সাম্প্রতিককালে শীত ও বর্ষার সময়কালের ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। শীত শুরু হতে কখনও কখনও ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পেরিয়ে যাচ্ছে। বস্তুত ১ মাসও জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়ছে না। তেমনি বর্ষার জন্যও হা-পিত্যেশ করতে হচ্ছে, প্রকৃত বর্ষা, যেটাকে সাউথ ওয়েস্ট মনসুন বলে, শুরু হতে হতে জুন মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। শুধু গরমের স্থায়িত্ব বেড়েই চলেছে। কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন-সহ প্রচুর গাছ কাটার ফল। হিমালয় পর্বতমালার অবস্থান, প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে প্রাণিজগতের অনুকূলে থাকলেও বিশ্ব উষ্ণায়নে প্রতিকূল হয়ে যাচ্ছে। উন্মুক্ত স্থানের মতো মাটি থেকে ৫ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বায়ুপ্রবাহ অবাধ হতে পারছে না। নানা প্রকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাসায়নিক ধূলিকণা-সহ সমস্ত রকম প্রদূষণকে সীমাবদ্ধ করে রাখছে। বায়ুমণ্ডল ঘন হচ্ছে ও তাপ ধরে রাখার ক্ষমতা বেড়ে যাচ্ছে। তাই যত বিপত্তি। শীতকে তাড়িয়ে দিচ্ছে, তেমনি বর্ষাকে প্রতারিত করছে। বায়ুমণ্ডলের তাপ যত বাড়বে জলীয়বাষ্পের ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিতে পরিণত হওয়ার ক্ষমতা তত কমে যাবে। ভারতে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাব কেরল উপকূলে ২ জুন এবং পশ্চিমবঙ্গে ৮ জুন হওয়ার কথা। মূলত এই ঘটনা পৃথিবীর নিখুঁত বার্ষিক গতির ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু উল্লিখিত নানা প্রাকৃতিক কারণে বিগত ১০-১৫ বছর যাবৎ ভীষণভাবে অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-বাংলার জল বিক্রি করে দিলে রাজ্য জুড়ে আন্দোলন, প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী
মৌসুমিবায়ুর আনুষঙ্গিক ঘটনা
আবহাওয়াবিদেরা নানা রকম পর্যবেক্ষণ করেছেন। দেখা গেছে, প্রকৃত মৌসুমিবায়ুর ঘটনা ঘটলে তিব্বত, মাদাগাস্কার অঞ্চল উচ্চচাপযুক্ত হবে। ভূপৃষ্ঠ বরাবর আরব সাগরের সোমালি প্রান্ত থেকে বিষুবরেখা অতিক্রম করে মুম্বইয়ের দিকে প্রবল বেগে হাওয়া আসবে। এটাকে সোমালি কারেন্ট বলে। মোটামুটি ১৫০০ মিটার উচ্চতায় ৪০-৫০ কিমি বেগে দক্ষিণ থেকে বায়ু ভারতের দিকে আসবে, এটাকে লো লেভেল জেট স্ট্রিম বলে। তেমনি কেরল থেকে ওড়িশা পর্যন্ত জায়গার ৬০০০ মিটার উচ্চতা থেকে ৬০-৮০ কিমি বেগ বায়ুপ্রবাহ হবে। এটাকে ইস্টারলি জেটস্ট্রিম বলে। আর মধ্য ভারত থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত জায়গার শুষ্ক তাপমাত্রা বেড়ে হিট লো তৈরি হয়। মনসুন ঠিক সময় না হলে এই হিট লো এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত হিট ওয়েভে পরিণত হয়। এগুলে মনসুনের অনেক আগে থেকেই ঘটা শুরু হয়। তাই প্রকৃত মনসুন হবে কি না অনেক আগে থেকেই বলে দেওয়া যায়। ওয়ার্ল্ড মিটিওরোলজিকাল অর্গানাইজেশনের (WMO) নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ১০০টি অবজারভেটরির মধ্যে ৬০টি অবজারভেটরিতে পর পর ২ দিন, ২.৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে, ওখানে মনসুন শুরু হয়েছে বলা হবে। এবার সাইক্লোন রিমেলের জন্য ওয়ার্ল্ড মিটিওরোলজিকাল অর্গানাইজেশনের (WMO) শর্ত পূরণ হওয়ায় ইন্ডিয়া মিটিওরোলজিকাল ডিপার্টমেন্ট অনেক আগেই কেরল এবং নর্থ বেঙ্গলে মনসুন শুরু ঘোষণা করেছে।
আরও পড়ুন-সংবিধান হাতে প্রতিবাদ তৃণমূলের সঙ্গে ইন্ডিয়া
পৃথিবীতে তাপের তারতম্য ও গতিপথ
পৃথিবীর বিষুবরেখা অঞ্চলে সূর্যের তাপ সব থেকে বেশি। এই তাপ বিষুবরেখা অঞ্চল থেকে যেমন মেরুর দিকে যায়, তেমনি ঘূর্ণনের ফলে বিষুবরেখা বরাবর পূর্ব থেকে পশ্চিমেও বায়ুর গতি বরাবর তাপপ্রবাহ হয়। কোনও ক্ষেত্রেই এই তাপপ্রবাহ রৈখিক নয়, ঊর্ধ্বগতি ও নিম্নগতি সম্পন্ন চক্রাকারে হয়। যখন তাপ বিষুবরেখা থেকে মেরুর দিকে যায় তখন ৩টি চক্র যথাক্রমে হেডলি সেল, ফেরারেল সেল ও পোলার সেল। যখন বিষুবরেখা বরাবর পূর্ব থেকে পশ্চিমে, তাপপ্রবাহ বেশ কয়েকটি উলম্ব চক্রাকার পথে হয় তখন তাকে বলে ওয়াকার সেল। স্বাভাবিক নিয়মে ওয়াকার সেল, দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগর সংলগ্ন পেরু উপকূলে বায়ুর গতি ঊর্ধ্বমুখী গতি হয় এবং বেশ কয়েকটি চক্রাকার পথে জাপান-ইন্দনেশিয়া অতিবাহিত করে দক্ষিণ আফ্রিকার মাদাগাস্কার দ্বীপের কাছে ওই বায়ুর গতি ক্রিকেটের ফুল টস বলের মতো নিম্নমুখী হয়। এর ফলে মাদাগাস্কার দ্বীপে উচ্চচাপ অঞ্চলে পরিণত হয়। এই উচ্চচাপের ওপর নির্ভর করে পূর্ব উল্লিখিত সোমালি কারেন্ট, লো লেভেল জেট উৎপন্ন করে, তারপর কেরল উপকূলে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি প্রভাব বিস্তার করে। ধীরে ধীরে মধ্যভারত থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত হিট ওয়েভের উপশম হয়।
আরও পড়ুন-টেন্ডার নিয়ে বড় ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর, প্রশ্ন দিঘা-সহ ২ উন্নয়ন পর্ষদের প্রয়োজন নিয়েও
কেন মৌসুমির বিলম্ব বা থমকে যাওয়া
চলতি দশকে মৌসুমি বায়ুর আরম্ভ প্রতি বছরই বিলম্বিত হচ্ছে অথবা অন্য কোনও ঘটনায় আগেই (অপরিণত) আগমন হচ্ছে। এটির জন্য আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন বিশ্ব উষ্ণায়ন ও পেরু অঞ্চলে উৎপন্ন এলনিনো, লা-নিনা, এনসো ইত্যাদি ঘটনা। এগুলি মনে করার পেছনে অনেক বাস্তব পর্যবেক্ষণের সমর্থন রয়েছে। এটা মনে রাখতে হবে এই বায়ুমণ্ডলে যেখানেই বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী গতি, সেখানে নিম্নচাপ অঞ্চল আর যেখানে নিম্নমুখী গতি, উচ্চচাপ অঞ্চল। বায়ুপ্রবাহ বিষুবরেখা বরাবর পেরু থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে (ওয়াকার সার্কুলেশন) প্রায় ১৩০০০ কিলোমিটার (ধরে নেওয়া যাক ক্রিকেটের ২২ গজ) অতিক্রম করে মাদাগাস্কার দ্বীপের কাছে এর নিম্নমুখী গতি হয়। অর্থাৎ, মাদাগাস্কার উচ্চচাপ অঞ্চল। আরও ধরে নিচ্ছি পেরু বল করছে আর মাদাগাস্কার ব্যাট করছে। যদি ওয়াকার সার্কুলেশন ঠিক থাকে তবে পেরুর বল, ফুলটসের মতো মাদাগাস্কারের কাছে আসবে। অর্থাৎ নিম্নমুখী গতি। কিন্তু যদি এল-নিনো বা লা-নিনা বা বিশ্ব উষ্ণায়ন থাকে তবে বলগুলি মাদাগাস্কারের কাছে গুড লেন্থ, শর্ট লেন্থ, হাফ ভলি বা শর্ট বল হিসাবে আসবে। এই বলগুলির সবার অভিমুখ মাদাগাস্কারের কাছে ঊর্ধ্বমুখী। কাজেই নিম্নচাপ অঞ্চল। অর্থাৎ, মাদাগাস্কারে উচ্চচাপের জায়গায় নিম্নচাপ হয়ে যায়। কাজেই মৌসুমিবায়ু বিঘ্নিত। ন্যাশনাল ওসানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NOAA )-এর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এল-নিনো কমছে আর লা-নিনা শুরু হচ্ছে। তাই এই বছরের মনসুনে এদের প্রভাব কম। তাই বাকি থাকল এনসো আর বিশ্ব উষ্ণায়ন। এরাই এ-বছরের মনসুনকে বিঘ্নিত করার জন্য দায়ী। বস্তুত ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্ট (ECMWF) মডেল অনুযায়ী মাদাগাস্কার অঞ্চলে এখনো উচ্চচাপ অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সর্বঘটের কলা বিশ্ব উষ্ণায়নের সাথে এনসো ঘটনা উচ্চচাপকে নিম্নচাপে পরিণত করার ক্ষমতা রাখে।