ভুলতে পারি নিজের নাম, ভুলব নাকো নন্দীগ্রাম

১৪ মার্চ, ২০০৭, জমি রক্ষার আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের গুলিচালনার ফলস্বরূপ রক্তে দখল হয়েছিল মুক্তাঞ্চল। হাড় হিম করা সন্ত্রাসের দিনগুলো ফিরে দেখলেন সাংসদ দোলা সেন

Must read

২০০৬ সাল। সপ্তম বামফ্রন্ট বিপুল জয়লাভ করে আবার ক্ষমতায়। রতন টাটাকে পাশে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু শপথ গ্রহণের পরমুহূর্তেই ঘোষণা করলেন, বাংলায় এবার শিল্পায়নের বন্যা বইবে।

আরও পড়ুন-ইডি-সিবিআইয়ের অতি সক্রিয়তার বিরুদ্ধে বিধানসভায় প্রস্তাব তৃণমূলের

সিঙ্গুরে টাটাবাবুরা গাড়ি কারখানা করবেন, নন্দীগ্রামে সালিমরা SEZ করবেন, আরও কত কী! শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের ছড়াছড়ি একেবারে! শুধু তাই নয়, এতবছর বাদে রাজ্যে শিল্প আসছে! রাজ্যের মানুষকে একটু Sacrifice করতে হবে না! তাই সিঙ্গুরে ১০০০ একর বহুফসলি জমি দখল, নন্দীগ্রামে গ্রামকে গ্রাম, বসতি কে বসতি উজাড় করে, মন্দির-মসজিদ-স্কুল-হাসপাতাল— সব বরবাদ করে দিয়ে ১৪,০০০ একর বাস্তুজমি অধিগ্রহণ! দখল করতে এল কে? কেন? মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর ৭ম বারের বামফ্রন্ট সরকার! একগুঁয়ে egoistic বুদ্ধবাবু গোঁ ধরে বসে আছেন, সালিমবাবু-টাটাবাবুরা ছোট্ট বাচ্চা ছেলে, ললিপপ চেয়েছে, আমি বুদ্ধবাবু, সাতবার জেতা বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী! আমি তো এটা দেবই! নইলে চলবে কেন? কিন্তু, চিরকালই পৃথিবীর ইতিহাসে হিটলাররা নয়, তুঘলকরা নয়, বুদ্ধবাবুরা নয়, মোদিবাবুরা নয়, স্বৈরতন্ত্রী-অত্যাচারী-মর্জিবাদ শাসকরা নয়, মানুষ, হ্যাঁ, মানুষই শেষ কথা বলেন।

আরও পড়ুন-গোল্ডেন গ্লোবের পর অস্কার জিতল ‘আরআরআর’ ছবির গান ‘নাটু নাটু’

সেই মানুষ প্রথমে সিঙ্গুরে বললেন, ‘জান দেব, তবু জমি দেব না।’ লাঠি-গুলি-বেয়নেট ইত্যাদি প্রভৃতি তুচ্ছ হলে, হার না মানা প্রতিবাদে জেহাদ ঘোষণা করলেন মানুষ, মাথা নোয়ালেন না। তারপর নন্দীগ্রামও একই সুরে চিৎকার করে উঠল— ‘জান দেব, তবু জমি দেব না!’ সিঙ্গুরে সেপ্টেম্বর, ২০০৬ থেকে, নন্দীগ্রামে জানুয়ারি, ২০০৭ থেকে আগে বুদ্ধবাবুরা পার্টিকে কাজে লাগালেন। ঘরদোর জ্বালিয়ে দিয়ে, গুলি চালিয়ে মেরে দিয়ে, পিটিয়ে হাওয়া করে দিয়ে চেষ্টা আর গায়ের জোর দলের দিক থেকে বেড়েই চলল।

আরও পড়ুন-সময়ের অভাবের জন্যই গিলোটিনে ৩৩টি বাজেট

রাজকুমার ভুল, তাপসী মালিক, ভরত মণ্ডল, বিশ্বজিৎ মাইতি, শেখ সেলিম, অরূপ দাস, ৭ম বামফ্রন্টের সিপিএম দলের দৌলতে শহিদের রক্তে লাল হলে সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম… তবুও নতিস্বীকার নেই, বুদ্ধবাবুদের গোঁ গেল বেড়ে, রাগ তো হওয়াই স্বাভাবিক! দলকে কাজে লাগিয়ে, মেরেধরেও কাজ হচ্ছে না দেখে বুদ্ধবাবুরা ভাবলেন, বেশ, সরকার জমি অধিগ্রহণ করে দেখিয়ে দেবে, সরকারি পদক্ষেপ শুরু হল। ১৪ মার্চ হল সেই দিন, যেদিন বুদ্ধবাবুর সরকার, প্রশাসন, তার সংগঠিত পুলিশ বাহিনী গুলি চালিয়ে, কুকুর-বেড়ালের মতো মানুষ মেরে, কাঁদানে গ্যাস দিয়ে চারদিক অন্ধকার করে, আক্রান্ত নিরীহ নারী-পুরুষকে নিশ্চিন্তে জলে ভাসিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে প্রমাণ করতে চাইল, দেখো, সরকারের কী ক্ষমতা! সরকার চাইলে কি না করতে পারে!

আরও পড়ুন-সিএএ প্রয়োগ করলে রাজ্য ছাড়া করব: উদয়ন

২০০২-এ গুজরাতের গণহত্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ২০০৭-এ বুদ্ধবাবুদের ৭ম ‘বামফ্রন্ট’ সরকার প্রমাণ করতে উদ্যত, দেখো, গণহত্যায় আমরাই বা কম কীসে! মানুষের দ্বারা নির্বাচিত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে দেখালে, হাড় হিম করা genocide-এ গুজরাতের কান্ডারিদের থেকে বামফ্রন্টের কান্ডারিরা বাংলায় পিছিয়ে নেই!

আরও পড়ুন-সরকারি জমি দখল করে বাড়ি কংগ্রেস নেতার

অথচ, কী জন্য সরকারকে এই গণহত্যা সংঘটিত করতে হয়েছিল, ১৪ মার্চ, ২০০৭? কী এমন প্ররোচনা ছিল মানুষের দিক থেকে? নন্দীগ্রামের সাধারণ মানুষ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে একটাই কথা ভেবেছিলেন, ১৪,০০০ একর এলাকাকে তাঁরা সরকারকে এমন অন্যায় জুলুম করে মনমর্জি দখল করতে দেবেন না! তাই, সরকার ক্রমশ অনমনীয় হয়ে যাচ্ছে দেখে, হুঙ্কার দিচ্ছে শুনে, ১৪ মার্চ সাধারণ মানুষ, মা-ভাই-বোনেরা সেদিন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাই সকাল থেকেই আজানের ধ্বনির পরে নামাজ পড়া হচ্ছিল একদিকে, আবার পাশেই হরিনাম সংকীর্তন— হরিনাম শুরু হয়েছিল। নিরপরাধ, নিরস্ত্র, শান্তিপূর্ণ, নিজের ভিটেমাটিকে দখল করতে দিতে না চেয়ে নিজের নিজের আরাধ্য দেবতার কাছে মানুষ নিজের নিজের ধর্মমতে উপসনারত মানুষকে একগুঁয়ে, অন্যায়কারী, স্বৈরচারী বুদ্ধবাবুদের সরকারের পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় অন্ধকার করে দিয়ে ওই প্রার্থনারত মানুষদের বাড়ি চলে যাবার সুযোগও দেয়নি, মুহূর্তের মধ্যে ওই পুলিশের গুলিবৃষ্টি শ’য়ে শ’য়ে মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে।

আরও পড়ুন-পঞ্চম দোলে মেতেছেন মুর্শিদাবাদের হিলোরাবাসী

সেলাম জানাই, প্রণাম জানাই, সেই নন্দীগ্রামের মাকে, মাটিকে, মানুষকে, তবুও এই সরকারি গণহত্যার পরেও, যারা মাথা নুইয়ে, নিজের জমিকে— নিজের মাকে দখল করতে দেননি।
আমার পরম সৌভাগ্য, সেদিন আমি থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম, তাই স্বচক্ষে দেখেছি, এক এবং একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কালীঘাট থেকে প্রেস কনফারেন্স করে নন্দীগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন বেলা ১২টায় এবং কোলাঘাট-নিমতৌড়ি-নন্দকুমার-তেরপেখ্যা-চণ্ডীপুর— অজস্র জায়গায় অবরুদ্ধ হতে হতে, আক্রান্ত হতে হতে রাত ২টো বেজেছে, নন্দীগ্রামে পৌঁছতে পারেননি, তবু হার মানেননি। তিনি মানুষের এক অসামান্যা নেত্রী বলেই ওই আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াবার জন্য সকাল থেকে মাঝরাত— চেষ্টা চালিয়েছেন এবং তাঁর সঙ্গেই একের পর এক মিডিয়ার গাড়ি যোগ দিয়েছে, লাইন বড় হয়েছে।

আরও পড়ুন-বিপন্ন ভারতীয় গণতন্ত্র, বিপন্ন সাংবিধানিক কাঠামো

তাঁর ভরসাতেই প্রেসের বন্ধুরাও পৌঁছতে চেষ্টা করার সুযোগ পেয়েছেন, তারপর রাত ২টো থেকে ভোর ৫টা পুরোটাই জেগে থেকে তমলুক হাসপাতাল, মর্গে ঢোকার চেষ্টা করেছেন, কতজন মারা গেছেন, তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে আবার সঙ্গের মিডিয়ার বন্ধুরা যাতে রাতে একটু স্নানাহারের বা সামান্য বিশ্রামের সুযোগ পান, অভিভাবকের মতো তারও দায়িত্ব নিতে হয়েছে। ভোর হতে না হতেই আবার সকলকে নিয়ে নন্দীগ্রামে পৌঁছবার চেষ্টা ও আবারও রেয়াপাড়া, হাঁসচড়ায় আক্রান্ত-অবরুদ্ধ হতে হতে অবশেষে একটু বেলার দিকে মানুষের সঙ্গেই নন্দীগ্রামে পৌঁছনো নন্দীগ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়াতে। ওই এক এবং একজন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই দেখেছি, সিঙ্গুরের জন্য ২৬ দিনের ঐতিহাসিক অনশনের মাধ্যমে সিঙ্গুরের পাশে দাঁড়াতে, আবার তাঁকেই দেখেছি, ওই ১৪ মার্চ, গণহত্যার দিন নন্দীগ্রামের মানুষের পাশে নিজের জীবন বিপন্ন করে দাঁড়াতে।

আরও পড়ুন-ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে আজ সামনে হায়দরাবাদ

তাই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মানুষের এই হার না মানা লড়াইয়ের সঙ্গে মানুষের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগ্রামী ভূমিকা, নেতৃত্বদায়ী ভূমিকা, লড়াকু মনোভাব, মানুষের সংগ্রামে নিজেদেরকে ‘of the people, for the people, by the people’ করে তোলার ভূমিকা সারা জীবন ইতিহাসে লেখা থাকবে।

আরও পড়ুন-গ্রেফতার চাই শুভেন্দুর

শেষ করার আগে একটা কথাই বলব, ১৪ মার্চ ১২টা থেকে রাত ২টো, এবং তারপর ১৪ মার্চ সারারাত এবং তারপরে ১৫ মার্চ ভোর থেকে বেলা-দুপুর— পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাট, নিমতৌড়ি, মেচেদা, নন্দকুমার, চণ্ডীপুর, তমলুক, রেয়াপাড়া, হাঁসচড়া, নন্দীগ্রাম— সর্বত্র মানুষের পাশে সবার আগে পৌঁছতে উদগ্র ওই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কবীর সুমন, পূর্ণেন্দু বসু, অনুরাধা দেব ও আমি ছাড়া আর কাউকে কিন্তু ত্রিসীমানাতেও দেখা যায়নি, অন্তত প্রচুর প্রচুর উপস্থিত মিডিয়ার বন্ধুরা সেকথা জানেন, আর নন্দীগ্রামের মা-মাটি-মানুষও সেকথা জানে। ইতিহাসে নিশ্চয়ই এ-কথাও লেখা থাকবে। নন্দীগ্রামের শহিদ, শহিদ পরিবার, সংগ্রামী মানুষ ও আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রণাম ও সেলাম জানাই। ‘ভুলতে পারি নিজের নাম/ ভুলব নাকো নন্দীগ্রাম!!

Latest article