পাখিদের স্মৃতি কিছু রীতিনীতি
ভূমধ্যসাগরের মাঝে ছোট্ট একটা দ্বীপ। সেই দ্বীপে বাসা বেঁধেছে এক দম্পতি পাখি। চার সন্তান নিয়ে তাদের বাস। একদিন ঠিক করে পাখিগুলোকে উড়তে এবং খাবার সংগ্রহ করতে শেখাতে হবে। রীতি অনুযায়ী একদিন মা পাখিটি প্রথমে তার প্রথম সন্তানকে নিয়ে সমুদ্রের উপর দিয়ে পাড়ি দেয় অন্য দ্বীপে। যেতে যেতে সন্তানকে জিজ্ঞেসা করে— আমরা বৃদ্ধ হলে তুই আমাদের দেখবি তো! ছোট পাখিটি উত্তর দেয়— অবশ্যই দেখব। তোমরা আমার জন্ম দিয়েছ। উড়তে শিখিয়েছ। খেতে দিয়েছ। তোমরা বৃদ্ধ হলে, আমরাই তো তোমাদের ভরসা। তোমাদের না দেখলে আমাদের পাপ হবে। একথা শুনে মা তার সন্তানকে সমুদ্রের জলে ফেলে দেয়। এরপর দ্বিতীয় সন্তানকে নিয়ে আবার মা পাড়ি দেয় অন্য দ্বীপে। তাকেও একই প্রশ্ন করা হয়। সেও প্রায় একই উত্তর দেয়। উত্তর শুনে মা পাখি দ্বিতীয় সন্তানকেও সাগরের জলে ফেলে দেয়। এবার তৃতীয় সন্তানকে নিয়ে যেতে যেতে সেই একই প্রশ্ন করে এবং একই উত্তর পায়। তাকেও মাঝসমুদ্রে ফেলে দেয় মা। এবার চতুর্থ সন্তানকে নিয়ে মা পাড়ি দেয় এবং যেতে যেতে সেই একই প্রশ্ন করে। সে তখন মা-কে বুঝিয়ে বলে— দেখো মা, তোমরা যখন বৃদ্ধ হবে আমার তো তখন সংসার থাকবে, সন্তান থাকবে। আমি তো তাদেরকে দেখব। তোমাকে দেখার দায়িত্ব পালন করার তেমন সুযোগ থাকবে না। তবু আমার সন্তানদেরও দায়িত্ব পালন করে তোমার দায়িত্ব পালন করব। তখন মা এই চতুর্থ সন্তানকে নিয়ে পৌঁছে দেয় সেই দ্বীপে। তাকে নিজের মতো বাঁচতে শেখায়। উড়তে শেখায়। খেতে শেখায়।
এ-শুধু কথামৃতের পাখিদের কথা নয়। আমাদের জীবনের কথা। মায়েদের সঙ্গে সন্তানদের কথকথা। শেখা এবং শেখানোর কথা। সন্তানের সঙ্গে মায়েদের সম্পর্ক বহমান নদীর মতো। সেই সম্পর্কের পরতে পরতে রয়েছে বাঁক। কোনও শব্দ দিয়ে এই সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করা যায় না। কখনও মা এবং সন্তানের এই পবিত্র সম্পর্ক বন্ধুত্বের। কখনও নির্ভরতার। কখনও বিশ্বাসের। কখনও অভিমানের। কখনও উপেক্ষার।
আরও পড়ুন-একাকী মায়েদের গল্প
শৈশব : আমার মা সব জানে
জন্মের পর থেকে সন্তানের সবথেকে কাছের মানুষ মা। মায়েরা যদি ছোটবেলা থেকে শাসন করার পাশাপাশি বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন তাহলে বাইরের দুনিয়াটা আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। সন্তানের জন্মের পর থেকেই তার সঙ্গে সময় কাটানো মায়েদের অভ্যাসে পরিণত হয়। হাজার কাজের মাঝেও বাচ্চার সঙ্গে কথা বলা, গল্প করার অভ্যাস তৈরি হয়। উভয়ের এক সঙ্গে খাওয়া, ঘুম, খেলা, একে অন্যের খোঁজ নেওয়ার অভ্যাস তৈরি করা ছোট থেকেই রুটিন কাজ হয়ে ওঠে। এর পর সন্তানের স্কুল, মায়ের অফিস এবং অন্যান্য কাজের অভিজ্ঞতা একে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করেন। শৈশবে সন্তানের মুশকিল আসান তার মা। অনেক ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস এমন জায়গায় পৌঁছায়, ছেলেমেয়েরা ভাবতে শুরু করে— ‘আমার মা সব জানে।’ একের পর এক প্রশ্ন তৈরি হয় শিশুর মনে। ছোট থেকেই মায়েরা তাদের নির্ভরযোগ্য একমাত্র শিক্ষক। স্নেহ-ভালবাসার পাশাপাশি তারাই প্রথম শাসন করে সন্তানকে। মা এবং সন্তানের সম্পর্কে শৈশবের প্রথম ধাপে তেমন টানাপোড়েন থাকে না। থাকে না সংঘাত।
মাতৃগর্ভ : পৃথিবীর সেই আলো
সন্তানের সঙ্গে মায়ের অনুভবের সম্পর্ক গর্ভ থেকেই। পৃথিবীতে আসার আগে থেকেই সে তার আসার কথা জানান দিতে থাকে। সন্তানের সঙ্গে মায়েদের টানাপোড়েনের শুরু হয় প্রাণস্পন্দনের শুরু থেকেই। গর্ভাবস্থায় সন্তানের সঙ্গে মায়ের থাকে নাড়ির যোগ। মা-সন্তান দু’জনেই চেষ্টা করে এক অপরকে বোঝার। নিজেদের ঘনিষ্ঠতাও গড়ে তুলতে চায়। ১৮ সপ্তাহ বয়স থেকেই শিশুরা শব্দ শুনতে পায়। তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা কণ্ঠস্বর চিনতে পারে। কোনও কোনও কণ্ঠস্বর শুনলে ভিতরে নড়াচড়া বন্ধ করে দেয়। প্রথমবারের মতো শিশুদের নাড়াচাড়া গর্ভাবস্থায় ১৩ সপ্তাহ বয়স থেকে অনুভব করা যায়। আর যখন তার বয়স ১৮ সপ্তাহ তখন থেকে সে স্পর্শ অনুভব করে। বাইরে থেকে হাত বোলালে সে বুঝতে পারে যে একজন তাকে ডাকছে। কান পাতলেও অনেক সময় তার হৃদস্পন্দন শোনা যায়। তাই গর্ভাবস্থায় সন্তানের সঙ্গে মায়েরা গল্প করেন। পৃথিবীর আলো দেখার আগে ২৫ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে শিশু গর্ভের ভেতরে এবং বাইরে উভয় ধরনের শব্দের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। মাতৃগর্ভে শিশু আলো অনুভব করে ২৯ থেকে ৩২ সপ্তাহের মধ্যে। অবশ্য জন্মের পরেও তার চোখ বিকশিত হয়ে থাকে। তবে প্রথম ব্যথা বা সংবেদন অনুভব করতে পারে ২৪ থেকে ২৫ সপ্তাহের মধ্যে।
তাই মায়ের অনুভূতি আর শিশুটির অনুভূতি কোথায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কিন্তু পৃথিবীতে আসার পর মায়ের কাছে নানা প্রশ্ন নিয়ে আসে তার সন্তান। সব দুষ্টুমির সাক্ষী মা। ঘুমের আগে গল্প বলার সাথী সেই মা। মায়ের আঁচলের রঙে আর ভেজা চুলের গন্ধে শৈশব কেটে যায়। আসে দুরন্ত কৈশোর।
আরও পড়ুন-আপনি কাপুরুষ! পার্লামেন্টে তোপের মুখে পাক প্রধানমন্ত্রী
কৈশোর : যদি বন্ধু হও
সন্তান এবং মায়ের সম্পর্কের টানাপোড়েনের শুরু কৈশোর থেকে। সেখানে ঢেউ ওঠে বিশ্বাসের-অবিশ্বাসের, ভাল-মন্দের। কৈশোরে সন্তানের ব্যক্তিগত বিষয় নানা কৌতূহল বাড়তে থাকে। মায়েরা সাবলীলভাবে বুঝিয়ে দেন সেকথা। এই সেইসব জবাবের মধ্যেই জীবনের চলার পথে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল তাও শিখিয়ে দেয়। কৈশোরে সন্তানের প্রিয় বন্ধু হতে পারলে অনেক কিছু শুধরে যায়। তবে বন্ধুত্ব মানে শুধু জ্ঞান দেওয়া নয়। সন্তানকে সব কাজে বাধা না দিয়ে সেই কাজের নেতিবাচক দিকগুলো বুঝিয়ে দেন মায়েরা। অনেক সময় ভাল বন্ধু হতে গিয়ে শাসন করা ভুলে যায়। সন্তানকে ভুল পথে যেতে দেখে চুপ করে থাকেন। তাই ঠিক-ভুলের পাঠ্যক্রমটা কৈশোরে ছেলে মেয়েরা বাড়ি থেকেই শেখে। শেখে কোনটা ব্যাড টাচ কোনটা গুড টাচ। শিখিয়ে দেন ব্যাড টাচের পরে কী করা উচিত! উইকএন্ডে কিংবা ছুটিতে সন্তানকে নিয়ে ঘুরে আসা উইন্ডো শপিংয়ে যাওয়া। বাড়িতে যেকথা বলা যায় না বেড়াতে গিয়ে গল্পের ছলে সেই কথা বেরিয়ে আসে। শুধু সন্তানের সমস্যা নয়, মায়েদের জীবনের ভাল-খারাপ অভিজ্ঞতা ব্যর্থতায় কিংবা প্রাপ্তি সব নিয়েই বন্ধুত্বের হাত বাড়ান মা।
এই সময়টা মায়েদের কাছে সবথেকে চ্যালেঞ্জিং। হঠাৎ করে তাঁর সন্তানের খিটখিটে মেজাজ, প্রতিবাদী চরিত্র, খামখেয়ালিপনা, মায়েরা বিভ্রান্ত বোধ করতে থাকে। ছেলে-মেয়েরা নিজেদের বদলে ফেলে হঠাৎ করেই। অযুক্তিকে যুক্তি বলে দেখাতে থাকে। গলা তুলে ভুল কথা বলতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে মায়েরা বেশি শোনার অভ্যাস করেন। কম কথা বলার অভ্যাস করেন। এই পর্যায়ে মা এবং সন্তান উভয় ভাষার ক্ষেত্রে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আক্ষরিক অর্থে সেকথা মনে রাখলে, দু’জনেরই মন খারাপের শুরু হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই মায়ের কাজে সন্তান সমর্থন করে আবার সন্তানের কাজে মা সমর্থন করেন। এই বয়সেই সন্তান স্বাধীনতা চায়। মায়েরা স্বাধীনতা দিলেও কোথাও গিয়ে নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করে। কোথাও গিয়ে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার। একে অপরকে শ্রদ্ধা করাটাই সম্পর্কের ট্রাম্প কার্ড।
যৌবন : নতুন যৌবনের দূত
কৈশোরে টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে নিভৃতে সে প্রবেশ করে যৌবনে। ডুবে যায় কেরিয়ার তৈরিতে। এই পর্বে প্রেম আসে। আসে দায়িত্ব নেওয়ার পালা। সম্পর্কের ঘাত-প্রতিঘাতে তৈরি হয় অন্য আরেক পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক। তারাও তখন নিজেদের সংসার গড়ে তোলে। বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির মাঝে দাঁড়িয়ে সন্তানের সুখ-দুঃখের সাথী হন মা। এখানেই শুরু হয় দুই পরিবারের সন্তানকে নিয়ে অধিকারের লড়াই। মেয়ে এবং বউমা, ছেলে এবং জামাই। সম্পর্কের মধ্যে ওঠাপড়া থাকেই। এই সময় সন্তানের সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক মনে নেওয়ার-মেনে নেওয়ার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক বদলায় ঠিকই। কিন্তু মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক চিরকালীন। বিয়ের পরে মেয়েটির বৃত্তে ঢুকে পড়ে তাঁর স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি এবং সেই সুবাদে আরও অনেক কিছু।
গার্হস্থ্য : ব্যালান্সের খেলা
বিয়ের আগে কলেজের ফর্ম থেকে শুরু করে ইন্টারভিউয়ের টেনশন, প্রোমোশনের আনন্দ… মেয়ের সব অনুভূতি ভাগ করে নেওয়ার মানুষ বলতে মা। বিয়ের পরে সেই দৃশ্যপট বদলে যায়। সময়ের অভাবে চাকরিরত মেয়েটি হয়তো বাপের বাড়ি যায় সপ্তাহান্তে। উপহার নিয়ে যাওয়া যায় তখনই। তবে হাসিমুখে ছেলে-মেয়ের উপস্থিতিই মা-বাবার কাছে সবচেয়ে বড় উপহার।
বিয়ের পরে দায়িত্ব স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায় অনেকখানি। যে ছেলে বা মেয়েটি তাঁর রোজগারের কিছুটা অংশ তুলে দিত মায়ের হাতে, বিয়ের পরে সেই দায়িত্বে যেন ভাটা না পড়ে। চাকরিরত পুত্রবধূর কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য আশা করতেই পারেন শ্বশুর-শাশুড়ি। কিন্তু তাঁদেরও বোঝা প্রয়োজন, পুত্রবধূ বা জামাই হওয়ার আগে সে একটি পরিবারের মেয়ে বা ছেলে। ফলে মা-বাবার প্রতি দায়িত্বে যেন তার ত্রুটি না থাকে। মা-বাবা এবং শ্বশুর-শাশুড়ি— দু’তরফের ব্যালান্স করতে হয় সন্তানকে।
আরও পড়ুন-খাদ্যশস্যের দর নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রকে আর্জি জানাল রেশন ডিলার সংগঠন
বার্ধক্য : পারস্পরিক সম্মানের
দায়িত্ব মানে শুধু আর্থিক ভারবহন নয়। সময়ে-অসময়ে মা-বাবার পাশে এসে দাঁড়ানোটাও বড় ব্যাপার। বার্ধক্যের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো মা-বাবা হয়তো আর সেভাবে ব্যাঙ্কের কাজ করে উঠতে পারেন না। টেক-স্যাভি না হওয়ার দরুন স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত অর্থ এবং সর্বোপরি নিরাপত্তার অভাব… নানা কারণে অল্পেই বড় বিচলিত হয়ে পড়েন। ফলে তাঁদের মানসিক অবস্থা বুঝে, আনুষঙ্গিক বিষয়ে তাঁদের বোঝানোর দায়িত্বও বর্তায় সন্তানের উপরেই। মা-বাবার স্বাস্থ্য নিয়ে শুধু চিন্তা নয়, তাঁদের নিয়মিত মেডিক্যাল চেকআপ করাতে পারেন। পেমেন্ট, রিপোর্ট নেওয়া এবং প্রয়োজনে ডাক্তার দেখানো… পুরো দায়িত্বই নিতে পারেন নিজে।
বাপের বাড়ি যাওয়া মানে শুধুই সারা দিনের ক্লান্তি লাঘব করা বা নিঃস্তব্ধতায় কাটানোর সময় নয়। ছেলে-মেয়েকে বলার মতো হাজারো কথার ঝুড়ি জমে থাকে মা-বাবার মনে। ফলে ছেলে-মেয়ে বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই হয়তো মা-বাবা খুলে বসেন সে-সব গল্পের ঝাঁপি। তাঁরা না শুনলে একাকিত্ব বাড়ে। ফলে ছেলে-মেয়ে বাড়ি ফিরলে তাঁকে সব বলা চাই-ই।
না বলে হঠাৎ করে মা-বাবার কাছে চলে আসার আনন্দই আলাদা। হঠাৎ করে মা-বাবার কাছে এলে মা-বাবার ব্যস্ততা, উজ্জ্বল মুখ… এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি কিছু নেই। সময় পেলে রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া, একসঙ্গে সিনেমা দেখা, পড়ুয়া বাবার জন্য বই, জার্নাল বা রোজ ডায়েরি লিখতে অভ্যস্ত মাকে ঝর্না কলম দেওয়া ছোট ছোট আনন্দ ভাগ করে নিলে তা অনেক বড় হয়ে ওঠে। মা চায় সন্তান তার পাশে এসে বসুক। সন্ধেবেলা মায়ের সঙ্গে মুড়ি-চা খাক। গ্যাস বুক করে দিক। রক্ত পরীক্ষার দিন আর ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিক। তাহলেই মা খুশি। সন্তান যদি মায়ের প্রিয় খাবার নিয়ে আসে মায়ের জন্যে তাহলে তো আর কথাই নেই।
বাস্তবের চোরাবালি
অনেক ক্ষেত্রেই বাবার মৃত্যুর পরে বৃদ্ধ মায়ের সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে সন্তানদের মধ্যে বিবাদ তৈরি হয়। এই বিরোধ মানসিক সমস্যা ও অভিমান তৈরি করলে সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে। মাকে কখনও কখনও বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয়। আবার গ্রামের কোনও পরিবারে কেউ উচ্চশিক্ষিত হয়ে চাকরি লাভ করলেই গ্রামছাড়া হতে শুরু করে। বদলির চাকরি হলে তো কোনও কথাই নেই। একসময় বাবা-মা গ্রামবাসী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তাঁরা। বিয়ের পর শুধু স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শহরবাসী হয়ে পড়েন। সেই পরিবারে যদি স্বামী-স্ত্রী দু’জনই কর্মজীবী হন তাহলে তাঁরা প্রাথমিকভাবে বাবা-মাকেও সাথে নিয়ে শহরে চলে যান। যাঁদের বাবা-মা নেই তাঁরা শ্বশুর-শাশুড়ির দ্বারস্থ হন। তার প্রধান কারণ, নিজেদের ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনা করা। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই কাজে চলে গেলে নিজের বাচ্চাকে তো আর কাজের পরিচারিকার তত্ত্বাবধানে রেখে যাওয়া যায় না। তবুও আজকাল সবার বাবা-মা বা নিকটাত্মীয়রা এ ধরনের সেবা দিতে পারেন না। তাই তাঁদের সাহায্য নিতে হয়।
আমাদের দেশে ডে-কেয়ার সেন্টারগুলোয় উন্নত দেশের মতো সেবা-ব্যবস্থা না থাকায় এ সংকট সামনে আরও বেশি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে থাকবে। হয়তো জাপানের মতো দু’জন চাকুরে সংবলিত পরিবারে সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ নষ্ট হয়ে যাবে। তখন ওদের দেশের মতো আমাদের দেশের জনসংখ্যার হার নিম্নগতি হতে হতে শূন্যের কোটায় নেমে যেতে পারে। অনেক আধুনিক পরিবারে পরিচারিকার কাছে বাচ্চাদের রেখে অফিসে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। তারা বিকল্প হিসেবে বাসায় আধুনিক সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে অফিস থেকে বারবার ক্যামেরার মাধ্যমে শিশুর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। তবে সম্প্রতি এই সিসি ক্যামেরায় ভয়ংকর তথ্য পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন-নাগরিকদের উপর পাক হামলা, সম্প্রীতি নষ্টে টার্গেট ধর্মস্থান, সাহায্য বন্ধ করুক আইএমএফ, বলল ভারত
শেষ পারানির কড়ি
মায়েরা জীবনসায়াহ্নে এসে চেয়ে থাকে, সন্তানের সুখ-সমৃদ্ধির দিকে। নাতি-নাতনির সাফল্যের দিকে। অনেক সময় অবহেলাকে মেনে নেয়— সন্তানকে ভাল রাখার জন্য। দু কামরার ফ্ল্যাটে জায়গা না হলেও, মা চলে যান গ্রামের বাড়িতে বা বৃদ্ধাশ্রমে। সন্তানের জন্যে মাঝে মাঝে চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে। আবার কখনও মাটির একচালা ঘরে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকেন কবে ফিরবে তাঁর একমাত্র ছেলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। যে হাত ধরে হাঁটতে শিখেছিল, সেই হাত ধরেই হাঁটতে শুরু করেন বৃদ্ধ মা। হাঁটার জন্যে না। ওপারের সাঁকো পার হওয়ার জন্যে। একলা এ পাড়ের খেয়ায় তাঁর মন বসে না। ওপারে যেতে যেতে জানু পেতে প্রার্থনা করে— আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। আর সন্তান মাঝরাতে ঘুম ভেঙে শুকতারার দিকে চেয়ে শুনতে থাকে— রেডিওতে হঠাৎ একটা পুরনো
গান— ‘মধুর আমার মায়ের হাসি হোক সে মিছে কল্পনা।’ গান শেষ হতেই স্মৃতিতে ভেসে ওঠে শিউলি তলায় মায়ের শেখানো কবিতা— যেখানেতে দেখি যাহা/ মা-এর মতন আহা/ একটি কথায় এত সুধা
মেশা নাই,/ মায়ের মতন এত/ আদর সোহাগ সে তো/ আর কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!/ হেরিলে মায়ের মুখ/দূরে যায় সব দুখ।