প্রতিবেদন : ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই দেশের সব মানুষকে ব্যাঙ্কিং পরিষেবার আওতায় আনার কথা ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। জনধন যোজনা চালু করে তার বহুল প্রচারে সরকারি কোষাগার থেকে বেরিয়ে গেছে কোটি কোটি টাকা। এখন সেই সব জনধন অ্যাকাউন্টের অবস্থা কী, তা আলাদা গল্প। কিন্তু মোদি জমানায় কী অবস্থা দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার? তার উপরে আলো ফেলতেই এই প্রতিবেদন। শুধু সংযুক্তীকরণের নামে একাধিক সরকারি ব্যাঙ্ককে বন্ধ করে দেওয়া নয়, তথ্য বলছে, নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখার সংখ্যা কমেছে রেকর্ড হারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
আরও পড়ুন-২৪ জানুয়ারি মেঘালয়ে তৃণমূলের ইস্তাহার প্রকাশ করবেন অভিষেক
বিশেষজ্ঞদের মতে, একদিকে জি-২০ সম্মেলন আয়োজন করে সকলকে ব্যাঙ্কিং পরিষেবার আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা চলছে। সেখানে সরকারি ব্যাঙ্কিং পরিষেবাকে ক্রমাগত সংকুচিত করার বৈপরীত্য প্রতিফলিত হচ্ছে মোদি সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে। ২০১৯ সালে তথ্য জানার অধিকার আইনের আওতায় চন্দ্রশেখর গৌড়-এর প্রশ্নের জবাবে এই তথ্য দিয়েছে খোদ ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সেখানে জানানো হয়েছে ২০১৪ থেকে ২০১৯ : এই পাঁচ অর্থবর্ষে ৩ হাজার ৪০০ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা বন্ধ হয়েছিল অথবা অন্য শাখার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর পাঁচ বছরের হিসেব ধরলে সংখ্যাটা ৫ হাজার পেরিয়ে যেতে বাধ্য।
আরও পড়ুন-দিল্লিতে জীবন সিং? বাংলা ভাগের গভীর চক্রান্ত
বন্ধ হওয়া শাখাগুলির অধিকাংশ (শতকরা ৭৫ ভাগ) দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার। ২০১৪-’১৫ আর্থিক বছরে ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ৯০টি শাখা বন্ধ করে অথবা মিশিয়ে দেওয়া হয়। পরের বছর যা বেড়ে হয় ১২৬। ২০১৬-’১৭ অর্থাৎ নোটবন্দির বছরে আরও ২৫৩টি শাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০১৭-’১৮-তে ওই সংখ্যা এক ধাক্কায় বেড়ে হয় ২,০৮৩। প্রথম মোদি সরকারের আমলের শেষ অর্থবর্ষ অর্থাৎ ২০১৮-১৯-এও বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ৮৭৫ শাখা ছেঁটে ফেলা হয়েছিল বলে জানিয়েছে আরবিআই।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
২০১৯ সালে দ্বিতীয় মোদি সরকারের আমলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সংকোচন আরও গতি পেয়েছে বলে ধরা পড়ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দেওয়া তথ্যে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ দায়িত্ব নিয়েই দশটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে একত্রিত করে করে চারটি ব্যাঙ্ক তৈরি করেন। পাল্লা দিয়ে কমে ব্যাঙ্ক-শাখার সংখ্যাও। তথ্য অনুযায়ী ২০২০-’২১ অর্থবর্ষে দেশে ২,২৭১টি ব্যাঙ্ক-শাখা কমে গিয়েছে। এর মধ্যে পাকাপাকি তালা পড়েছে ৮৬টি শাখায়। অন্য শাখার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে ২,১৮৫টি শাখা। পরের বছর অর্থাৎ ২০২১-’২২ অর্থ বছরে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ৯টি শাখা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ২,৫৫৭টিকে অন্য শাখার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২০-’২১ ও ২০২১-’২২, এই দুই অর্থবর্ষে বছরে গড়ে ৪,৮৩৭টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা কমেছে। বিরোধীদের মতে, এই তথ্য থেকেই পরিষ্কার ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার প্রসার নয়, আদতে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে ধ্বংস করাই মোদি সরকারের উদ্দেশ্য। বিপুল সংখ্যক ব্যাঙ্ক-শাখা কমিয়ে গ্রামীণ ও পিছিয়ে পড়া এলাকার মানুষকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি ব্যাঙ্ক বা মহাজনদের দুয়ারে।
আরও পড়ুন-১২৭তম জন্মদিনের প্রাক্কালে নেতাজিকন্যা অনিতার বিস্ফোরণ
ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সুযোগ সারা দেশে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ব্যাঙ্ক শিল্প জাতীয়করণের মতো বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। সারা দেশে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে গড়ে উঠেছিল ব্যাঙ্কের হাজার হাজার শাখা। মনমোহন সিংহের আমল পর্যন্ত এই ধারাটিই চলেছে। তবে, গোড়া থেকেই উল্টোরথে সওয়ার প্রধানমন্ত্রী মোদি। প্রথমে নোট বাতিলের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ, ছোট ব্যবসায়ী, কৃষকদের নাভিশ্বাস। তার পরে অপরিকল্পিতভাবে জিএসটির বোঝা চাপিয়ে অর্থনীতির গোড়া ধরে নাড়া দিয়েছে এই কেন্দ্র সরকার। একই সঙ্গে পর্দার আড়ালে চলছে আরেক খেলা। প্রায় অর্ধ শতক ধরে দেশে যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার মজবুত বুনিয়াদ ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল তাকে ধ্বংসের পথে প্রতিদিন এককদম করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।