ্ঠীও বুঝতে পেরেছে কিন্তু পরক্ষণে রাজ্যের বিরোধী দলের থেকে যে বক্তব্য এসেছিল তা ছিল, টাটা গোষ্ঠী কথা বলে গেলেন কিন্তু বিনিয়োগ করবেন আমরা যখন সরকার গড়ব তখন, আদৌ কি বাংলায় বিজেপির পক্ষে সেটা সম্ভব? কিন্তু তথ্য বলছে টাটা গোষ্ঠী ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে টাটা মেটালিক্স সম্প্রসারণের জন্য। এমনকী টাটা মেডিক্যাল সেন্টার রাজারহাটে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল তৈরি করছে। এখানেই শেষ নয়, হসপিটালিটি ব্যবসায় অর্থাৎ হোটেল ব্যবসাতেও টাটা গোষ্ঠী ঢালাও বরাদ্দ করেছে, বর্তমানে হোটেলের সংখ্যা এক থেকে বেড়ে ছয় হয়েছে। এমনকী সিলিকন ভ্যালিতে টিসিএসের নতুন ক্যাম্পাস তৈরি হচ্ছে।
এরপরেও কি বলা যায় টাটা গোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করছে না? আগামী দিনে শুধু পশ্চিমাঞ্চল ঘিরে নানান শিল্প করিডরের মাধ্যমে প্রায় ২৫০০০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হতে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আরও একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিম্নবিত্ত গরিব মানুষের জন্য বাংলার বাড়ি তৈরি করে দেওয়া। তার থেকে এক ধাপ এগিয়ে উচ্চবিত্তরা যে আবাসনগুলো-তে স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী বাস করে সেই সুবিধা যাতে নিম্নবিত্ত মানুষেরাও পায় তার জন্য ‘সুজন্ন’ ও ‘নিজন্ন’ নামক আবাসন প্রকল্প তৈরি করছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ইতিমধ্যে বাংলায় ৫৭টি সিনার্জি মিটিংয়ের মাধ্যমে দু লক্ষ কুড়ি হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে, এতে কর্মসংস্থান যে বৃদ্ধি পাবে তাতে কিন্তু কোনও সন্দেহ নেই। পশ্চিমবঙ্গে ৬৬০টি ক্লাস্টার তৈরি হয়েছে। ছোট ও মাঝারি শিল্পে ১ কোটি ৩০ লক্ষেরও বেশি মানুষ কাজ করছে। এটা হল বাংলায় শিল্পের সাম্প্রতিক হালহকিকত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসে ঘোষণা করেছেন  দুর্গাপুর-হলদিয়া প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইনের কাজের। যদি একটু খেয়াল করেন বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাম্প্রতিক বাজেট লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন পশ্চিমবঙ্গে ৫৩২২ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্যাস পাইপ লাইনের কাজ হচ্ছে, যেখানে প্রায় ১৭ লক্ষ কর্মদিবস তৈরি হবে, সুতরাং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় কি কোনও নতুনত্ব আছে? নানান শিল্পপতিদের ভাষায় বেঙ্গল এখন বেস্ট ডেসটিনেশন ফর ইন্ডাস্ট্রি অর্থাৎ এমন ভাবেও বলা যেতে পারে ‘বেঙ্গল মিনস বিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট মিনস বেঙ্গল’। ভারতবর্ষের ২৯টির মধ্যে একটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে নারীর ক্ষমতায়নে, জীবনযাত্রার মানের সুস্থায়ী উন্নয়নে অনেক রাজ্যকেই পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলা।

আরও পড়ুন-বাঙালি প্রধানমন্ত্রী চাই, স্লোগানে মুখরিত ধর্মতলা-চত্বর

এমত পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বদা পাশে থাকার বদলে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্য পাওনা আটকে রেখে যে অসম প্রতিযোগিতা করছে তা সত্ত্বেও বাংলায় উন্নয়নের গতি কিন্তু স্তব্ধ হয়নি। একটা বিষয় কিন্তু সহজবোধ্য আমাদের কাছে, যে কোন রাজ্যের উন্নয়ন মানেই ভারতবর্ষের উন্নয়ন, বাংলার উন্নয়ন কি তার ব্যতিক্রম? নাকি বাংলায় উন্নয়ন হলে ভারতবর্ষের উন্নয়ন হবে না? এই প্রতিযোগিতা এমন পর্যায়ে গেছে যে অন্যান্য রাজ্য বিশেষ করে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলি বাঙালিদের হেনস্থা করতেও ছাড়ছে না। তবে ভবিষ্যতে দৃষ্টি রাখলে এটা পরিষ্কার যে, এই প্রতিযোগিতার সর্বশেষ ফলাফল হবে বাংলার মানুষের মন থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিসর্জন।

Latest article