ঘটনা এক : কয়েক মাস হল চিরশ্রীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে অয়নের। অয়ন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত। মাঝে মাঝেই অফিস ট্যুরে বাইরে যেতে হয় তাকে। বিয়ের আগে বাইরে গেলে মাকে দু’বার করে ফোন করত সে, বিয়ের পরেও তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু বিয়ের পর প্রথমবার যখন অয়ন বাইরে যায়, তখন সময় পেলেই সে তার নববিবাহিত বউকে ফোন করত। আর এই ফোন করার ব্যাপারটা লক্ষ্য করে অয়নের মা। বউমাকে ছেলের ঘনঘন ফোন করাটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না তিনি। ছেলেকে বলেই বসেন, বউ পেয়ে মাকে ভুলে গেলি!
আরও পড়ুন-রক্ষণ অক্ষত রেখেই জয় চায় মোহনবাগান, আজ সামনে কেরালা ব্লাস্টার্স
ঘটনা দুই : এখনকার মেয়ে হয়েও রান্নার হাত দারুণ শুভশ্রীর। ওর শ্বশুরবাড়ি বহরমপুরে। কিন্তু ওর বর কৌশিকের চাকরির সূত্রে ওরা দু’জনে কলকাতায় থাকে। শুভশ্রীর হাতের রান্নার গুণে সমস্ত ধরনের মাছ খাওয়া শিখেছে কৌশিক। ওদের দু’জনের সংসারে মাঝেমধ্যেই কৌশিকের মা এসে থাকেন। তিনি এসে কৌশিকের সব ধরনের মাছ খাওয়া দেখে, তার সমস্ত রাগ উগরে দেন শুভশ্রীর উপরে। কারণ তাঁর ছেলে নাকি বিয়ের আগে তাঁর রান্না কোনও মাছই খেত চাইত না, এখন বউ তার ছেলেকে জাদু করেছে, সেই কারণেই বউয়ের হাতের রান্না-করা মাছ সুন্দর করে খেয়ে নিচ্ছে তাঁর ছেলে।
আরও পড়ুন-মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সরকারি পরিকাঠামোয় নজরদারি নবান্নের
ঘটনা তিন : স্বামীর চাকরিসূত্রে বাইরে থাকা অন্বেষা যখন গর্ভবতী হয়, তখন তাকে দেখভাল করার জন্য তার শাশুড়ি তাদের বাড়িতে আসেন। শাশুড়ি আসার পর থেকেই অন্বেষার জীবনে শুরু হয় নানান সমস্যা। অন্বেষার কোনও কিছুকেই যেন মেনে নিতে পারেন না ওর শাশুড়ি। গর্ভকালীন অবস্থায় অন্বেষার খাওয়া নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল না, তাই তাকে ডাক্তার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। ডাক্তারের কথামতো অন্বেষার স্বামীও ওর প্রচুর যত্ন নিয়েছিলেন। ডিম, ফল, ড্রাই ফুড— সবকিছু শেষ হওয়ার আগেই তিনি এনে ফ্রিজ-ভর্তি করে রাখতেন। আর এটাই ছিল অন্বেষার শাশুড়ির রাগের কারণ। প্রতিমুহূর্তে তিনি তাঁর ছেলের অলক্ষ্যে বউমাকে খাওয়ার খোঁটা দিতেন। প্রত্যেক মাসে বউমা যে চেকআপে যেত সেটাও তাঁর পছন্দ ছিল না। আসলে ছেলে তাঁর বউকে এত যত্ন করছে, সেটা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না।
যদি বন্ধু হও
আসলে শাশুড়ি-বউমার কথা বলতে বসলে এমন বহু ছবি, বহু চেনা অভিজ্ঞতার কথা মনে এবং চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কী বাংলা, কী হিন্দি ধারাবাহিক, বাবুর মায়েরা চিরকালীন এক সত্য। সেইসব ধারাবাহিকের টিআরপি রেটিং হাই হয় যেগুলোয় শাশুড়ি-বউমার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কিছু সম্পর্ক রয়েছে যার ঘাড়ে বন্দুক রেখে উতরে যায় বহু সিনেমাও। যেমন শাশুড়ি-বউমা। কারণ শাশুড়ি-বউমার দ্বন্দ্ব এক শেষ না-হওয়া সমস্যারই নামান্তর। ব্যতিক্রমী নেই তা নয় তবে বেশিরভাগ পরিবারেই শাশুড়ি-বউমার এই দ্বন্দ্ব চিরাচরিত এক দৃশ্য। এই দ্বন্দ্বে কে দায়ী কে বা দায়ী নয় প্রসঙ্গ সেটা নয়, কিন্তু বিষয়টা এই লড়াইটা যাকে বা যাদের নিয়ে তাঁরা পরপস্পরের একান্ত আপনার জন সেটাই তাঁরা ভুলতে বসেন।
আরও পড়ুন-বাড়ছে ডিমের দাম বড়দিনের কেক বিক্রি নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন বেকারি মালিকেরা
মা বিয়ে দিয়ে পুত্রসন্তানের জন্য এক মিষ্টি উপহার ঘরে আনেন যার নাম বউমা। যে আগামী গোটা জীবন তাঁর ছেলেরই সুখে দুঃখে ছায়াসঙ্গী হয়ে কাটাবে। তাই সন্তান ভাল থাকলে সংসারটাও শান্তির আর সুখের হবে এই সহজ সত্যটা উপলব্ধি করতে হবে সেই মাকেই। একটি মেয়ে যখন তার, আজন্মের পুরনো পরিবেশ, পরিবার ছেড়ে নতুন পরিবেশ, পরিবারে আসে সেই বাড়ির পুরুষটির হাত ধরে, তখন শাশুড়িই প্রথম নারী যে তার আগামীর পথটা কুসুমাস্তীর্ণ করতে পারেন। তাই নতুন সদস্যের সঙ্গে প্রথমে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে এবং পরে তাকেও মানিয়ে নেওয়া শিখতে সাহায্য করতে হবে শাশুড়ি-মাকেই। কারণ তিনিও একদিন এই পদাধিকারেই তো ছিলেন, তাই না! তাই একান্তই যদি মা না হয়ে উঠতে পারেন, একজন সহমর্মী বন্ধু তো হয়ে উঠতেই পারেন। ভাবতে হবে আপনি যখন বউমা ছিলেন তখন পরিবার থেকে, শ্বশুরবাড়ি থেকে, স্বামীর থেকে নিজে যে ব্যবহারটা, যে সমর্থনটা পাওয়ার আশা করতেন বা পেয়ে এসেছেন ঠিক সেই পরিবেশ, সেই রকম ব্যবহার বাড়িতে আসা নতুন সদস্যটিও আপনার থেকে আশা করতেই পারেন তাই না!
আরও পড়ুন-বাড়ছে ডিমের দাম বড়দিনের কেক বিক্রি নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন বেকারি মালিকেরা
বোঝাপড়াটাই আসল
এক পরিচিতের কাছে শোনা শাশুড়ি-বউমার সম্পর্কের অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতেই হয়, ‘শুনেছিলাম তাঁর শাশুড়িকে নাকি শ্বশুরমশাই একান্নবর্তী পরিবারে থাকা সত্ত্বেও তাঁর বিশেষ যত্ন নিতেন। একবার স্ত্রী খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি নাকি ঘরের দরজা বন্ধ করে বউকে দুধের মধ্যে কাঁচা ডিম মিশিয়ে এনে খাওয়াতেন। এছাড়াও স্ত্রী যখনই কিছু দেখে সুন্দর বলতেন তখনই সেটা কিনে দিতেন, তা সে শাড়ি হোক কী সোনার গহনা। এই কথাগুলো গর্ব করে শাশুড়ি সেই বউমাকে বলেছিলেন। কিন্তু সেই শাশুড়ি আবার যখন দেখতেন অফিস থেকে ফিরে ছেলে বউমাকে নিয়ে সাধারণ বাজারে যাচ্ছে, তখন সেটা তিনি মেনে নিতে পারতেন না, সেটা নিয়েও বউমাকে কথা শোনাতেন। ছেলে যদি বউয়ের কথা শুনে দুটো মশলার কৌটোও কিনে আনতন তা হলেও শাশুড়ির মুখ ভার হয়ে যেত।
আসলে শাশুড়ি-বউমা একসঙ্গে থাকেন কিংবা আলাদা থাকেন দুই ক্ষেত্রেই একে অপরকে বোঝা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়াটা অত্যন্ত জরুরি। একজনের সমস্যা হলে অন্যজনের সেই সমস্যার সমাধান করতে এগিয়ে আসা, তাকে সাহায্য করা খুব জরুরি। এতে সম্পর্ক গভীর হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা হয় না।
পুত্রবধূ প্রতিপক্ষ নয়
স্নেহের সন্তানটির প্রিয় মানুষটি তাঁর সমবয়সিও কোনও মেয়ে নন বা প্রতিপক্ষও নন সর্বোপরি তিনি সম্পূর্ণ অন্য সংস্কারে বড় হয়ে ওঠা একটি মানুষ। যার রুচি পছন্দ আপনার সঙ্গে নাও মিলতে পারে। নতুন সংসারে তারই তো বেশি অসুবিধে হওয়ার কথা! কারণ একরকম খাওয়াদাওয়া, রহনসহন থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম দিনযাপনে সে আজকে আপনার বাড়িতে। তাই সেই অসুবিধেটাকে উপলব্ধি করলেই অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়েই যায়। এটা কিন্তু নতুন বউমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একজন নতুন মানুষের সঙ্গে নতুন পরিবারে মানিয়ে নিতে তাঁকেও ধরতে হবে অনেকটা ধৈর্য। এর অবশ্য কিছু ব্যতিক্রমও আছে। অনেক বাড়িতেই দেখা যায় শাশুড়ি-মা সারাদিন মুখ বুজে সমস্ত কিছু করছেন, আর বউমা ঠিক বিয়ের আগের অবিবাহিত জীবনটি যাপন করছেন। এমনকী নিজের স্বামীর সব দায়-দায়িত্ব যত্ন-আত্তি শাশুড়ির কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নির্বিকার ভাবে ঘুরে বেড়ান। এক্ষেত্রে শাশুড়ি মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও সেটা বউমার কাছে প্রকাশ করেন না। এটাও ঠিক নয়। আসলে যে কোনও দায়িত্বহীনতায় সম্পর্কের রাশটাই আলগা হয়। পারস্পরিক দায়িত্ব নেওয়ার মানসিকতাই যে কোনও সম্পকর্কে সুন্দর করে তোলে।
আরও পড়ুন-জলজীবন মিশন প্রকল্প , বাঁকুড়ায় বৈঠকে সেচমন্ত্রী
বউমার নিন্দে করবেন না
এমন অনেক শাশুড়ি রয়েছেন যাঁরা তাঁর নিজের মেয়েদের কাছে বউমার নিন্দা করেন। এটা কিন্তু ঠিক নয়। কারণ আপনার কন্যাটিও হয়তো কারও পরিবারের বউ বা হয়তো আগামী দিনে কারও পরিবারের বউ হবে। তখন তাঁর শাশুড়িও যদি এইভাবেই আপনার সন্তানের নিন্দে করে আপনারই কিন্তু কষ্ট হবে— তাই না। আর সেই নিন্দে যদি আপনার পুত্রবধূর কানে যায় তাহলে সে হয়তো আপনার প্রতি আজীবনের মতো শ্রদ্ধা হারাবে। এতে সম্পর্কের মাধুর্যই নষ্ট হবে।
ছেলের চোখেও হয়তো আপনি ঠিক প্রতিপন্ন হবেন না।
পিতৃগৃহ ছেড়ে যে মেয়েটি স্বামীর সংসারে আসে তার সারাটা জীবন কাটানোর জন্য, তার প্রতি আন্তরিক হওয়াটা শাশুড়ির জন্য খুবই জরুরি। এমনটা তো অনেক সময়ই হয়েছে নিজের সন্তানের ছোটখাটো ভুল-ত্রুটি এড়িয়ে গেছেন, ক্ষমা করেছেন সংসারে শান্তি রাখতে আবার আদরে-আবদারে-শাসনে বুঝিয়েছেন কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। বউমাকেও তেমনটাই করুন না। বউমা না ভেবে সন্তান বা বন্ধু হিসেবে বুঝিয়ে দিন কোনটা উচিত এবং অনুচিত বা ঠিক অথবা ভুল তাহলেই দেখবেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে সম্পর্ক হয়ে উঠেছে মধুর।
তৃতীয় ব্যক্তিকে দূরেই রাখুন
শাশুড়ি বউমার অম্ল-মধুর সম্পর্কের মাঝে কাউকে আসতে দেবেন না যেন। পাড়া, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন এমনকী ছেলেকেও নয়। আর ঘরের ভেতরের কথা, বউমার সমালোচনাও করতে যাবে না। কারণ পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় কিছু না জেনে না বুঝেই ভেবে নেবে আপনার বউমাটি অতি-খারাপ এবং আপনাদের মুখ দেখাদেখি নেই। যত আলোচনা হবে তত ভুল কথা ছড়াবে। আবার ছেলেকে মাঝখানে রাখলে সে কোনও একপক্ষে যাবে, হয় মা নয় বউ। যার পক্ষে সে যাবে তার পোয়া বারো হলেও অপরজনের কাছে তা কষ্টের এবং অপমানের হতেই পারে— তাই না! তাই নিজেদের নোকঝোঁক নিজেদের মধ্যেই মিটিয়ে ফেলুন। একসঙ্গে বাসনেরা থাকলে একটু আওয়াজ তো হয়ই তাই অযথা গভীরে যাবেন না। এতে আপনার সম্পর্কটাই খারাপ থেকে অতি-খারাপের দিকে চলে যেতে পারে।
আরও পড়ুন-জয়েন্ট পরীক্ষার দিন ঘোষণা বোর্ডের
বাপের বাড়ি নিয়ে বিদ্রুপ করবেন না
বউমার সঙ্গে সম্পর্ক যেমনই হোক, তাঁর বাড়ি এবং বাবা মার প্রতি শ্রদ্ধা রাখাই বাঞ্ছনীয়। তাঁর সামনে পরিবারকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করলে বা খোঁটা দিলে তিক্ততা বাড়ে বই কমবে না। পুত্রবধূ চাকরিরতা। খাবার টেবিলে তার জন্য একটু অপেক্ষা করুন না। সপ্তাহান্তে আপনিও একদিন একটু বউমার সঙ্গে হেঁটে আসতেই পারেন। একে অপরের সুখ দুঃখ নিয়ে আলোচনা করতেই পারেন। সংসারের চেনা ছকের বাইরে শুধু দু’জন মানুষ হিসেবে পরস্পরকে চেনার সুযোগ দিন না। দেখুন সম্পর্কটা কেমন মিষ্টি হয়ে উঠেছে। বয়সে বড় হোক বা ছোট সম্মান দিলে তবেই সম্মান পাওয়া যায়, এটা কিন্তু ভুলবেন না। মতবিরোধ হতেই পারে তাহলে ঠান্ডামাথায় আলোচনা করে সমাধান করে ফেলুন। বউমার জন্মদিন অথবা বিবাহবার্ষিকীতে পায়েসটা রেঁধে খাওয়াতে ভুলবেন না। জন্মদিনের পায়েস আর বাপের বাড়ির সঙ্গে মেয়েদের অনেক সেন্টিমেন্ট জুড়ে থাকে। সপ্তাহে এক-দু’দিন শুধু তার পছন্দমতো মেনুগুলো রান্না করে খাওয়ান না। হাতে হাত মিলিয়ে গড়ে তুলুন এক চিরন্তন সম্পর্কের ভিত। এমনই সুন্দর হয়ে ওঠা একটি সংসারের গল্প দিয়েই শেষ হবে আজকের প্রতিবেদন।
বছর কয়েক আগে একজন শাশুড়ি তার একমাত্র ছেলের বিয়ে দিয়ে বউমাকে ঘরে এনেছেন। বউমা বললে ভুল হবে, তিনি তাকে মেয়েই বলেন। তাঁর সব কাজের সঙ্গী হলেন সেই বউমা। বেড়াতে যাওয়া থেকে শুরু করে, হোটেলে খেতে যাওয়া, শপিং করা, দু’জন দু’জনের জন্মদিন অথবা বিবাহবার্ষিকী মনে করে পালন করা, সবকিছুই তাঁরা একসঙ্গে করেন। আবার বউমার গুণগুলোকেও জনসমক্ষে তুলে ধরেন সেই শাশুড়ি। তাঁদের দেখলে মনে হয় না তাঁরা শাশুড়ি-বউমা। তাঁরা দু’জন দু’জনের বন্ধু, ক্রাইম ইন পার্টনার।
আমাদের দেশের সব শাশুড়িই যদি এমন হন তাহলে অচিরেই এই শাশুড়ি-বউমার চিরকালীন দ্বন্দ্ব থেকে সমাজ মুক্ত হবে।