নবনীতার নারী-ভাবনা

কবিতাই হোক বা গল্প-উপন্যাস, নবনীতা দেবসেনের (Nabanita Debsen) লেখার বড় অংশ জুড়ে আছে নারী। তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্ররা আজন্ম-লালিত সংস্কারকে আঁকড়ে থাকার পাশাপাশি সংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে খুঁজেছেন উত্তরণের পথ। আগামী কাল সাহিত্যিকের জন্মদিন। তাঁর নারী-ভাবনার উপর আলোকপাত করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

ভার্সেটাইল সাহিত্যিক ছিলেন নবনীতা দেবসেন। কবিতা লিখেছেন। পাশাপাশি লিখেছেন গল্প-উপন্যাস। তাঁর ব্যক্তিগত গদ্য এবং ভ্রমণ বিষয়ক লেখাগুলোও তুলনাহীন। ছোটদের জন্যেও কম লেখেননি। সবকিছুতেই ছিল তাঁর অনায়াস বিচরণ। যতটা ধ্রুপদী, ততটাই জনপ্রিয়। আধুনিক বা সমকালীন। উচ্ছল, সহাস্য, সুদূরপিয়াসী। কখনও তির্যক, কখনও ক্রুদ্ধ। প্রয়োজনে অতি মাত্রায় কঠিন, কঠোর।
তাঁর লেখার বড় অংশ জুড়ে আছে নারী। কবিতাই হোক বা গল্প-উপন্যাস। গল্পসমগ্রে রয়েছে অসাধারণ কিছু গল্প। অধিকাংশ নারী মধ্যবিত্ত শ্রেণির। আজন্ম-লালিত সংস্কারকে আঁকড়ে থাকার পাশাপাশি সংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে খুঁজেছেন উত্তরণের পথ। তাঁরা মূলত জীবনের কথা বলেন।

আরও পড়ুন-স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে ঋণ দিয়ে রাজ্যে প্রথম বীরভূম জেলা

‘গদাধরপুর উইমেন্স কলেজ’ গল্পের কথক একজন নারী। তিনি চান আত্মপ্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক মুক্তি। স্বামীর সংসারে অস্তিত্বহীন স্ত্রীর চরিত্র প্রথমদিকে তাঁর ভাল লাগলেও, একসময় খারাপ লাগতে থাকে। তিনি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান। কিন্তু সংসার ভেঙে নয়, সংসারে থেকেই।
‘এক্সপেন্স একাউন্ট’ গল্পে দেখা যায় একজন ছোট পিসিকে, যিনি ঐতিহ্যে বিশ্বাসী। হঠাৎ বদলে যাওয়া কলকাতাকে দেখে কষ্ট পান। পারেন না মেনে নিতে। সুকৌশলে চারপাশের মানুষগুলোকে গৌরবময় অতীতের কথা শোনান।
‘বিমাতা’ গল্পে আছেন তাপসী। এই নারী স্বামী-পরিত্যক্তা। ভাবেননি দ্বিতীয় বিয়ের কথা। বরং স্বামীর মাকে নিজের মা জ্ঞানে সম্মান করেন। অর্থাৎ প্রতিহিংসা নয়, মানবিক মূল্যবোধের ছবি আঁকা হয়েছে। এমনকী স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তানকেও নিজের করে নিতে চেয়েছিলেন এই নারী।

আরও পড়ুন-মেলবোর্নে আজ নাগালের ম্যাচ, ডোপিংয়ের বিরুদ্ধেও লড়াই সিনার ও ইগার

এক সাধারণ গৃহবধূর অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প ‘দাদামণির আংটি’। দাদামণির আংটি চুরি গেলে এক বধূ থানায় ডায়েরি করতে যান। কিন্তু থানা ডায়েরি নিতে আপত্তি জানায়। বধূ প্রতিবাদ করেন। সাফ বলে দেন, ডায়েরি না নিলে তিনি নিজেই কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তার নামে এফআইআর করবেন। অসাধারণ গল্প।
‘শুভমিতা প্রোপ্রাইটার’, ‘পরীর মা’, ‘আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন’ গল্পগুলোয় নারীদের বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনও কোনও গল্পে তাঁরাই কেন্দ্রীয় চরিত্র। এই নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে দেখা যায় বহুমাত্রিক রূপ। এঁরা কেউই হিংস্র নন। পুরুষের প্রতি অনীহা বা অশ্রদ্ধা নেই। প্রতিহিংসাও দেখান না। তাঁদের প্রতিবাদ পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। যা কিছু পুরনো তার বিরুদ্ধে।
অসাধারণ রূপকথা লিখতেন নবনীতা। আদর্শ জীবন, আদর্শ মানুষ, আদর্শ সমাজ তৈরির সুযোগ আছে এই ধরনের লেখায়। তাঁর রূপকথার গল্পেও নারীরা কুশীলব। রূপকথায় সাধারণত পুরুষরাই চিরদিন মেয়েদের উদ্ধার করেন, বন্দি করেন, পেটান, কাটেন, কষ্ট দেন। মেয়েরা শুধুই বন্দিনী। ছেলেদের তুলনায় প্যাসিভ। তবে নবনীতার রূপকথায় রানি এসে উদ্ধার করেন রাজাকে। মেয়েদের পজিটিভ ও অ্যাকটিভ রোল তুলে ধরা হয়েছে। বুদ্ধি তাঁদের অস্ত্র। কেন এইভাবে লিখতেন নবনীতা? দুই কন্যার জননী হয়তো মনে করতেন— ছোট থেকেই মেয়েদের বোঝানো দরকার তাঁদের মধ্যেও শক্তি আছে। শুধু রূপ নয়, বুদ্ধি চাই। রূপবতী রাজকন্যা নয়, বুদ্ধিমতী রাজকন্যা চাই। বুদ্ধি, আবেগ, ভালবাসা দিয়ে জয় করতে হবে।
গল্প, রূপকথার পাশাপাশি কবিতার মধ্যে দিয়েও তিনি গেয়েছিলেন নারীশক্তির জয়গান। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লেখা ‘নাজমা’ কবিতাটি পড়লে রীতিমতো শিহরিত হতে হয়।

আরও পড়ুন-শতাব্দীর লজ্জা সিপিএমের কেরলে, পাশবিক অত্যাচার দলিত অ্যাথলিটকে, পাঁচ বছর ধরে ৬২ জনের লাগাতার ধর্ষণ

দীর্ঘদিন রামায়ণ নিয়ে কাজ করেছেন। সীতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ করেছেন রামকথার। গবেষণার জন্য বেছে নিয়েছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর দুই নারীকবিকে। একজন বাংলার, অন্যজন অন্ধ্র প্রদেশের। একেবারে সাধারণ, কিন্তু ব্রাহ্মণ পরিবারের ওই দুই নারীকবি কীভাবে রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন বাংলা আর তেলুগু ভাষায়, সেই গবেষণা করেছিলেন নবনীতা। চন্দ্রাবতী রামায়ণ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ।
মেয়েদের জীবনে অভয় প্রদীপ হয়ে ওঠে নবনীতার লেখা। একজন নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাহিত্যকে বিচার-বিশ্লেষণ করার রসদ পেয়েছিলেন মায়ের জীবন এবং সাহিত্যচর্চা থেকে। নবনীতার মা রাধারানী দেবী ছিলেন সাহিত্যিক। বহু ঝড়ঝাপটা এসেছে তাঁর জীবনে। সবকিছু সামলেছেন হাসিমুখে। নবনীতাও তাই। জীবনে অনেককিছুই পেয়েছেন, আবার হারিয়েছেন। তবে দমে যাননি। যতদিন ছিলেন, সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। নারী সমাজের কাছে আদর্শ তিনি। তাঁর নারী-ভাবনা অনেককেই অনুপ্রাণিত করে। আজও।

Latest article