রবীন্দ্র-শরৎ-উত্তর সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক গজেন্দ্রকুমার মিত্র। লিখেছেন সময়ের কথা, সমাজের কথা। এঁকেছেন মধ্যবিত্ত বাঙালি-জীবনের আটপৌরে ছবি। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি রচনা করেছেন প্রবন্ধ। নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন অনুবাদের কাজ। ‘কলকাতার কাছেই’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ‘উপকণ্ঠে’, ‘পৌষ-ফাগুনের পালা’ তাঁকে বিপুল খ্যাতি এনে দিয়েছিল।
তাঁর অলৌকিক গল্পগুলো বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এর আগে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘অলৌকিক সমগ্র’। প্রথম খণ্ডে ছিল তেইশটি গল্প, দ্বিতীয় খণ্ডে কুড়িটি। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘অলৌকিক সমগ্র ৩’। এটাই শেষ খণ্ড। এখানে প্রকাশিত হয়েছে ২৮টি গল্প। কেবল অতিপ্রাকৃত ঘটনার চেয়েও গভীর সামাজিক চিত্র ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রাধান্য পেয়েছে, যা তাঁর অলৌকিক সাহিত্যের এক অনন্য মাত্রা যোগ করে এবং পাঠকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে।
আরও পড়ুন-ডাকা হচ্ছে না শুনানিতে
এই বিষয়ের রচনায় তিনি অতিপ্রাকৃত ঘটনার আড়ালে বাস্তব সমাজ ও সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন। সংকলনের চাওয়া ও পাওয়া, জালিয়াত, মাতাজি, সন্ন্যাসের শুরু, প্রায়োপবেশন, অস্তরাগ, পিতৃ-ঋণ, শাঁখের আঙটি, অনর্থক, সময়ের বৃন্ত হতে খসা, অন্তহীন যাত্রা, স্বপ্নাতীত, সস্তার বাড়ি, জন্মান্তর?, বায়ুভূতো, সন্ন্যাসের বিষ, এ জন্মের পাওনা, নিরুত্তর, উপস্থিতি ৩, পাষাণদেবতা, পাশের বাড়ির ভাড়াটে, আঁধারের মায়া, ভাঙা মন্দির, হতভাগা, দেবতার রোষ, বাঞ্ছিত দর্শন, সামান্য পথ, ছায়ার মায়া গল্পগুলো ভয় বা রহস্যের ঊর্ধ্বে এক গভীর মানবিক আবেদন দেয় এবং পাঠককে ভাবায়। অলৌকিক গল্পগুলোয় ভূতের ভয় বা নৃশংস বর্ণনার চেয়ে চরিত্রগুলোর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও মানবিক সম্পর্ক বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। প্রচ্ছদ সুব্রত মাজী। দাম ৪০০ টাকা।
দীপ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে সৌভিক চক্রবর্তীর বই ‘নীরেন ভাদুড়ি সমগ্র তৃতীয় খণ্ড’। আছে দুটি উপন্যাস। ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ এবং ‘মহাসিন্ধুর ওপার থেকে মধ্যপর্ব : লাপিস লাজুলি’। আগের দুটি খণ্ড জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। নীরেন ভাদুড়ির পরিচিত ভুবনের সঙ্গে পাঠক পরিচিত। এখানে তন্ত্র ও ভয় সাহিত্যের জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন ফ্যান্টাসির জগতে।
আরও পড়ুন-রবীন্দ্রনাথ নাকি বাংলাভাষার শত্রু, তীব্র নিন্দার ঝড় উঠল বিশ্ব জুড়ে
পল্লব, অমিয়, তিতাস, মিতুল, অপালা, লোকনাথ, গেনুর জগৎ থেকে এবারের পাঠযাত্রা একেবারে অন্য রকম। ‘মহাসিন্ধুর ওপার হতে’-র প্রথম পর্ব যেখানে এক গা ছমছমে, তান্ত্রিক আবহের মধ্যে রেখে গিয়েছিল, সেখানে এর মধ্যভাগ ‘লাপিস লাজুলি’ একেবারে ভিন্ন মাত্রার এক রোমাঞ্চকর কাহিনি উপস্থাপন করেছে। প্রথম খণ্ডে লোকনাথের প্রত্যাবর্তন, তন্ত্রের গাঢ় রং, আর এক প্রাচীন দেবীর জাগরণ—সব মিলিয়ে যে শিরদাঁড়া বেঁয়ে ভয়ের ঠান্ডা স্রোত তৈরি হয়েছিল, মধ্যভাগ হঠাৎই সেই পথ ঘুরিয়ে দিয়েছে। এখানে ভয় বা অতিপ্রাকৃতের উপস্থিতির বদলে পাওয়া গেছে ইতিহাস ও পুরাণের এক জটিল ও সমৃদ্ধ বুনট। হালাকু খাঁ-এর বাগদাদ আক্রমণের নৃশংস ইতিহাস, গিলগামেশ মহাকাব্যের প্রাচীন চরিত্র, দেবী ইনান্নার রহস্য, অমর উত নাপিশতিম এর নৌকা, আধুনিক গ্লোবাল টেররিজম। সবকিছুই যেন এক সুতোয় গাঁথা। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল কোনও ঐতিহাসিক থ্রিলার বা মিথোলজিকাল অ্যাডভেঞ্চার বা স্পাই থ্রিলার অথবা অলৌকিক উপন্যাস। পাঠকমনে ভয় মিশ্রিত আনন্দ ছড়িয়ে দেয়। প্রচ্ছদ সোহম সিনহা। দাম ৫০০ টাকা।

