পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট অজানা এক গ্রাম ফিকালেগাঁও (Fikkalay Gaon)। কালিম্পং থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪,৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। পাহাড়, ঘন বনাঞ্চল এবং সোপানযুক্ত কৃষিজমি দিয়ে ঘেরা। এই লুকানো রত্নটি তুলনামূলকভাবে অনাবিষ্কৃত। গ্রামটি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এই অঞ্চলে রয়েছে আপেল বাগান। এখান থেকে সহজেই মনসুন, তিস্তা, বার্মিক, সাংসের, গ্যাংটক বা সিল্ক রুট যাওয়া যায়। গুটি কয়েক পরিবারের বাস। পাহাড়ের ধাপ কেটে চাষ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সেই কারণে এখানে এখনও তেমন ভাবে পর্যটকদের ভিড় দেখা যায় না। কোনও রকম মেকি সৌন্দর্য থাবা বসায়নি।
প্রকৃতিপ্রেমীদের এবং অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের বেড়ানোর আদর্শ জায়গা। হিমালয়ের ওঠানামা এখান থেকে দারুণভাবে উপভোগ করা যায়। কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়, সবুজ চা বাগান এবং পাইন বনে ঘেরা এই গ্রামটি একমাত্র রূপকথার জগতের সঙ্গে তুলনীয়। তাজা বাতাস এবং প্রশান্তিদায়ক পরিবেশ মন এবং আত্মাকে পুনরুজ্জীবিত করে। দূর করে দেয় শরীর ও মনের ক্লান্তি।
এই গ্রামে অনেক জৈব খামার রয়েছে, যেখানে গ্রামবাসীরা তাজা শাকসবজি, ফল এবং মশলা চাষ করেন। দর্শনার্থীরা খামারগুলি ঘুরে দেখতে পারেন, টেকসই কৃষিকাজ সম্পর্কে জানতে পারেন এবং এমনকি ফসল কাটাতেও অংশগ্রহণ করতে পারেন। এর ফলে লাভ করবেন অনন্য অভিজ্ঞতা।
গ্রামের আশেপাশের অরণ্যভূমি জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ, যা পাখিপ্রেমী এবং বন্যপ্রাণীপ্রেমীদের জন্য একটি চমৎকার গন্তব্যস্থল। এখানে অনেক বিরল প্রজাতির পাখি, প্রজাপতি এবং ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায়। পাখির সুরেলা কিচিরমিচির এক প্রাকৃতিক সিম্ফনি তৈরি করে। আনন্দ দেয়।
যাঁরা ট্রেক করতে পছন্দ করেন, তাঁরা যেতে পারেন। এই গ্রামে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর দারুণ সুযোগ রয়েছে। ঘুরে দেখা যায় কাছাকাছি বনাঞ্চল। ট্রেকিংগুলি তুলনামূলকভাবে সহজ। নতুনদের জন্যও উপযুক্ত। এলাচ বাগানের মধ্য দিয়েও হেঁটে যাওয়া যায়। হিমালয়ের অত্যাশ্চর্য প্যানোরামিক দৃশ্য দেয় চোখের আরাম। ভিউপয়েন্টগুলিতে হাইকিং করা যায়।
আরও পড়ুন-কোথায় দাঁড়িয়ে বাণিজ্যিক সম্পর্ক
ফিকালেগাঁওয়ে (Fikkalay Gaon) স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করলে ভালো লাগবে। এটা মূলত লেপচা, নেপালি, ভুটিয়া-সহ বিভিন্ন জাতিগত সম্প্রদায়ের আবাসস্থল। গ্রামবাসীরা ঐতিহ্যবাহী উৎসবগুলি অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে উদযাপন করেন। যদি স্থানীয় উৎসবের সময় যাওয়া যায়, তাহলে লোকনৃত্য, ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশনা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ মিলবে।
কাছেপিঠে আছে বেশকিছু দর্শনীয় স্থান। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম দেওরালি ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারাবৃত শৃঙ্গ এবং তিস্তা নদীর প্রবাহের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দুচোখ ভরে দেখা যায়। স্থানীয় কুন্ডেলিং মঠ হল প্রকৃতিতে ঘেরা একটি শান্ত বৌদ্ধ আশ্রম। জায়গাটা দেখার মতো। মনের মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাবের জন্ম দেবে। অন্যদের সঙ্গে বসে করা যায় ধ্যান।
ঘুরে আসা যায় ডেলো হিল থেকে। কালিম্পংয়ের সর্বোচ্চ স্থানগুলির মধ্যে একটি। ডেলো হিল থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতমালার মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা যায়। পিকনিকের জন্য এটা একটা দুর্দান্ত জায়গা। বহু মানুষ বেড়াতে আসেন।
দেখা যায় দুরপিন মঠ জাং ধোক। এটা পালরি মঠ নামেও পরিচিত। এই তিব্বতি বৌদ্ধ মঠটি অসাধারণ স্থাপত্য এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশের জন্য পরিচিত।
এলাকাটা বিদেশি ক্যাকটাস নার্সারির জন্য বিখ্যাত। এই নার্সারিগুলিতে যাওয়া একটি অনন্য অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে উদ্ভিদপ্রেমীদের জন্য। কাছেই রয়েছে রেলি নদী। এই নদীর তীরেও দলবেঁধে পিকনিক করা যায়।
ঘুরে বেড়ালে খিদে তো পাবেই। তখন স্থানীয় সুস্বাদু খাবার ট্রাই করা যায়। মোমো, থুকপা, সেল রুটি এবং গুন্ড্রুকের মতো খাবারের স্বাদ এককথায় অতুলনীয়।
ফিকালেগাঁও ভ্রমণের সেরা সময় হল মার্চ থেকে জুন এবং সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর। এই মাসগুলোতে আবহাওয়া মনোরম থাকে এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার সর্বোচ্চ সীমায় থাকে। জুলাই আগস্ট মাসে ভারী বৃষ্টিপাত হয়। ঘুরে বেড়ানোর ক্ষেত্রে সেটা অসুবিধাজনক। শীতকালে, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেশ ঠান্ডা পড়ে। তুষারাবৃত পাহাড়ের পরিষ্কার দৃশ্য দেখা যায়। যাই হোক, সপরিবার ফিকালেগাঁও ঘুরে আসতে পারেন। এই ভ্রমণ মনকে অন্যরকম আনন্দ দেবে।
কীভাবে যাবেন?
যাওয়া যায় বিমানপথে। নিকটতম বিমানবন্দর বাগডোগরা। প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে। বিমানবন্দর থেকে কালিম্পং যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ভাড়া করা যায়। তারপরে ফিকালেগাঁও (Fikkalay Gaon) যাওয়ার জন্য স্থানীয় ক্যাব নেওয়া যায়। যাওয়া যায় ট্রেনেও। নিকটতম রেলস্টেশন নিউ জলপাইগুড়ি। প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে। নিউ জলপাইগুড়ি বা এনজেপি থেকে কালিম্পং পৌঁছানোর জন্য একটি শেয়ার্ড বা ব্যক্তিগত ট্যাক্সি ভাড়া করা যায়। সেখান থেকে যাওয়া যায় ফিকালেগাঁও। কালিম্পং শহর থেকে ফিকালেগাঁও সড়কপথে সুসংযুক্ত। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছোটে। প্রায় ৪৫ মিনিট সময় নেয়।
কোথায় থাকবেন?
ফিকালেগাঁওয়ে কোনও বিলাসবহুল হোটেল নেই। এটাই অভিজ্ঞতাকে আরও বিশেষ করে তোলে। কারণ এখানে আছে বেশকিছু হোমস্টে। থাকা এবং খাওয়ার কোনও অসুবিধা হবে না। আশপাশের এলাকায় বেড়াতে যাওয়ার আগে হোমস্টের মালিকদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। ওঁরা আন্তরিকতার সঙ্গে বাড়িয়ে দেবেন সহযোগিতার হাত।