ভরা বসন্ত। ফুটেছে নানা রঙের ফুল। পলাশ দেখার টানে বেরিয়ে পড়েছেন বহু মানুষ। পুরুলিয়া, বীরভূম, ঝাড়গ্রামের পাশাপাশি বাঁকুড়া জেলার আনাচে-কানাচে চোখে পড়ে পলাশের সমারোহ। জঙ্গল, পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে আগুন-রূপ। ফলে রাঙা মাটির দেশে দেখা যায় পর্যটকের ভিড়। বাঁকুড়ার (Bankura) কোথায় কোথায় বেশিমাত্রায় চোখে পড়ে পলাশ সৌন্দর্য, দেখে নেওয়া যাক।
অন্যতম গন্তব্য বিহারীনাথ। বাঁকুড়ার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। উচ্চতা ১৪৫০ ফুট। পূর্বঘাট পর্বতমালার অংশ। তীর্থ হিসাবে বিহারীনাথ ধামের গুরুত্ব যথেষ্ট। এখানেই রয়েছে বিহারীনাথ মন্দির। পূজিত হন দেবাদিদেব মহাদেব। পাহাড়ের গায়ে ফুটন্ত পলাশের চোখজুড়ানো রূপ উপভোগে বেরিয়ে পড়া যায়। ঠা-ঠা রোদে পাহাড় চড়তে একটু কষ্ট হবে বটে। তবে সেখান থেকে পলাশের সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি উপভোগ্য হয়ে উঠবে। বাঁকুড়া শহর থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে শালতোড়া গ্রাম। সেখান থেকেই যেতে হয় বিহারীনাথ।
বাঁকুড়ার (Bankura) দ্বিতীয় উচ্চতম পাহাড় শুশুনিয়া। এই পাহাড় যে শুধু পর্যটনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা নয়। জীববৈচিত্রের দিক থেকেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। হাজার হাজার প্রজাতির গাছ, লতা ছাড়াও অসংখ্য সরীসৃপ, বিভিন্ন প্রাণীর বসবাস এখানে। শুশুনিয়া পাহাড়ের উত্তর ঢালে পাথরের গায়ে খোদিত রয়েছে লিপিমালা। লিপিটি খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে খোদিত। সেখান থেকেই রাজা চন্দ্রবর্মার নাম পাওয়া যায়। পাহাড়ের মাথায় রয়েছে নরসিমা মন্দির। বসন্তের ছোঁয়ায় বদলে যায় শুশুনিয়াও। পাহাড়ের বুকে ইতিউতি গজিয়ে থাকা পলাশের গাছ ভরে ওঠে ফুলে। তাকালেই চোখের আরাম।
বাঁকুড়ার (Bankura) রানিবাঁধ থেকে ঝিলিমিলি যাওয়ার পথে রয়েছে বারো মাইলের জঙ্গল। এলাকাতেই রয়েছে সুতান গ্রাম। তাই এই জায়গা সুতানের জঙ্গল নামে পরিচিত। বারো মাইল জঙ্গলের এক দিকে ঝাড়গ্রামের কাঁকড়াঝোড় ও বেলপাহাড়ির জঙ্গল এবং অন্য দিকে পুরুলিয়ার কুইলাপালের জঙ্গল। জঙ্গলের রূপ উপভোগ্য হয়ে ওঠে দুই মরশুমে। বর্ষা আর বসন্তে। শাল, সেগুনের জঙ্গল বর্ষায় হয়ে ওঠে ঘন সবুজ। আর বসন্তে জঙ্গলকে রঙিন করে তোলে পলাশ। কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। বিষ্ণুপুর থেকে এক দিনে ঘুরে নেওয়া যায়।
বাঁকুড়ার বড়জোড়া ব্লকের বৃন্দাবনপুর ইদানীং উৎসাহী পর্যটকদের দৌলতে জায়গা করে নিচ্ছে পর্যটন মানচিত্রে। জঙ্গলঘেরা গ্রামে পর্যটকদের জন্য তৈরি হয়েছে একটি পরিবেশবান্ধব আস্তানাও। দেখার জায়গা বলতে শুধুই প্রকৃতি। শাল, সেগুনের বন। বসন্তে এই জঙ্গলের রূপ বদলায় পলাশ ফুটলে। কাছেই রয়েছে সোনামুখী-পাথরা নজরমিনার। সেখান থেকে দূরদূরান্ত পর্যন্ত জঙ্গলের রূপ উপভোগ করা যায়। এছাড়া দেখে নেওয়া যায় বিষ্ণুপুর দুর্গের ভগ্নাবশেষ। গাড়ি নিয়ে ঘুরে আসা যায় টেরাকোটা শিল্পের জন্য বিখ্যাত বিষ্ণুপুর মদনমোহন মন্দির, রাধামাধব মন্দির, গড় দরওয়াজা, রাসমঞ্চ।
আরও পড়ুন-বিখ্যাত হতে নয়, মানুষের আত্মার অন্বেষণে থিয়েটার
বেলিয়াতোড় জঙ্গল কলকাতা থেকে ঘণ্টা পাঁচ-ছয়েকের পথ। বাঁকুড়া শহর থেকে দূরত্ব ২০ কিলোমিটারের মতো। বেলিয়াতোড় একটি শহর। তবে এখানে রয়েছে ঘন জঙ্গলও। বসন্তে যদি বেলিয়াতোড়, সোনামুখীর জঙ্গলপথের যাত্রী হন, তবে নজরে পড়বে রাশি রাশি পলাশ। বেলিয়াতোড়ে থাকার জন্য অতিথি নিবাস রয়েছে। সেখানে রাত্রিযাপন করেও বসন্তের প্রকৃতি উপভোগ করা যায়।
খাতড়া মহকুমার মুকুটমণিপুরের কংসাবতী জলাধার দেখতে সারা বছর পর্যটক আসেন। রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে। তবে বসন্তকালে শুধু জলাধার দেখতে নয়, পলাশ ফুল দেখতেও আসেন পর্যটকরা। শীতকালে সরষের খেত দেখলে পর্যটকেরা যেমন গাড়ি থামান, একটু ছবি তোলেন, তেমনই পলাশ ফুল দেখলেও রোম্যান্টিক হয়ে পড়েন। জল, জঙ্গল, টিলা পরিবেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করেন। খাতড়া মহকুমার রানিবাঁধ ব্লকে প্রতি বছর পলাশ ফুলের সমারোহ দেখা যায় যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
ঘুরে আসা যায় জয়পুর জঙ্গল। শালের বনের পাশাপাশি দেখা যায় পলাশ সৌন্দর্য। জঙ্গলের বুনোগন্ধ মেখে, পাখির ডাক শুনে, গা-ছমছমে পরিবেশে সবুজ অরণ্যের অন্দরে একটা বেলা কাটানো যায়। জঙ্গলের মাঝে আবার ইতিহাসের ছোঁয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত একটি পরিত্যক্ত এয়ার ফিল্ডের রানওয়ে রয়েছে। জঙ্গলের বাইরে গোকুলনগর গ্রামে রয়েছে প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো পাথরের ঐতিহাসিক গোকুলচাঁদ মন্দির। রাঢ় বাংলার মল্ল রাজত্বের আমলে মাকড়া পাথরে নির্মিত। এটাই বাঁকুড়া জেলার বৃহত্তম পাথরের মন্দির। চারপাশে শস্যখেত। চোখ মেললে শুধুই পলাশ আর পলাশ। মা সারদার জন্মস্থান জয়রামবাটি খুব দূরে নয়। ঘুরে আসা যায়। যেখানেই যাবেন, নানা রঙের পলাশ হবে সঙ্গী। আছে আরও দর্শনীয় স্থান। সবমিলিয়ে বসন্তদিনে বাঁকুড়া ভ্রমণ মনের মধ্যে অদ্ভুত আনন্দের জন্ম দেবে।
কীভাবে যাবেন?
হাওড়া থেকে ট্রেনে বাঁকুড়া অথবা বিষ্ণুপুর। সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া যায়। বাস অথবা ভাড়া গাড়িতে। কলকাতা থেকে টানা গাড়িতেও যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন?
বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর-সহ বিভিন্ন জায়গায় আছে বেশকিছু হোটেল, গেস্ট হাউস। ফলে থাকা-খাওয়ার কোনও অসুবিধা হবে না। আগে থেকে বুকিং করে গেলেই ভাল।