‘হ য ব র ল’-এর কথা মনে আছে?
কথক যখন রুমাল থেকে বেড়ালে পরিণত হওয়া জীবটিকে শুধিয়েছিল, তাকে সে কী নামে ডাকবে, বেড়াল বলেছিল, ‘‘বেড়ালও বলতে পার, রুমালও বলতে পার, চন্দ্রবিন্দুও বলতে পার।” হঠাৎ চন্দ্রবিন্দু কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে বেড়ালটির পরিষ্কার ব্যাখ্যা, ‘চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ, রুমালের মা— হল চশমা।” এটাই নাকি এ-ব্যাপারে সাফ যুক্তি।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর অসন্তোষ প্রকাশ এবং কড়া নির্দেশের পরেই তৎপরতা
এমন ঘোলাটে স্পষ্টতা রাজপথের কর্তব্যপথ নাম গ্রহণের ক্ষেত্রেও। সে-ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য, কর্তব্যপথের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমরা জেনেছি, মোদিজি বলেছেন, আন্দামান দ্বীপের নাম বদলে, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের ঠিকানা রেস কোর্স রোড থেকে বদলে লোক কল্যাণমার্গ করে, ‘বিটিং দ্য রিট্রিট’ অনুষ্ঠানে ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র আর দেশভক্তির গানের সুর বাজিয়ে, নৌসেনার পতাকার নকশা বদলে তিনি গোলামির চিহ্ন মুছে দিয়েছেন।
‘হ য ব র ল’-এর বেড়ালটাও এসব শুনে ফ্যাচফ্যাচ করে বিশ্রীরকম হাসতে শুরু করেছে।
আরও পড়ুন-১৯ নেতা-মন্ত্রীর সম্পত্তি মামলা স্থগিতাদেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট
আর হাসবে না-ই বা কেন?
কর্তব্যপথের সঙ্গে খাস দিল্লিতেই রয়ে গিয়েছে আর একটা রাস্তা। জনপথ। জনতার পথ যেন এবার থেকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেবে মোদি জমানার অসংবেদনশীল রাজপুরুষদের, রাজধর্ম আসলে কী? জনপ্রতিনিধিদের কর্তব্য আসলে কী? স্রেফ আলঙ্কারিক নাম পরিবর্তনে জনতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে না। আসতে পারে না।
এই কথাটা প্রতিপদে জানান দেবে নয়া নামপরিবর্তন।
আরও পড়ুন-হিংসা মামলায় বেকসুর অনুব্রত, কেউ চিরদিন জেলে থাকে না
আসলে নামপরিবর্তন এক্ষেত্রে শাসক শিবির গৈরিক পক্ষের ক্ষমতা জাহিরের একটা চেষ্টা মাত্র। তার বেশি কিছু নয়, কোনও ভাবেই নয়। নাম পরিবর্তন কখনও কখনও জমানার রং বদলেছে বলে নয়া জমানার দেমাক জাহির করার চেষ্টা হয়ে দাঁড়ায়। এখানেও সেটাই হয়েছে।
বিশ শতকে রাস্তার নাম বদল শুরু হয়েছিল ইউরোপে। দক্ষিণপন্থী স্বৈরশাসনের উৎখাত হওয়ার পর। আরও স্পষ্ট করে বললে, প্রথমে জার্মানিতে নাৎসি জমানা খতম হওয়ার পর। তারপর একে একে ইতালি, স্পেন এবং পর্তুগালে এই প্রবণতা দৃঢ়বদ্ধ হয়। এশিয়া ও আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে আরও বহু সংখ্যক রাস্তার নামগুলো বদলে যায়। সদ্য স্বাধীন দেশগুলো গোলামির চিহ্ন মুছতে শুরুতে ওই নাম বদলানোর খেলাতেই মেতে ওঠে। যেন দেখাতে চায়, পরিবর্তিত নামটাই আসলে পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থার লক্ষণচিহ্নের ধারক ও বাহক। পরবর্তী পর্যায়ে রাস্তার নামে পরিবর্তন সোভিয়েত ও পূর্ব-ইউরোপে কমিউনিস্ট শাসনের অবসানের সূত্রে দেখা গিয়েছিল ব্যাপকভাবে। এর ওপর যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষের জমানা ফুরল, তখন দেখা গেল অনেক দেশের মতো সেদেশেও কেবল রাস্তার নামেই বদল ঘটল না, বদলে গেল প্রদেশের নাম, শহরের নামগুলোও— অর্থাৎ, অতীতটা ফ্যাসিবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ কিংবা কমিউনিস্ট, যার সঙ্গে অন্বিত হোক না কেন, দেশের রাজৈনতিক পটপরিবর্তন প্রতিফলিত হয় রাস্তার নামের বদলে, প্রদেশ কিংবা শহরের স্থাননামের পরিবর্তনে।
আরও পড়ুন-বেলডাঙা ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র পেল ‘সুশ্রী’তে সপ্তম স্থান
স্থাননামের পুনঃপুনঃ বদলের সাক্ষী থেকেছে আয়ার্ল্যান্ড, পোল্যান্ড, জিম্বাবোয়ে, সাবেক যুগোস্লাভিয়ার দেশগুলো এবং অতি সম্প্রতি ইউক্রেন। আধিপত্যের লড়াইয়ে বিজয়ী কে আর কে-ই বা পরাজিত, সেকথা বিম্বিত হয় এই স্থাননাম বা পথনাম পরিবর্তনের সূত্রে।
তবে একুশ শতকে এই তত্ত্বে একটি নতুন বিষয় সংযোজিত হয়। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নামবদল। প্রতিষ্ঠানের নামাঙ্কিত রাস্তায় বা উদ্যানে ওই বাণিজ্যিক সংস্থার লোগো থাকবে, তার বিনিময়ে সংস্থাটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে রয়্যালটি বা স্বত্বমূল্য দেবে, এটা একটা স্বীকৃত ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি রাজকোষে দৈন্য যত বেড়েছে, গণপরিষেবা দেওয়ার জন্য আর্থিক সামর্থ্য পুরকর্তৃপক্ষের যত কমেছে, ততই কর্পোরেট স্পনসরশিপের আওতায় এ-ধরনের নামবদল ঘটেছে।
আরও পড়ুন-জোর হাঁস, মুরগি, ছাগল, গরু ও শূকর পালনে, দুধ-ডিমে স্বনির্ভর হবে রাজ্য
রাজপথের কর্তব্যপথে পরিবর্তিত হওয়ার ক্ষেত্রে উল্লিখিত কোনও মাপকাঠিই গ্রাহ্য হয়নি।
রাস্তাটার আসল নাম, ঔপনিবেশিক আমলে ছিল কিংসওয়ে। নিঃসন্দেহে সেই নামে লেগে আছে ব্রিটিশ রাজকীয়তার ছোঁয়া। স্বাধীনতার পর যখন কিংসওয়ের নাম বদলে রাজপথ করা হল তখন সেটা আর যা-ই হোক, কিংসওয়ের নামটির নিছক অনুবাদ বা ভাষান্তর নয়। ‘রাজপথ’-এর ব্যাসবাক্য ‘পথের রাজা’ কিংবা ‘রাজার পথ’ যা-ই করি না কেন, রাজপথ বলতে আমরা বড় চওড়া রাস্তাকে বুঝি যা আসলে গলিপথের ক্ষুদ্রত্বের বিপরীত এবং তার সঙ্গে রাজকীয় পরম্পরার যোগসূত্র পাওয়া সহজ নয়।
আরও পড়ুন-ফের বিরোধী দলনেতাকে গো ব্যাক
সুতরাং ‘রাজপথ’ নামটি বদলে গোলামির চিহ্ন মুছে ফেলার কথা ভাবাটা অনেকটা কষ্টকল্পনা। ঔপনিবেশিক পরম্পরার প্রতি আনুগত্যের মানসিকতা ‘রাজপথ’ শব্দটিতে প্রতিফলিত হয় না। বরং সেটা হয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সখ্যকে তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ ও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জাহির করার মধ্যে। সেটা বরং লুকিয়ে থাকে একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূতের যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হওয়ার সম্ভাবনা লক্ষ্য করে গর্বের ঢেকুর তোলার মধ্যে।
এই কথাটা বোঝার মতো বোধবুদ্ধি মোদিজির আছে বলে মনে হয় না। এই কথাটা বোঝানোর মতো ক্ষমতা তাঁর চারপাশের লোকজনের আছে, এমনটাও মনে হয় না।
আরও পড়ুন-আজ চা-বলয়ে মহাসম্মেলন
মনে হয় না, কারণ, একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোসম্পন্ন গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি রাজ্যের জনগণের ভোটে জিতে আসা সর্বজনগ্রাহ্য মুখ্যমন্ত্রীকে ওই রাজপথের কর্তব্যপথ হয়ে ওঠার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণপত্র পাঠায় আন্ডার সেক্রেটারির সই করা চিঠি দিয়ে, তথ্য সংস্কৃতি দফতরের মন্ত্রীর করা আমন্ত্রণের মাধ্যমে নয়, তখন বেশ টের পাওয়া যায়, ঔপনিবেশিক শাসকের দল ভারতছাড়া হলেও ঔপনিবেশিক শাসকের স্বৈরাচারী মানসিকতা জাঁকিয়ে বসে আছে বর্তমান শাসক পক্ষের ভাবে ও ভঙ্গিতে।
আরও পড়ুন-গঙ্গাভাঙন রুখতে তৎপর প্রশাসন
চেন্নাই, কলকাতা মুম্বইয়ের নাম বদলে না হয় ঔপনিবেশিক অতীতের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব প্রকাশ করা যায়। এলাহাবাদ, মোগলসরাই, আহমেদাবাদ কিংবা মুজফফরনগরের নাম বদলে না হয় ইসলামি অতীতকে মুছে ফেলে হিন্দি-হিন্দুত্বকে জাহির করা যায়। আওরঙ্গজেব রোডের নাম বদলে এপিজে আবদুল কালামের নামে রাস্তার নামকরণ করলে সেখানেও একটা পরিচ্ছন্ন যুক্তি কাজ করে।
কিন্তু রাজপথকে কর্তব্যপথ নামাঙ্কিত করলে মোদিবাজিতে আমোদিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই হয় বলে মনে হয় না।
ওই যে বেড়ালের নাম চন্দ্রবিন্দু হলে চন্দ্রবিন্দুর ‘চ’, বেড়ালের তালব্য ‘শ’ আর রুমালের ‘মা’ জুড়ে ‘চশমা’ হওয়ার মতো ব্যাপার আর কী!
সুকুমার রায় বোধহয় আগেভাগেই এমন আগামীর আন্দাজ পেয়েছিলেন!
আসুন, ফ্যাচফ্যাচ করে খানিকটা হেসে নেওয়া যাক।