দেবর্ষি মজুমদার, রামপুরহাট: সচরাচর হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি পশ্চিম মুখে অধিষ্ঠিত হয় না। কিন্তু রামপুরহাটের কাছে ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী দুমকা জেলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম মলুটিতে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। এখানকার নানকার রাজবাড়ির কালীপুজোর জগৎজোড়া নাম। চারিদিকে শাল-মহুলের জঙ্গলের মধ্যে মা তারার দিদি হিসেবে পূজিতা মা মৌলিক্ষা। মৌলি অর্থাৎ শিরোভাগ দেখা যায়, তাই তিনি মা মৌলিক্ষা। জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ছোট্ট পাহাড়ি ঝর্না। তার পশ্চিমে উচ্চভূমিতে মায়ের মন্দির।
আরও পড়ুন-মরক্কোর কাশবা টাওয়ার বারাসতের পাইওনিয়ারে
নানকার রাজ পরিবারের সদস্য, মা মৌলিক্ষা মন্দির কমিটির সেবায়েত বন্যেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘বর্তমানে রাজবাড়ি ৮ শরিকে বিভক্ত। প্রত্যেকের বাড়ি কালীপুজো হয়। সেগুলি হল ছয় তরফ, রাজার বাড়ি, মধ্যম বাড়ি, শিকি বাড়ি, চৌকি বাড়ি। এছাড়াও শ্মশানকালীর পুজোও হয়। বিকেলে এক সঙ্গে ৮টি কালীকে নাচাতে নাচাতে মা মৌলিক্ষাকে প্রদক্ষিণ করা হয়। তারপর সব কালীকে এক জায়গায় রাখা হয়। প্রত্যেক শরিকের নিজস্ব পুকুরে নিরঞ্জন হয়। মধ্যম বাড়ির কালী বিসর্জন হয় বুড়োর পুকুরে। ছয় তরফের মানিকচাঁদ পুকুরে এবং রাজবাড়ির দিঘিতে। পুজো উপলক্ষে ৭ দিন মেলা চলে। বিদেশে কর্মরত এখানকার মানুষও পুজোয় গ্রামে আসেন।
আরও পড়ুন-পঞ্চায়েতরাজের ত্রিস্তরে আসনবৃদ্ধি
দুর্গাপুজোয় নয়, জাঁকজমক হয় কালীপুজোয়।’ মন্দির কমিটির সদস্য গৌতম চট্টোপাধ্যায় জানান, মা মৌলিক্ষার মন্দিরে পাঁচশো বছর আগে বামাখ্যাপা দু’বছর মায়ের পুজোর ফুল তোলার কাজ করেন। জানা যায় এই মূর্তি খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর বৌদ্ধতান্ত্রিক শৈলীর। আগে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের অধীন ছিল এই অঞ্চল। তার থেকেই মলুটি নাম। অধুনা মল্লারপুরের শাসক কামাল খাঁর অতর্কিত আক্রমণে মলুটির রাজা রাজচন্দ্র নিহত হওয়ার পর তাঁর বড়ছেলে রাখড়চন্দ্র রাজ পরিবারের পুরোহিত দণ্ডিস্বামীর সঙ্গে মলুটির জঙ্গলে প্রবেশ করে ভগ্নপ্রায় এক মন্দিরে পাথরের মূর্তি আবিষ্কার করেন। সেখানেই নগর পত্তন করেন। রাজবাড়ির বংশধরেরাই আজও পুজো চালিয়ে আসছেন। এখানেই সম্রাট শাহজাহান তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁবু পেতেছিলেন। সেই সময় নানকর রাজবংশের একজন নাকি সম্রাটের হারিয়ে যাওয়া প্রিয় বাজপাখি ফেরত দিয়েছিলেন সম্রাটকে। বিনিময়ে এই তালুকের পাকাপাকি শাসনভার পান। ‘বাজের বদলে রাজ’ এই গল্পকাহিনি আজও অঞ্চলের লোকমুখে ফেরে।