দৃষ্টান্তমূলক চিকিৎসার নজর রাখল মুর্শিদাবাদ জেলার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

Must read

এতদিন বিরল রোগের চিকিৎসা বা জটিল অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে শুধু কলকাতার নামী সরকারি হাসপাতালগুলোর কথাই শোনা গেছে কিন্তু এখন জেলা হাসপাতালগুলোও আর পিছিয়ে নেই। এ রাজ্যে মুর্শিদাবাদ জেলার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল রাখল তারই স্বাক্ষর। এই হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন। যার পুরোভাগে ছিলেন ” ইএনটি অ্যান্ড হেড নেক সার্জারির বিভাগীয় প্রধান ডাক্তার গৌতম বিশ্বাস”। তিনি বললেন, ‘একটা সময় ইএনটি বা নাক-কান-গলার বিষয়টা মানুষের কাছে খুব অস্পষ্ট ছিল। ইএনটি ডাক্তার মানে সাধারণের ধারণা ছিল ,তাঁরা টনসিল কাটেন ,নাক কানে ওয়াশ করেন, কানের পর্দা লাগান আর যাঁরা এর চেয়ে একটু বেশি জানেন , তাঁরা জানতেন যে ইএনটি ডাক্তার নাকের হাড় সোজা করেন। আসলে ইএনটি অ্যান্ড হেড নেক সার্জারি পুরোটাই হল ‘বেস অফ দ্য স্কালের’ সার্জারি। মাথার নীচের অংশ যেখান থেকে নার্ভগুলো বেরিয়েছে সেই পুরো অংশটাই কিন্তু এখন ইএনটির আন্ডারে চলে এসছে। ইএনটি সার্জেনরাই এগুলো করেন’।

এর জন্য প্রচুর দামি , সূক্ষ্ম, ইন্সট্রুমেন্ট বা যন্ত্রপাতি লাগে। যেটা দশ বছর আগেও এই হাসপাতালে ছিলনা। বেশিরভাগ জটিল কেস এলে কলকাতায় রেফার করতে হত। কারণ মুর্শিদাবাদ জনবহুল একটি জেলা এবং হেন কোনও রোগ নেই যা এখানে দেখা যায় না। কিন্তু পরিকাঠামোর অভাবে গুরুতর রোগের চিকিৎসার জন্য রোগীকে কলকাতায় নেওয়া ছাড়া উপায় থাকত না । কিন্তু দিন বদলেছে । নতুন সরকার আসার পর পরিকাঠামোর উন্নতি হয়েছে সেই সঙ্গে বদলেছে জেলাস্তরের চিকিৎসা পরিষেবার মানচিত্র’।

আরও পড়ুন-বিজেপি প্রার্থীকে দেখে “জয় বাংলা” স্লোগান তৃণমূলের,’গণতান্ত্রিক অধিকার’ জানালেন ফিরহাদ হাকিম

আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে ডাক্তার গৌতম বিশ্বাস মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইএনটি বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার পর চেয়েছিলেন যাতে কিছু জটিল অস্ত্রোপচার ওখানেই শুরু করা যায়। এতে অন্তত কিছু মানুষের সমস্যার সমাধান হবে । যদিও বর্তমানে অনেক অনেক জটিল অপারেশন সাফল্য পাচ্ছে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ইএনটি অ্যান্ড হেড নেক সার্জারি বিভাগ এবং হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট ডাক্তার গৌতম বিশ্বাস এই সাফল্যর অন্যতম কান্ডারী বলা যেতে পারে।

রানীনগর থানার , কালীনগর গ্রামের বাসিন্দা শেফালি খাতুনের চারমাসের পুত্র আহমেদ আলি। ২৭ দিন যখন তাঁর বয়স, সে একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়। শিশুটি খাট থেকে পড়ে যায়। যেটি পরিবারের লোকজন প্রথমে বলতে চায়নি। কারণ তাঁদের আর্থসামাজিক পরিস্হিতি। শেফালি খাতুনের মা খুব কান্নাকাটি করে যাতে কেউ জানতে না পারে। কারণ মেয়ের শ্বশুরবাড়ি জানতে পারলে মেয়েকে আর হয়ত ঘরেই তুলবে না। মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত এলাকায় এমন ঘটনা আকছার ঘটতে দেখা যায়।খাট থেকে পড়ে গিয়ে শিশুটির একদিকের চোখ ফুলে যায় এবং হেড ইনজুরিও ছিল। শিশুটি সারাদিন কাঁদত । ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল।

আরও পড়ুন-পরীক্ষামূলক ভাবে শুরু করা হল “দুয়ারে রেশন”, পাইলট প্রকল্পে থাকছে ১৫ শতাংশ ডিলার

বাচ্চাটি ওই ২৭ দিন বয়সেই হেড ইনজুরি নিয়ে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে এসেছিল। তখন তার একটু শ্বাসকষ্টও ছিল এবং এমআর আই করে দেখা যায় সেরিব্রাল অ্যানক্সিয়ার জন্য শিশুটির ব্রেনের কিছু অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। সেরিব্রাল অ্যানক্সিয়া মানে অক্সিজেন ঠিকমত ব্রেন অবধি পৌছতে পারেনা। এই অবস্থায় শিশুটিকে কলকাতায় একটি নামী সরকারি হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগে রেফার করে দেওয়া হয়। তাঁর পরিবার কলকাতায় আসে। চিকিৎসা চলে। অনেকটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল এবং আর্থিক কারণেও অতদিন ধরে কলকাতায় থাকা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। কাজেই আবার ফিরে যায় তাঁরা। চোখের ফোলাভাব সম্পূর্ণ না কমার কারণে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজেরই শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ভোলানাথ আইচের কাছে আবার শিশুটিকে দেখানো হয় । ডাঃ আইচের ওষুধে সে খানিকটা সুস্থ হয় । ফোলা অনেকটাই কমে যায়। কিন্তু কিছুদিন পর থেকে চোখের তলা দিয়ে পুঁজ বেরোতে শুরু করে। দেখা গেল অয়েনমেন্ট বা ওষুধ দিলে পুঁজ কমে যাচ্ছে আবার দেওয়া বন্ধ হলেই পুঁজ বেরোচ্ছে । তখন এটির অপারেশনের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে বাচ্চাটিকে চক্ষু বিভাগে রেফার করেন ডাঃ আইচ । ঐ বিভাগের আরএমও ডাঃ প্রণব শিকদার রোগীকে দেখে বুঝতে পারেন ইএনটির সহায়তা ছাড়া এই অস্ত্রোপচার সম্ভব নয়। কারণ আমাদের চোখের চারপাশে ,কপালে, নাকের পাশে এয়ার সাইনাস থাকে । ইনফেকশন এই সাইনাসগুলোতে হলে ইএনটির প্রয়োজন পড়ে । তখন ইএনটি বিভাগের হেড ডাঃ গৌতম বিশ্বাস এই দায়িত্ব নেন। এই সময় শিশুটির বয়স চারমাস। তিনি তখন বাচ্চাটির রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখেন কোনও ফরেন বডি ওই শিশুটির চোখে ঢুকে রয়েছে যাঁর কারণে সংক্রমণ কিছুতেই সারছেনা। সিটি স্ক্যান , এমআরআই আগেই করা ছিল । সেই রিপোর্টগুলোর উপর ভিত্তি করেই অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নেন ডাঃ গৌতম বিশ্বাস।

আরও পড়ুন-বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিবসে অভিষেকের বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য

কিন্তু এখানেও বড় ঝুঁকি ছিল কারণ বাচ্চাদের অ্যানাসথেশিয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রচুর জটিলতা হয় । অজ্ঞান করার সময় রোগীর গলা দিয়ে একটা এন্ডোট্র্যাকিয়াল টিউব ঢোকানো হয় । এই টিউব দিয়ে বাইরে থেকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। যাতে অপারেশন চলাকালীন রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস ঠিকমতো চলে।বাচ্চাদের শ্বাসনালী খুব সরু তাই অজ্ঞান করার পর টিউবটা বের করে নিলে শ্বাসনালী ফুলে যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে জায়গাটা সরু হবার জন্য শ্বাসনালী ফুলে ট্র্যাক্টটা বন্ধ হয়ে যায়। মেডিক্যাল পরিভাষায় যাকে বলে ল্যারিংগোস্প্যাজম । এতে শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এমনটা ঘটেনি কারণ অ্যানাসথেশিয়া বিভাগের ডাক্তার তপোব্রত মিত্র এবং হাবিবুল রহমান এই গুরুভার বহন করেন। না হলে এই অসাধ্যসাধন অসম্ভব ছিল। অপারেশন করে দেখা যায় শিশুটির চোখের কোটরের ভিতরে একটা পচাগলা ফরেনবডি জমে রয়েছে। প্রায় দেড় ঘন্টার অস্ত্রোপচারের পর সেটা বের করেন ডাঃ গৌতম বিশ্বাস । তাঁকে সহায়তা করেছেন ডাক্তার প্রণব শিকদার। এরপর শিশুটিকে কিছুদিন চিকিৎসাধীন রেখে সুস্থ করে ছেড়ে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন-দেশের সবচেয়ে নিরাপদ শহর কলকাতা, জানাচ্ছে কেন্দ্রের এনসিআরবি রিপোর্ট

এমন সাফল্য বিরল , কিন্তু ডাক্তার গৌতম বিশ্বাস মনে করেন, রোগটা বড় কথা নয় রোগের পিছনের কারণটা খুব গুরুত্বপূর্ণ । অনেক রোগের ক্ষেত্রে রোগীর সামাজিক অবস্থানটা একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে যায় ।গ্রামীণ প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে।এর প্রধান কারণ নিরক্ষরতা ,অর্থনৈতিক দূরাবস্থা ।এই সব অঞ্চলের মেয়েরা স্কুল ড্রপ আউট হয় । আর্থিক চাপ মুক্ত হতে নাবালিকা বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেন বাবা মা। ফলে তাঁদের মাতৃত্বের বয়স খুব বেশি হলে চোদ্দ কি পনেরো ।স্বাভাবিকভাবেই সেই মা কখনোই একটা সুস্থ বাচ্চার জন্ম দিতে পারেনা এবং ঠিকঠাক দেখভাল করতে পারেনা। সেই জন্ম দেওয়া বাচ্চারও যোঝবার ক্ষমতা থাকেনা। সেও রুগ্ন, অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগে এবং অযত্নে বড় হয়। আহমেদ আলিও এই রকম পরিস্হিতির শিকার একটি শিশু।
যদিও আমাদের রাজ্য সরকার এই রাজ্যের নারী পুরুষ, মহিলা , ছাত্রছাত্রীদের নির্বিশেষে সবার উন্নতিকল্পে নানা প্রকল্প শুরু করেছেন । কন্যাশ্রী, রূপশ্রী , সবুজসাথী,স্বনির্ভর প্রকল্প ইত্যাদি আরও অনেক প্রকল্পের উদ্দেশ্য একটাই মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দিয়ে যাতে বাবা মায়েরা দায়মুক্ত হতে না চান। যাতে ছেলে মেয়ে উভয়েই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে । সরকারের এই উদ্যোগে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে কিন্তু আরও বদলের প্রয়োজন রয়েছে

পরিষেবা:
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইএনটি আউটডোর বিভাগটি সোম থেকে শনি দুপুর দুটো অবধি এবং ইমার্জেন্সি সাতদিনই চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকে পরিষেবা দেওয়ার জন্য।কোভিড পরিস্থিতির আগে বছরের এপ্রিল-মে মাসে দিনে গড়ে সাতশো থেকে আটশো রোগী আসত , এখন চারশো রোগী আসে রোজ । সপ্তাহে চারদিন পরিকল্পিত সার্জারির জন্য নির্দিষ্ট । ডিপার্টমেন্টে ২৪ ঘন্টা একজন করে ডাক্তার অন কল ডিউটিতে থাকেন। ইএনটির ইমার্জেন্সিতে খুব সমস্যাজনক কেস আসে যেমন- শিশুদের খাদ্যনালীতে ফরেন বডি যেমন পয়সা , ওষুধের বোতলের ছিপি। নাকদিয়ে রক্ত পড়া আর একটি বড় সমস্যা। বয়স্ক মানুষেরা অনেকেই শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে আসেন যাতে ইমার্জেন্সি ট্র্যাকিয়োস্টমি করতে হয়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে মুখের বাঁধানো দাঁত খাদ্যনালীতে গিয়ে আটকে যাওয়ার সমস্যা নিয়েও অনেকে আসেন। মুর্শিদাবাদ দুর্ঘটনাপ্রবণ হওয়ার জন্য ফেসিয়াল ইনজুরি নিয়েও প্রচুর রোগী আসেন। অডিওভেস্টিবুলার ক্লিনিক থাকার জন্য এখানে হিয়ারিং টেস্ট হয়। বাচ্চার জন্মের পর পরই সে ঠিকঠাক শুনতে পাচ্ছে কিনা তা বোঝার জন্য নিওনেটাল হিয়ারিং স্ক্রিনিং করা হয়। মেডিক্যাল কলেজ হওয়ার জন্য প্রতি বছর একশো পঁচিশ জন ডাক্তারী ছাত্রছাত্রীদের পঠনপাঠনের দায়িত্বও এই বিভাগের।

Latest article