জয় জগন্নাথ বলো দিঘায় চলো

বিতর্কটা চলছে। রাজনৈতিক কারণে। এবং অযৌক্তিক জ্ঞানহীনতার সৌজন্যে। গদ্দার কুলের পোদ্দার অধিকারী প্রচার করার চেষ্টা করছেন জগন্নাথধাম কেবল পুরীই এবং দিঘার জগন্নাথধামের যে প্রসাদ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, সেটা নাকি মহাপ্রসাদ নয়, নিছক মিষ্টান্ন। এই সব বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারের জবাব দিচ্ছেন দেবাশিস পাঠক

Must read

পুরীর বাইরে জগন্নাথের (Digha Jagannath Mandir) আবাস বা ধাম হিসেবে পরিচিত হতে পারে নাকি পারে না? যে পদ্ধতিতে দিঘার প্রসাদ বিতরণ করার পরিকল্পনা হয়েছে, তাতে বিতরিত সামগ্রী প্রসাদ থাকছে না নিছক মিষ্টান্নে পরিণত হচ্ছে?
প্রথমেই জানিয়ে রাখা যাক, পুরীর জগন্নাথ (Digha Jagannath Mandir) বিগ্রহ পুরীর মন্দিরে বহুবার থেকেছেন, আর তাঁর আবাস মহাপ্রভু জগন্নাথের লীলাধামের গৌরবে গরিবন্বিত হয়েছে।
কলিতে নয়, সত্যযুগে পুরীর শ্রীমন্দিরে নয়, নীল অদ্রিতে বিরাজ করতেন জগন্নাথদেব। তখন তিনি পরিচিত ছিলেন জগন্নাথদেব নামে নয়, নীল মাধব রূপে। আনুমানিক ৪১০ খ্রিস্টাব্দে পুরীতে গিয়েছিলেন আদি শঙ্করাচার্য। দর্শন পাননি জগন্নাথের। রক্তবাহুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য তখন শ্রীমন্দির থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল জগন্নাথদেবকে।
১৫১০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীক্ষেত্রে প্রথম আসেন মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। তিনিও দেখতে পাননি জগন্নাথদেবকে শ্রীমন্দিরে। কারণ, ইসমাইল গাজির আক্রমণের থেকে রক্ষা করার জন্য তখন জগন্নাথদেব, বলভদ্রদেব ও দেবী সুভদ্রাকে সরিয়ে নিয়ে রাখা হয়েছিল চিল্কা হ্রদের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত চড়েইগুহা পাহাড়ে।
ঠিক যেমন করে রক্তবাহুর আক্রমণের সময় দেবত্রয়ীকে সরিয়ে ফেলেছিলেন শোভনদেব (৩১৮-৩২৩ খ্রিঃ) বা শুভকরদেব (৭৮০-৮০০ খ্রিঃ)। প্রথমে পুরী সদরের কাছে ভার্গবী নদীর দেবেন্ধ ঘাট থেকে নৌকায় চাপিয়ে বিগ্রহ ত্রয়কে আনা হয়েছিল সোনাপুরের কোট সামালাইতে। তারপর মহানদীর উপনদী হরিহরণ ধরে ছালিয়া পাহাড়ের পাদদেশে। সেখানে নাকি জগন্নাথদেব অজ্ঞাতবাসে কাটিয়েছিলেন মাটির তলায় কমবেশি ৪৫ বছর। পরবর্তী ৯৯ বছরের কোনও সময় গোপপল্লির পাতালি গুহাকন্দরে, আবার কোনও সময় বৃক্ষমূলে। এবারও সেই একই পন্থা অবলম্বন করে গোপনবাসে পাঠানো হয়েছিল জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাকে।
এরপর ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে চিল্কার চড়েইগুহায়, ১৫৬৮তে ওই চিল্কার হাতিপাড়ায়, ১৬০১-এ কপিলেশ্বরপুরের পঞ্চমুখী গোসানী মন্দিরে আশ্রয় নেওয়ার জন্য এখান থেকেই গোপনে জলযাত্রা করেছিলেন জগন্নাথ। এভাবে অন্তত ১০ বার জগন্নাথদেবকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে এই ঘাট থেকেই গোপন জলযাত্রায় পাঠানো হয়েছিল। একাধিকবার শ্রীক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তনও করেছিলেন এই ঘাট দিয়েই। —তার মানে, জগন্নাথ বহুবার স্থান বদলেছেন। ‘ধাম’ মানে ‘আবাসস্থল’। সেই হিসেবে, জগন্নাথ তাঁর ধাম বদলেছেন নানা সময়ে। সুতরাং কালান্তরে বঙ্গের দিঘার জগন্নাথধামের গৌরব অর্জনে কোনও বাধা নেই। আপত্তি থাকতে পারে না। যৌক্তিক ও ঐতিহাসিক কারণেই।
প্রসাদ প্রসঙ্গেও যুক্তি, ইতিহাস তো আছেই। তার সঙ্গে জুড়ে আছে শাস্ত্র বাণী। জগন্নাথদেবের প্রসাদ মহাপ্রসাদ। আর মহাপ্রসাদ মহাপ্রসাদই। কারও ছোঁয়ায় সে প্রসাদ অপবিত্র হয়ে যায় না। দূষিত হয় না। এই প্রসাদ গ্রহণ করলে ভক্ত মায়াকেও জয় করতে পারেন। একথা বলেছেন উদ্ধব শ্রীমদ্ ভাগবতে। জগন্নাথদেবের প্রসাদের একটা কণাও যদি মেশানো হয় অন্য কোনও খাবারে, তবে সেই সাধারণ খাবারও পরিণত হয় মহাপ্রসাদে। এমনই বিশ্বাস ভক্তজনের। সুতরাং, দিঘার প্রসাদ নিয়ে আপত্তি অযৌক্তিক।
এও হল সেই সময়ের কথা যখন আদি শঙ্করাচার্য সোনপুর থেকে দিব্যত্রয়ীকে ফিরিয়ে আনলেন রত্নবেদীতে। প্রায় দেড়শো বছর শ্রীমন্দিরের তাবৎ উৎসব অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল। তারপর আদি শঙ্করাচার্য এলেন শ্রীক্ষেত্রে। উদ্ধার করলেন ব্রহ্মবস্তু। নবকলেবরের বিধান দিলেন। পুনঃ সঞ্জীবিত হল শ্রীক্ষেত্রের উৎসব আয়োজন শাস্ত্রবিধি মেনেই।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে দিঘার হোটেলে ঝোলানো হল ভাড়ার তালিকা

ঘটনাটা ঘটেছিল সেদিন যেদিন প্রথম ভোগ নিবেদন করা হল দিব্যত্রয়ীকে।
শঙ্করাচার্য বিধান দিয়েছিলেন, মহাপ্রসাদ গর্ভগৃহ থেকে বের হওয়ার পর সবাই একসঙ্গে পঙ্‌ক্তি ভোজনে মহাপ্রসাদ গ্রহণ করবেন। কিন্তু মহাপ্রসাদ বের হওয়ার পর দেখা গেল, পঙ্‌ক্তি ভোজনের জন্য কেউ উপস্থিত নেই শ্রীমন্দিরে।
কেন? কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল জাতপাতের অহং বিভেদের পাঁচিল তুলেছে মানুষের মাঝে। সাধুসন্তরা গৃহীদের সঙ্গে এক পঙ্‌ক্তিতে বসতে নারাজ। ব্রাহ্মণ সেবকরা শূদ্রদের সঙ্গে এক পঙ্‌ক্তিতে বসে অন্নপ্রসাদ গ্রহণে কুণ্ঠিত। দুই প্রজন্ম ধরে মানুষ পুরীর মন্দিরে মহাপ্রসাদ গ্রহণের পরম্পরা প্রত্যক্ষ করেনি। তাই তারা ঐতিহ্য বিস্মৃত হয়েছে। পুরনো পরম্পরায় শামিল হতে রাজি নয়। মহারাজ যযাতি কেশরী ভেঙে পড়লেন। রাতে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করলেন জগন্নাথদেবের কাছে।
পরদিন আবার ভোগ বসল উনুনে। ভোগ নামলও উনুন থেকে। মানুষের ভিড়ে উঠল মহাভোগ গ্রহণের পরম্পরার প্রসঙ্গ। একদল সদ্য তৈরি হওয়া ভোগকে মহাপ্রসাদ বলে মেনে নিয়ে পঙ্‌ক্তি ভোজনে সম্মত হলেন। আর একদল বলল, পঙ্‌ক্তি ভোজনে অংশ নেওয়ার আগে দেখে নেওয়া দরকার, এটাই আসলে মহাভোগ কি না। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন একজন বোবা ব্রাহ্মণপুত্র। তাঁকে ডেকে ভোগ পরিবেশন করা হল। ঠিক হল, ওই মূক ব্রাহ্মণ যদি প্রসাদ গ্রহণের পর মুখর হন, তবেই সবাই মেনে নেবে, এটাই মহাপ্রসাদ। যদি মহাপ্রসাদ বলে প্রমাণিত হয়, তবে জাতি বর্ণ নির্বিশেষে এক পঙ্‌ক্তিতে বসে অবঢ়া খাবে সবাই। ডাল, তরকারি, ব্যঞ্জন-সহ অন্ন মহাপ্রসাদ হল অবঢ়া।
রাজার আদেশে ওই মূক ব্রাহ্মণপুত্র অবঢ়া খেলেন। খাওয়া শেষ হলে হাত মুছলেন মাথায়। তারপর সাধুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, অরে বিদ্বন্মন্যনিনধিগত বেদার্থনিগমান। ময়া ভুংক্তেপান্নে মম পরিজনৈচ্ছদ্মমনুজৈঃ। হে জ্ঞানীগণ! বেদের অর্থ না বুঝেই আপনার এত আত্মাভিমানী! সুম্নিগপন্নেতস্মিন ভবতুভবতাং ন বহুগুনা। ন গঙ্গাত্মঃ পেয়ং শবতনুগলদ্রব্য কলিলম।। গলিত মাংসের খণ্ড গঙ্গার মিশে গেলে গঙ্গাবারি যেমন অপবিত্র হয় না, পবিত্রই থাকে, তেমনই মহাপ্রভুর মহাপ্রসাদও সদা পবিত্র। এনিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। মূক মুখর হল মহাপ্রসাদের সৌজন্যে। সেই মুখরের কথায় সবাই সচকিত হল। সকলে মহাপ্রসাদ গ্রহণ করলেন এক পঙ্‌ক্তিতে বসে।
বড় দেউলে জগন্নাথ দর্শনে চলেছেন অহিছত্র রাজা। পথে দেখলেন এক অদ্ভুত দৃশ্য। কুকুরের এঁটো নির্দ্বিধায় খাচ্ছে একজন লোক। তাঁর মুখেচোখে ন্যূনতম বিকার নেই। দৃশ্যটা দেখে ঘৃণায় গা-টা রি রি করে উঠল রাজার। রাজাকে দেখে এগিয়ে এলেন এক পরিচিত পূজারি। রাজাকে বললেন, এই অন্ন আসলে মহাপ্রসাদ। কুকুর খেলেও তা উচ্ছিষ্ট হয় না, পূত প্রসাদই থাকে। শুনে রাজার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল একটাই কথা, ছিঃ! তখনই চোখে পড়ল আর একটা দৃশ্য। একজন কুষ্ঠ রোগী ভোগের হাঁড়িতে হাত ডুবিয়ে সবজি বের করে আনছে আর চেটে চেটে তা খাচ্ছে। মহারাজ আবার বললেন, ছিঃ! এমন মহাপ্রসাদ খাওয়ার কোনও প্রবৃত্তি তাঁর নেই। কয়েকদিনের ভেতর রাজার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল কুষ্ঠ ব্যাধি। রাজবৈদ্যও সেই ব্যাধির নিরাময় করতে পারলেন না। মহাপ্রসাদকে অবমাননা করার ফল।
স্মর্তব্য ‘দুর্গাপঞ্চরাত্রি’র একটা শ্লোক। ‘প্রসাদং সত্যদেবস্য ত্যক্ত্বা দুঃখগমবাপ সঃ।’ সরল বাংলায় শ্লোকটির অর্থ, সত্যদেবতার প্রসাদকে অবজ্ঞা করলে তার ফল ভুগতে হবে।
অধিক ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। বিস্তৃত ব্যাখ্যানম্ অনাবশ্যকম।

Latest article