প্রতিবেদন : বর্তমানে ক্যানসার কথাটির সঙ্গে আমরা সকলেই সুপরিচিত। সভ্যতার অগ্রগতির পাশাপাশি জীবনযাত্রার মান যেমন উন্নত হয়েছে ঠিক তেমনই মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বেঁধেছ। আর তার মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে ক্যানসার। গবেষণা বলছে সারা পৃথিবীতে ক্যানসারের কারণে প্রত্যেক বছরে প্রায় ৭৬ লক্ষ মানুষ মারা যায়, যা সমগ্র মৃত্যুর পরিসংখ্যানের প্রায় ১৩ শতাংশ। তাই উক্ত পরিসংখ্যানের কথা মাথায় রেখেই এই দাবি করা একেবারেই অযৌক্তিক হবে না যে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্যানসারঘটিত এই মৃত্যুর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ১৩১ লক্ষতে। যেটি বিভিন্ন চিকিৎসক তথা বিজ্ঞানীমহলের ঘুম কাড়বার জন্য যথেষ্ট। যদিও ইতিমধ্যেই ক্যানসারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি ইত্যাদির প্রয়োগ সাফল্য পেয়েছে, তবে তার ফল সবক্ষেত্রে খুব একটা আশানুরূপ নয় বলাই শ্রেয়। এমনকী এই সমস্ত চিকিৎসায় রোগীর দেহে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ারও সৃষ্টি হয়। যা রোগীকে আরও অসুস্থ করে তোলে। তাই এককথায় ক্যানসার নামক ব্যাধির সম্পূর্ণ নিরাময় যে আমাদের নাগালের বাইরে সেটা অস্বীকার করার কোনও জায়গাই নেই। তবে এই অবস্থায় ন্যানোটেকনোলজি কীভাবে আমাদের আশার আলো দেখিয়েছে, তারই উত্তর খুঁজতে আজ এই আলোচনা।
ন্যানোটেকনোলজির প্রাথমিক ধারণা
‘ন্যানো’ কথাটি একটি গ্রিক শব্দ যার অর্থ ‘ক্ষুদ্র’। আমেরিকার এক পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান ১৯৫৯ সালে সর্বপ্রথম ন্যানোটেকনোলজি বা ন্যানোপ্রযুক্তির ধারণা দেন। এই ন্যানোটেকনোলজি বা ন্যানোপ্রযুক্তি হল সাধারণত কোনও বস্তুকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাত্রায় (ন্যানোমিটার) তার রাসায়নিক প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য তথা ক্রিয়াশীলতাকে সম্পূর্ণরূপে অক্ষুণ্ণ রেখে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ করার পদ্ধতি। ন্যানোটেকনোলজিতে ব্যবহৃত যেকোনও বস্তুর (ন্যানোমেটেরিয়াল বা ন্যানোপার্টিক্ল) আকার হয় ১-১০০ ন্যানোমিটার (nm)-এর মধ্যে যা এর মূল নির্ণায়ক। যদি ১nm=১০-৯m হয়, তা হলে এই ন্যানোপার্টিক্ল-এর আকার যে আমাদের একটি চুলের প্রস্থের ১০০,০০০ ভাগেরও কম হবে সেটি বলা একেবারেই অত্যুক্তি হবে না। আকার ছাড়াও মূল যে ভৌত ধর্মগুলি ন্যানোপার্টিক্ল-কে সর্বগ্রাহ্য করে তুলেছে সেগুলি হল এর যত্রতত্র বিনা বাধায় বিনা সাহায্যে গমনের ক্ষমতা, আয়তনের তুলনায় বিশাল ক্ষেত্রফল এবং এর কোয়ান্টম ধর্ম। ইতিমধ্যেই উক্ত ধর্মগুলির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন রকমের জ্বালানি কোষ, ব্যাটারি, মহাকাশযানের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক শিল্পক্ষেত্রে, কম্পিউটারের চিপ তৈরিতে, মোটর গাড়ি শিল্পে, নির্মাণ শিল্পে, আলোকবিদ্যায় ইত্যাদি প্রায় সমস্ত ক্ষেত্র-সহ সর্বোপোরি ঔষধ শিল্পেও এর ব্যবহার দেখা যায়।
আরও পড়ুন : পুজোর পরে এভাবেই ফিরুন অনিয়ম থেকে নিয়মে
ক্যানসার চিকিৎসা পদ্ধতিগুলি কোথায় পিছিয়ে
কেমোথেরাপি : ক্যানসারের প্রথম ধাপই হল টিউমার। তাই অনেক ক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে প্রথমেই এটি বাদ দেওয়া হয় পরে বাকি কোষগুলিকে ইন্ট্রাভেনাস (শিরার মাধ্যমে) ইনজেকশনের মধ্যে দিয়ে ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়। আবার অনেক সময় টিউমার বাদ না দিয়েও শুধুমাত্র ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমেই টিউমারে থাকা ক্যানসার কোষগুলিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়। ওষুধের প্রয়োগ দ্বারা ক্যানসারের এই চিকিৎসা-পদ্ধতিই হল কেমোথেরাপি। ত্রুটি : কেমোথেরাপিতে ব্যবহৃত ওষুধগুলি তীব্র বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে যা ক্যানসার কোষগুলিকে ধ্বংস করার পাশাপাশি দেহের সুস্থ স্বাভাবিক কোষের ক্ষতি করে এবং এদের কার্যকারিতায় বিঘ্ন ঘটায়। যতটা পরিমাণ ওষুধ প্রয়োগ করা হয় তার বেশিরভাগটাই অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে তাই ক্যানসার কোষের ধ্বংস সাধন একবারে ঘটে না, বারংবার এটির প্রয়োগ অনিবার্য হয়ে পড়ে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ক্যানসার কোষগুলি বিভিন্ন ড্রাগ বা ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় (multi drug resistance or MDR) শুধুমাত্র কেমোথেরাপির মাধ্যমে ক্যানসার কোষগুলিকে ধ্বংস করা যায় না। এ ছাড়াও একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রযুক্ত ওষুধের দেহ থেকে বহিষ্করণ ঘটায়, অনেকক্ষেত্রেই তা ক্যানসার কোষকে ধ্বংস করার আগেই দেহ থেকে নির্গত হয়ে যায়।
রেডিয়েশন থেরাপি বা রেডিওথেরাপি : উচ্চ তেজস্ক্রিয় ক্ষমতাসম্পন্ন এক্স-রশ্মি, গামা রশ্মি ইত্যাদি প্রয়োগের মাধ্যমে টিউমারে থাকা ক্যানসার কোষগুলির মূলত DNA-কে ধ্বংস করার দ্বারাই ক্যানসার কোষগুলির ধ্বংস সাধন ঘটানো হয়। এর ফলে ক্যানসার কোষগুলির মৃত্যু ঘটার পাশাপাশি টিউমারের আকারও ছোট হতে থাকে। তেজস্ক্রিয় রশ্মি প্রয়োগের দ্বারা ক্যানসারের এই চিকিৎসা-পদ্ধতির নামই হল রেডিয়েশন থেরাপি বা রেডিওথেরাপি। ত্রুটি : কেমোথেরাপির মতোই এটিও ক্যানসার কোষের ধ্বংস সাধনের পাশাপাশি সুস্থ স্বাভাবিক কোষের DNA-কে ধ্বংস করে, ফলে স্বাভাবিক কোষগুলি বিনষ্ট হয়। অনেক সময় তেজস্ক্রিয় রশ্মির প্রয়োগ সুস্থ কোষগুলির নিজস্ব প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটায়, যা পরবর্তীকালে দেহে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তবে উচ্চমানের এই তেজস্ক্রিয় রশ্মিও কিন্তু একেবারে ক্যানসার কোষগুলিকে নির্মূল করতে পারে না তাই এটিরও একাধিক বার প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে।
ইমিউনোথেরা : উক্ত পদ্ধতিগুলির চেয়ে এই পদ্ধতি কিছুটা এগিয়ে বলা যায়। এই পদ্ধতিতে সাধারণত দেহের অনাক্রম্যতন্ত্রকে প্রস্তুত করা হয় ক্যানসার কোষের বিরূদ্ধে লড়াই করার জন্য, যার ফলে তারা অতি সহজেই ক্যানসার কোষকে ধ্বংস করতে পারে। ত্রুটি : কিছু ক্ষেত্রে অনাক্রম্যতন্ত্রের কোষগুলির অতি-সক্রিয়তা নিজের দেহের স্বাভাবিক কোষগুলিরও ক্ষতিসাধন করে ফেলে। তবে তার মাত্রা বাকিদুটি পদ্ধতির তুলনায় খানিক কম বলা যায়।
আরও পড়ুন : আইসিএসই স্থগিত আইএসসি পরীক্ষা
ন্যানোটেকনোলজিকে কেন প্রাধান্য দেব?
ক্যানসার চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত দুটি ওষুধ হল অ্যাবযার্ক্সন (অ্যালবুমিন আবদ্ধ প্যাকলিট্যাক্সল ন্যানোপার্টিক্ল) ও ডক্সিল (লাইপোজোমাল ডক্সোরুবিসিন)। এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার যে, উক্ত ওষুধগুলিকে ন্যানোমিটার মাত্রায় রেখে তাদের হয় দেহজ প্রোটিন অ্যালবুমিন আর নয়ত কোলেস্টেরল ও ফসফোলিপিড নির্মিত লাইপোজোম নামক একটি ক্ষুদ্র থলি (০.০২৫-২.৫ মাইক্রোমিটার)-র মাধ্যমে আবদ্ধ করে রোগীর দেহে প্রবেশ করানো হয়, তাই এদের এরূপ নাম। এই ন্যানোপার্টিক্লগুলি আকারে ছোট হওয়ায় সহজেই যেমন কোষের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে তেমনই কোষের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে এরা অবস্থান করায় ক্যানসার কোষগুলিকে ধ্বংস করার সম্পূর্ণ সুযোগ পায়। শুধু তা-ই নয় এই ন্যানোপার্টিক্লগুলি যেহেতু ক্যানসার কোষকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয় তাই এরা সুস্থ স্বাভাবিক কোষের কোনওরূপ ক্ষতিসাধন করে না। এমনকী এরা আকারে ক্ষুদ্র ও তীব্র ক্রিয়াশীল হওয়ায় ক্যানসার কোষগুলি এর বিরূদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা (Multi Drug Resistance or MDR) গড়ে তোলার কোনও সু্যোগ পায় না বা পেলেও তা এদের ক্রিয়াশীলতাকে কোনওভাবেই অবদমিত করতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা হল, এই ন্যানোপার্টিক্লগুলি এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে ক্যানসার কোষে পৌঁছানোর আগে এরা কোনওভাবেই ক্রিয়াশীল না হয় অর্থাৎ এই ন্যানোপার্টিক্লগুলি কিন্তু ক্যানসার কোষের অবস্থান নির্ণয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আবার এদের ক্ষেত্রফল বেশি হওয়ার কারণে এরা অনেক বেশি কার্যকরও হয়। এ ছাড়াও ন্যানোপার্টিক্লগুলি DNA-তে প্রবেশে সক্ষম হওয়ার দরুন এর মেরামতি বা ধ্বংস দুটিতেই সমর্থ হয়। তা হলে উক্ত আলোচনা থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে কেন আমরা ন্যানোটেকনোলজিকে সবদিক থেকে এগিয়ে রাখছি। প্রথমত এদের ক্রিয়াশীলতা অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় অনেক বেশি আর এরা স্বাভাবিক কোষের কোনও ক্ষতিসাধন না করায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার হারও খুবই কম হয়। অ্যাবযার্ক্সন বা ডক্সিল ছাড়াও গোল্ড বা সিলভার ন্যানোপার্টিক্লও ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এমনকী কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি বা ইমিউনোথেরাপি— এই সমস্ত ক্ষেত্রেই ন্যানোপার্টিক্ল ব্যবহার করে বা উক্ত ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ওষুধগুলিকে ন্যানোমাত্রায় এনে তাদের কার্যকারিতা বাড়ানোর পাশাপাশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যাতে কম হয় সেদিকে লক্ষ রাখা হয়। আসলে ন্যানোটেকনোলজি এমন একটি ধারণা, যেখানে সমস্ত ধরনের বস্তুকে ন্যানোমাত্রায় এনে তাদের কার্যকারিতাকে বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করা হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার সফল রূপদান সম্ভব হয়েছে। যদিও এত স্বল্প পরিসরে ন্যানোটেকনোলজির সমস্ত ক্ষেত্র বলা সম্ভব নয়, তা-ও বর্তমানে উদীয়মান ও বহুচর্চিত এই প্রযুক্তি যে অচিরেই ক্যানসারের পাশাপাশি অন্যান্য যে-কোনও রোগের চিকিৎসায় একটি যুগান্তকারী প্রভাব ফেলবে, সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না।