পলাশের টানে পাহাড়পুরে

পুরুলিয়ার পাহাড়পুর। প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকা এক প্রান্তিক জনপদ। এখানে দেখা যায় উজাড় করা প্রকৃতির রূপ, ঢেউখেলানো মালভূমি, দ্বারকেশ্বরের বয়ে চলা। আর? বসন্তে পলাশ-সৌন্দর্য। দোলের মরশুমে সপরিবার ঘুরে আসতে পারেন। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

বসন্ত এসে গেছে। এইসময় মন বড় বেশি পলাশ-পলাশ করে। পলাশের মনমাতাল করা সৌন্দর্য দু-চোখ ভরে উপভোগ করার জন্য অনেকেই সদলবলে বেরিয়ে পড়েন। যান দূরে কোথাও, নয়তো কাছেপিঠে। আমাদের রাজ্যেই আছে বেশকিছু জায়গা। তার মধ্যে অন্যতম সেরা গন্তব্য পুরুলিয়া। বসন্তকালে এখানে রূপের পশরা সাজিয়ে বসে প্রকৃতি। পলাশবনের মনোমুগ্ধকর শোভা উপভোগ করতে ফাগুনে আগুনের দিনে অনেকেই পুরুলিয়া জেলায় বেড়াতে আসেন। পরিচিত গন্তব্যগুলো ছাড়াও পুরুলিয়ায় রয়েছে বেশ কিছু স্বল্পচেনা পর্যটনস্থল, যেখানে ভিড় এড়িয়ে প্রকৃতির অনাবিল উপস্থিতিতে রোমাঞ্চিত হওয়ার বাসনা চরিতার্থ হয়। প্রচারের আলো থেকে দূরে এমনই এক প্রান্তিক জনপদ পাহাড়পুর (Paharpur)। নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ছোট্ট এই গ্রামকে ঘিরে রয়েছে একাধিক ছোটবড় পাহাড় ও টিলা। নামে যা নেই, তা-ও আছে এখানে। উজাড় করা প্রকৃতির রূপ, ঢেউখেলানো মালভূমি, অভ্রের খনি, দ্বারকেশ্বরের বয়ে চলা, চাষের খেত, গ্রামীণ সাদামাঠা জীবন। আর? বসন্তে পলাশ সৌন্দর্য। বিলাস-বৈভব ছাড়াই এখানে দিব্যি সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। মাস ঘোরে, মরশুম বদলায়। বদলে যায় প্রকৃতির সাজসজ্জা। বসন্ত দিনে প্রকৃতির রূপবদলের সাক্ষী হতেই ঘুরে আসতে পারেন পাহাড়পুর। পুরুলিয়ার কাশীপুরেই রয়েছে ছোট্ট জনপদটি।

এই জেলার আনাচকানাচে ছড়িয়ে ইতিহাস, ঝর্না, রাজবাড়ি, পাহাড়। দেখার জায়গা প্রচুর। পাহাড়পুরে পাহাড়কে বেড় দিয়ে তৈরি হয়েছে রাস্তা। সেই রাস্তা শেষ হয়েছে কাঁকর বিছানো পথে। এখানে এলে, রাঙা পলাশ দেখার পাশাপাশি সকাল-সন্ধে দ্বারকেশ্বরের রূপ উপভোগ করা যায়। চড়া রোদে শরীর-মাথা তেতে উঠতেই পারে। তখন ডুব দেওয়া যায় নদের বুকে। শরীর ও মন শীতল হয়ে উঠবে।

আরও পড়ুন- “তোরা করলি কেবল অহরহ নীচ কলহের গরল পান”

পাহাড়পুর (Paharpur) থেকে ১২ কিলোমিটার গেলেই সোনাঝুরির জঙ্গল। গাড়িতে সেই পথে যাওয়ার সময় নজর পড়তে পারে রোদে ঝকমকিয়ে ওঠা পাথরের টুকরোয়। গাড়ি থেকে নেমে কয়েকটি পাথর হাতে নিলেই বোঝা যাবে, তার গায়ে লেগে রয়েছে অভ্র। একটা সময় এখানে ছিল অভ্রের খনি। তারই নমুনা ছড়িয়ে রয়েছে এলাকার আশপাশে। খনি অবশ্য বর্ষার পরে জলেই ভরে থাকে। দেখলে মনে হবে, গাছপালা ঘেরা একটা বিরাট জলাশয়।
জায়গাটা ঘুরে, খানিক জিরিয়ে কিছুটা এগোলেই দেখা যাবে সোনাঝুরির বন। এই জায়গার সঙ্গে কিছুটা মিল রয়েছে শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরি জঙ্গলের। দিনভর এই দিক ওই দিক ঘুরে পাহাড়পুরে ফিরে বিকেলবেলা পায়ে হাঁটা পথে গ্রামের মধ্যে থাকা ছোট্ট পাহাড়ে চড়া যায়। গাড়ি যায় তার নিচ পর্যন্ত। সামান্য কিছুটা পথই হাঁটতে হয়। অবশ্য পাহাড় না বলে একে টিলা বলাই ভাল। তার উপর থেকে দেখা যায় গোটা পাহাড়পুর।
পাহাড়ে হাঁটাহাটি করলে চোখে পড়বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ইটের তৈরি সেমাফোর টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ। জানা যায়, এই টাওয়ারের সাহায্যেই এক সময় সাঙ্কেতিক ভাষায় জরুরি বার্তা পাঠানো হত। নির্দিষ্ট দূরত্বে ছিল একাধিক টাওয়ার। প্রতিটি টাওয়ারে লোকজন থাকত। একটি টাওয়ার থেকে অন্যটিতে, আবার সেই টাওয়ার থেকে আরও এক টাওয়ারে পাঠানো হত বার্তা।

রাতের বেলা পাহাড়পুর(Paharpur) গ্রামের রূপ আলাদা। জ্যোৎস্নায় গোটা চরাচরে ছড়িয়ে পড়ে মায়াবী চাঁদের আলো। দূষণহীন আকাশে জ্বলজ্বল করে ওঠে তারাদল। তখন মনে হয় এ যেন এক রূপকথার দেশ।
রাত কাটিয়ে পরের দিন দেখে নেওয়া যায় এখানকার ইকো পাহাড় সংলগ্ন ইকো লেক। তালাজুরি মোড়ের কাছে রয়েছে বরুণেশ্বর শিবমন্দির। গাজনের সময় এখানে বড়সড় মেলা বসে। প্রচুর জনসমাগম হয়। একটি বা দুটি রাত পাহাড়পুরে থাকলে ঘুরে নেওয়া যায় আশপাশের জায়গাগুলিও। বর্ষায় পাহাড়পুর রীতিমতো শ্যামল, শরৎকালে গ্রামের আনাচকানাচে মাথা দোলায় কাশফুল। আর বসন্তে? নানা রঙের পলাশের সৌন্দর্য। দোলের মরশুমে প্রকৃতি থেকে এক মুহূর্ত চোখ ফেরানো যায় না।
হাতে সময় থাকলে, পাহাড়পুর থেকে ঘুরে নেওয়া যায় রঞ্জনডি ড্যাম বা যোগমায়া সরোবর। সবুজে ঘেরা জলাধারটিও বেশ মনোরম। আদ্রা থেকে এই জায়গাটি মোটামুটি ২৭ কিলোমিটার দূরে। পাহাড়পুর এক বা দু-দিন কাটিয়ে গড়পঞ্চকোট, অযোধ্যা, বড়ন্তি-সহ পুরুলিয়ার আরও নানা জায়গাও রাখা যায় বেড়ানোর তালিকায়।

কীভাবে যাবেন?
ট্রেনে গেলে নামতে হবে ইন্দ্রবিল স্টেশনে। তবে সব ট্রেন এখানে থামে না। সেই ক্ষেত্রে আদ্রা স্টেশনে নেমে গাড়িতে পাহাড়পুরে পৌঁছতে হবে। কলকাতা থেকে সরাসরি গাড়িতেও আসতে পারেন পুরুলিয়া। ডানকুনি-আরামবাগ দিয়ে এলে বরজোড়া, বেলিয়াতোড় হয়ে বাঁকুড়া পৌঁছে, বাঁকুড়া থেকে ছাতনা হয়ে তালাজুরির দিক থেকেও আসা যায় পাহাড়পুর।

কোথায় থাকবেন?
পাহাড়পুরে থাকার জন্য একটি ইকো রিসর্ট আছে। প্রকৃতিবান্ধব পদ্ধতিতে তৈরি রিসর্টর কটেজে আধুনিক জীবনযাপনের সব ব্যবস্থাই রয়েছে। বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ করতে হবে ৯৮৩৬১৩১৩৫৭ ফোন নম্বরে।

Latest article