আমার পোশাক আমার স্বাধীনতা

এশিয়া, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ঝড় উঠেছে পোশাক ছুঁড়ে ফেলার। যে-পোশাকের গায়ে লেগে আছে সরকার, প্রশাসন ও মৌলবাদীদের বিধিনিষেধের রং। সে বোরখা, হিজাবই হোক বা খোলামেলা পোশাক। নারী কিন্তু পোশাক নির্বাচন করছেন তাঁর স্বাধীনতায়, বুদ্ধি, মেধায়। দেশে দেশে সংবিধানের পাতায় শুধু সমান অধিকার নয়, পোশাকের ভাবনায়ও তাঁরা সমান অধিকারী। কারণ ওই অর্ধেক আকাশটা ওঁদের। সেই অর্ধেক আকাশের নিজের পোশাক বাছার স্বাধীনতার গল্প। তুলে ধরলেন বিশ্বজিৎ দাস

Must read

 

আমার মুক্তি এই আকাশে
তিউনিশিয়ার একটি ছোট্ট গ্রাম। সেই গ্রামে লেখাপড়া শিখছে মেয়েরা। সমাজে, সংসারের অনেক বাধানিষেধ। কখনও ধর্মীয় বাধানিষেধ আবার কখনও মৌলবাদীদের বাধানিষেধ। তবু লড়াই জারি আছে। এই গল্পের শেষের দৃশ্যে বহুতল বাড়ির ছাদে উঠে দাঁড়ায় প্রতিবাদী সেই মেয়েটি। সে আকাশে উড়িয়ে দেয় তার বোরখা। নিমেষে সব বাড়ির ছাদ ও জানলা থেকে উড়তে থাকে হাজার-হাজার, লাখ-লাখ বোরখা। নীল আকাশ ঢেকে যায় কালো বোরখায়। আর সেই প্রতিবাদী তরুণী ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে গাইতে থাকে স্বাধীনতার গান। প্রেক্ষাগৃহে আলো জ্বলে ওঠে, চলতে থাকে হাততালি। তিউনিশিয়ার চলচ্চিত্র পরিচালক বাস্তবের এই ছবি এঁকেছেন রিলের পর্দায়। এই ছবির মধ্যে আছে নিজের পোশাক, নিজের স্বাধীনতা বলার অহংকার।

আরও পড়ুন-দিঘা রুটে ভলভো বাস চালিয়ে এক সপ্তাহে ৬ লক্ষ আয় এনবিএসটিসি-র

নদী হতে পেলে
তিউনিশিয়া থেকে সোজা সেক্টর ফাইভের বহুজাতিক সংস্থার ক্যাফেটেরিয়ায় দাঁড়িয়ে কঙ্কণা সাইমনকে বলছে— জিনস পরা ছেড়ে দিতে পারি অনায়াসে, নদী হতে পেলে। সাঁতার জানো কি তুমি ছেলে? এখানেও রয়েছে পোশাক-ফতোয়া। নারী তার প্রেমিকের কাছে সাঁতার শিখবে বলে পোশাকে বদলে নিতে পারে নিজেকে। আবার যখন তার প্রিয় পুরুষ, প্রিয় নারীর স্বপ্ন দেখে— পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর। বা প্রিয় নারীর জন্যে গেয়ে ওঠে— কপালে সিঁদুর সিঁদুর টিপ পরেছো,/ পরেছো শঙ্খদ্বীপের শাঁখা। তখন তাতে রোম্যান্টিকতা থাকে বটে! শুধু থাকে না সরকার বা প্রশাসনের কোনও বিধিনিষেধ।
এই ছবি শুধু পশ্চিমবঙ্গের কোনও জেলা বা ভারতের সব শহরের না। পৃথিবী জুড়ে পোশাক নিয়ে উঠেছে বিতর্ক। পৃথিবীতে পোশাকের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মানুষ সম্ভবত প্রথম ঊর্ধ্বাঙ্গের পোশাক ব্যবহার শুরু করেছিল। এর কারণ হতে পারে, ঝোপঝাড়ে ফলমূল সংগ্রহকারী মানুষের শরীর কাঁটার আঘাত থেকে রক্ষা ও শীতে উষ্ণতা পাওয়া। এরপর মানুষ যতই চিন্তাভাবনা, মনে-মননে বিকশিত হতে শুরু করেছে, শাসন ও নিয়মনীতি চালু করেছে, তখন থেকেই শুরু হয়েছে পোশাকের বৈচিত্র ও পোশাকের রাজনীতি।
আমার পোশাক আমার রুচি
নারীর পোশাকের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করার প্রবণতা কমবেশি প্রায় সব দেশেই রয়েছে। সম্প্রতি ইরানে মেয়েদের পোশাকের উপর নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সেখানে হিজাব সতীত্ব আইন কার্যকর করা হয়েছে। বলা হয়েছে এই আইন লঙ্ঘন করলে মেয়েদের শাস্তি পেতে হবে এবং ইরানে মহিলা সরকারি কর্মীদের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলের ছবি এই আইন মেনে দিতে হবে। নাহলে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে। আর যেসব মেয়ে সরকারি চাকরি করে না তারা যদি ইন্টারনেটে হিজাব ছাড়া ছবি প্রকাশ করে তাহলে ৬ মাস থেকে ১ বছরের জন্য তাহলে বেশ কিছু সামাজিক অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হবে। তাদের সরকারি অফিসে বা ব্যাঙ্কে ঢুকতে দেওয়া হবে না। গণপরিবহণে চড়তে দেওয়া হবে না। মেয়েরা শাড়ি বাদ দিয়ে সালোয়ার-কামিজ পরছেন। একসময় হিন্দু নারীরা বিশাল ঘোমটা টেনে কাপড় পরতেন। কালের বিবর্তনে ঘোমটা ছোট হয়েছে কিংবা উঠে গেছে। পাশাপাশি সমাজে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় ধ্যানধারণা বৃদ্ধির কারণে বোরখা পরার প্রচলন বেড়েছে। এটা কূটতর্কের বিষয় নয়, এটা একটা প্রবণতা ও বাস্তবতা। এর সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের যোগ আছে। সমাজ মনস্তত্ত্ব অস্বীকার করে বোরখার বিরুদ্ধে গর্জন করলেই যেমন এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমবে না, আবার বোরখার পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালালেও সবাই বোরখা পরবে না। আমাদের সমাজটা নানা ধর্ম-বর্ণ-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ-রুচির মানুষ নিয়ে গঠিত। সেখানে চিন্তাভাবনা, আচরণ, পোশাক ইত্যাদির ভিন্নতা থাকবেই। কোনও সমাজে সবাই একই রকম পোশাক পরবে, একই ধরনের চিন্তা ও আচরণ করবে এটা অলীক কল্পনা মাত্র। ভিন্নতা ও বৈচিত্রকে মান্যতা দিতেই হবে। এটা অনিবার্য।

আরও পড়ুন-ক্রীড়ামন্ত্রীর অনুরোধে লিগে ভূমিপুত্র বেড়ে ৬

আপ রুচি খানা—
পর রুচি পরনা
নারীর পোশাকের শালীনতা অশালীনতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে। সূক্ষ্ম কাপড় তৈরিতে বাংলার তাঁতিদের অসীম দক্ষতা ছিল, তাঁরা ব্রিটিশদের সুতি-কাপড় পরা শিখিয়েছিলেন। যে কাপড় পাল-সেন-সুলতান-মোগল-নবাবি আমলে শাসকদের গর্বের ছিল, অশ্লীল অভিধার বদলে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। নব্য অভিজাতরা অশ্লীলতা রোধে জমিদারদের চাপ দিলেন সেই সূক্ষ্ম কাপড় উৎপাদন বন্ধের জন্য। প্রভুদের তৈরি ম্যানচেস্টারের মিলের মোটা কাপড়ের আর সূক্ষ্ম প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না। ‘উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান’ বইয়ে সুমন্ত্র বন্দ্যোপাধ্যায় এমনটাই লিখেছেন। মহাভারতে বর্ণিত দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণও ছিল নারীর পোশাকের রাজনীতিই। আসলে নারীর সমাজনির্মিত একটি চেহারা আছে এবং সেই চেহারাটা হিন্দুদের জন্য একরকম, ধর্মনিরপেক্ষদের জন্য একরকম, নারীবাদীদের জন্য একরকম, মুসলমান, খ্রিস্টান-বৌদ্ধদের জন্য আর একরকম। একশ্রেণির মানুষ এই বিষয়গুলোকে হাতিয়ার করে সামাজিক বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালায়।

মালালা থেকে মালিকা : প্রতিবাদের অন্য নাম
সংরক্ষণশীল রাষ্ট্রগুলো নারীর পোশাকের ব্যাপারে ফতোয়া জারি করে আসছে বেশ বহুদিন ধরে। সে ইউসুফ মালালা হোক বা ফতেমা বিবি। আফগানিস্তান জুড়েই পোশাক-বিতর্ক। আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালিবান ঘোষণা করে যে কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে মহিলাদের সম্পূর্ণ ঢেকে রাখা বোরখা পরতে হবে, তার পর থেকে নারীদের মুখ ঢেকে রাখা সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা হয়ে ওঠে। তালিবান কর্মকর্তারা মুখ ঢেকে রাখার ডিক্রিটিকে ‘পরামর্শ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে, তবে যাঁরা তা মানেন না তাঁদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথাও উল্লেখ করেছেন।
কম্বোডিয়ার সরকারও এ-বিষয়ে খুব একটা উদার নয়। মেয়েরা কী ধরনের পোশাক পরবেন প্রায় ৪ বছর আগে সে-বিষয়ে একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছে কম্বোডিয়া সরকার। কোনও মেয়ের শরীর দেখা যায় এমন পোশাক পরলে তাকে জরিমানা করার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। কম্বোডিয়ায় ১৮ বছরের কিশোরী এর বিরুদ্ধে অনলাইনে পিটিশন শুরু করে। সে মলিকা টান। কম্বোডিয়া সরকারের দাবি, দেশটির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষার উদ্দেশ্যে ওই বিল আনা হয়েছে। অবশ্য উদ্যোগটি জানাজানি হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে সরকারকে। এদিকে, মলিকা বিশ্বাস করেন, এ ধরনের আইন করার উদ্যোগ বস্তুত নারীদের ওপর আক্রমণের শামিল। তিনি বলেন, কম্বোডিয়ার একজন তরুণী হিসেবে ঘরের বাইরে বের হলে আমি নিজেকে নিরাপদ বোধ করতে চাই। যে পোশাক পরতে আমার ভাল লাগবে, সেই পোশাক পরতে চাই। আমার পরিহিত পোশাকের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে চাই আমি। সরকার এখানে কোনও সীমা বেঁধে দিক, তা চাই না। নারীদের খাটো স্কার্ট পরা বন্ধ করতে আইন বাস্তবায়ন করা ছাড়াও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখার আরও অনেক উপায় রয়েছে, বলে অভিমত তাঁর। জানা যায়, মলিকার অনলাইন পিটিশন শুরু হয়েছে গত মাসে। এরই মধ্যে দেশটির ২১ হাজারের বেশি নাগরিক ওই পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন।
দুই দশকের পোশাকি ইজেহাদ
শুধু আফগানিস্তান, ইরান বা কম্বোডিয়া নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পোশাকের কারণে নারীদের হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় ৫৬টি দেশের মধ্যে ৪২টি দেশে নারীরা ধর্মনিরপেক্ষ পোশাক রীতি লঙ্ঘন করায়, অর্থাৎ হিজাব বা অন্যান্য ধর্মীয় পোশাক পরায় নানান ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ আর ১৯টি দেশের নারীরা ধর্মীয় পোশাক রীতি না মানায় কিংবা ধর্মীয় রীতির সঙ্গে মেলে না এমন পোশাক পরায় হয়রানির শিকার হয়েছেন। জার্মানি, রাশিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়ার মেয়েদের এই অভিজ্ঞতাই হয়েছে। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা জুড়ে গত শতাব্দীতে এমন নানা উদাহরণ রয়েছে যেখানে, মেয়েরা সঠিক পোশাক না পরায় অত্যাচারের শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালে ডেনমার্কে এক চালক হিজাব পরা এক নারীকে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা ছেড়ে দিতে অস্বীকার করেন৷ জার্মানিতে এক নারী আরেক নারীকে মেরে তার হেডস্কার্ফ খুলে ফেলার চেষ্টা করেন৷ এমন ঘটনা অজস্র।
প্রতিবাদে কর্নাটক
২০২১ সালে কর্নাটকে হিজাব নিষিদ্ধ করা হলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন বছর আঠারোর তাবাসসুম শেখ। হিজাব নিষিদ্ধকরণ শুরু হওয়ার পর তিনি দুই সপ্তাহের জন্য কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শুধু তিনিই নন, তাঁর অনেক সহপাঠীও স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। যদিও তাবাসসুমের বাবা-মা তাঁকে অনুপ্রেরণা জোগান। ২০২৩-এ পিইউসি–র কলা বিভাগে শীর্ষস্থান লাভ করেন তাবাসসুম। তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ছিল মোট ৬০০-র মধ্যে ৫৯৩। তাবাসসুম হিজাব নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন৷
সম্প্রতি কর্নাটকের উদুপি জেলায় এক সংখ্যালঘু ছাত্রীর ভিডিওতে সমাজ মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। কর্নাটক রাজ্যের উদুপি জেলার একটি সরকারি কলেজের কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ইউনিফর্ম-সংক্রান্ত কিছু বিধিবিধান জারি করেছিল। সেই বিধিবিধানে বলা হয়েছিল হিজাব পরে ক্লাস করা যাবে না। কারণ, তা বৈষম্য সৃষ্টিকারী। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী, ছাত্রীরা ‘স্কার্ফ’ পরতে পারবে। এক ছাত্রী বোরখা ও হিজাব পরে স্কুটি চালিয়ে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢুকতেই হেনস্তার মুখে পড়ে। তখন এই নিয়মের প্রতিবাদ জানায় ছাত্রীরা। এ নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যের আরও কয়েকটি জায়গায়।

আরও পড়ুন-আজ পালিত হবে ইদ-উল-আযহা

আমরা প্রতিবাদ করতে জানি
পশ্চিমি দেশগুলো উদার হলেও অনেক দেশেই রাস্তায় বিকিনি পরে হাঁটাচলা করা যায়। কিন্তু তা বলে স্পেনে বেড়াতে গিয়ে রাস্তায় বিকিনি বা সাঁতারের পোশাক পরে হাঁটবেন না। বিশেষ করে স্পেনের মাজোর্কা ও বার্সেলোনার পাশাপাশি ক্রোয়েশিয়া, মালদ্বীপ এবং তুরস্কের রাস্তায় বিকিনি বা সাঁতারের শর্টস পরার নিয়ম নেই। এর জন্য জরিমানা করা হয়। আবার বার্বাডোজে গিয়ে এমন পোশাক পরা যাবে না লোকজনকে বিভ্রান্ত করতে পারে। যেমন আপনি যদি সেনাবাহিনীর লোক না হন তাহলে নিছক ফ্যাশনের জন্য তাদের পোশাক পরতে পারবেন না। বিশেষ করে বার্বাডোজের সেন্ট ভিনসেন্ট এবং সেন্ট লুসিয়াতে এমন বিভ্রান্তিকর পোশাক পরা ঘোরতর নিষিদ্ধ। এমনকী শিশুরাও এই ধরনের পোশাক পরতে পারে না। এটি লঙ্ঘন করলে ভারী জরিমানা হতে পারে। গ্রিসের ঐতিহাসিক স্থান যেমন অ্যাক্রোপলিস বা ডেলফিতে মহিলাদের হাই হিল পরার অনুমতি একেবারেই নেই। হাই হিলের কারণে প্রাচীন নিদর্শনগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সেখানে এই নিয়ম। শরিয়ত আইন অনুযায়ী সুদানে যেমন নারীদের ট্রাউজার বা প্যান্ট পরার অনুমতি নেই, তেমনই পুরুষ মডেলরা এখানে মেকআপ করতে পারেন না। শুধু তাই নয়, এখানে অশ্লীল পোশাক পরাও নিষিদ্ধ। ফ্রান্সে পাবলিক প্লেসে কেউ মুখ ঢেকে রাখা পোশাক পরতে পারেন না। এর মধ্যে রয়েছে মাস্ক হেলমেট, বোরখা এবং মুখ ঢাকার ওড়না।
পরনে ঢাকাই শাড়ি— কপালে সিঁদুর
বাঙালি সংস্কৃতিকে নারীর শালীন পোশাকে মান্যতা পেয়েছে শাড়ি। রবীন্দ্রনাথও এই গণ্ডির বাইরে বেরোতে পারেননি। বিরহী হরিপদ এক নারীর ছবি এঁকেছেন— ‘ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া— পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর।’ বৈষ্ণব পদাবলির বাঙালি কবি চণ্ডীদাসও নারীর পোশাকের শাড়ির কথা বলেছেন। সদ্যস্নাত রাধা নীল শাড়ি পরে বাড়ির দিকে চলেছেন— এ অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে আবেগমথিত কৃষ্ণ বলে ওঠেন, ‘চলে নীল শাড়ি, নিঙাড়ি নিঙাড়ি— পরান সহিত মোর…।’ চলমান নীল শাড়ি আমার পরান নিঙড়ে নিচ্ছে! চণ্ডীদাস যখন নীল শাড়ির প্রেমে ধরাশায়ী কৃষ্ণের করুণ মানসিক অবস্থার কথা লিখছেন, তখন কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ছবি আঁকছেন বিয়ের অনুষ্ঠানের। বিয়েতে আগত অতিথিরা উপহারের তালিকায় অন্য দ্রব্যাদির সঙ্গে পাটের শাড়িও নিয়ে লিখেছেন।
পাটের তন্তু দিয়ে শাড়ি তৈরি সম্ভব কি না, সে-বিষয়ে সন্দেহ থাকলেও এ-বিষয়ে কোনও সন্দেই নেই যে ‘অগ্নি-পাটের শাড়ি’ পরা কমলাকে দেখে আকাশের তারারাও লজ্জা পেত। দ্বিজ ঈশান লিখছেন— ‘অগ্নি-পাটের শাড়ি কন্যা/ যখন নাকি পরে/ স্বর্গের তারা লাজ পায়/ দেখিয়া কন্যারে।’ ‘অগ্নি-পাটের শাড়ি’ পরা যুবতী কমলা দেখতে কেমন, সে ভাবনায় না গিয়ে বরং ‘লক্ষ্মীবিলাস’ শাড়ির কথা শোনা যাক। ‘গোপীচন্দ্রের গান’-এ এই লক্ষ্মীবিলাস শাড়ির নকশার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের ইতিহাসে তা বিরল—‘…দরিয়ার জাত মাছ মগ্র দ্যাছে/ কাপড়াএ নেখিয়া।/ পৃথিবীর যত পক্ষি দ্যাছে/ কাপড়াএ নেখিয়া।’ দরিয়ার যত মাছ আর পৃথিবীর যত পাখি, সবই ছিল সেই শাড়ির নকশায়। রাজহাঁস, বালিহাঁস, সরালি, চকোর, বুলবুলের নকশা তোলা সে শাড়ি গায়ে গোপীচন্দ্রের বড় স্ত্রী ‘রদুনা রানি’ (অদুনা) চলেছেন পরীক্ষায়! প্রাত্যহিক জীবনে তো বটেই, নিজের সতীত্ব আর জীবনের গূঢ় পরীক্ষাতেও বাঙালি নারী নকশাদার শাড়ি গায়ে মহিমাময়ী। জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা কাব্যের ‘পাড়াগাঁর দু’পহর’ কবিতাতেও পাওয়া যায় ‘নক্সাপেড়ে’ শাড়ির কথা।
সোজন বাদিয়ার ঘাট কাব্যে শাড়ির বর্ণনায় জসীমউদ্দীন রোম্যান্টিক কিন্তু বাস্তব— ‘তবুও আবার রজনী আসিল,/ জামদানি শাড়িখানি/ পেটেরা খুলিয়া সযতনে দুলী/ অঙ্গে লইল টানি।’প্রেম-প্রতীক্ষা-বিরহ-বেদনায় যাপিত জীবনে পুরুষ, নারী ও শাড়ির এক জটিল রহস্যময় মিথস্ক্রিয়া। কিন্তু সেই শাড়ি কতটা শালীন আর কতটা অশালীন তা শুধু কাব্যে নয়, বাস্তবেও প্রশ্নের মুখে দাঁড়ায়। কবির কথায়— ‘তুমি তো নও আম্রপালী,/ বর্তমানের নারী/ তোমার লাগে লিনোলিয়াম/ সিফনঘেরা শাড়ি’।

Latest article