জাতীয়তাবাদী ছাত্র আন্দোলন, কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবস ২৮ অগাস্ট। বাংলার জাতীয়তাবাদী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে এক গৌরবজনক দিন। অতীতের স্মৃতিকোষ না জাগলে আগামীর রূপরেখা আঁকা যায় না। তাই আজ স্মৃতির ভাঁড়ার উজাড় করে দিলেন প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক (ডক্টর) শিবরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

Must read

২৮ অগাস্ট ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবস (TMCP Foundation Day)। এক দীর্ঘ সংগ্রামের নাম হল ছাত্র পরিষদ। সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল Nationalist Students of India (NSUI)। কিন্তু এটা সরাসরি কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণে ছিল। পরবর্তীকালে ষাটের দশকের মাঝামাঝি যখন অতুল্য ঘোষ পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন, তখন স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠন হিসাবে ছাত্র পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হল। একই সময়ে কেরালায় Kerala Students Union (KSU) প্রতিষ্ঠিত হল। স্বল্প সময়ের জন্য সভাপতি হলেন মুন্না বদালিয়া। পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র পরিষদের দ্বিতীয় সভাপতি ছিলেন অমর ভট্টাচার্য। তিনি জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। বিধানসভার সদস্য হয়েছিলেন। পরবর্তী সভাপতি শ্যামল ভট্টাচার্য। পরবর্তীকালে শ্যামলদা বিরাটির মৃণালিনী দত্ত কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেছেন। শ্যামলদার পরে সভাপতি হলেন প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী। তাঁর দক্ষিণ হস্ত ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। প্রিয়-সুব্রত জুটির নেতৃত্বে প্রথম ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে সারা বাংলায় ব্যাপক ও জোরদার ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। সহযোগী সৌগত (রায়), কুমুদ (ভট্টাচার্য), সুদীপ (বন্দ্যোপাধ্যায়), মিঠুবাবু (দেবপ্রসাদ রায়), গৌতম (চক্রবর্তী) এবং আরও অনেকে। ১৯৬৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র পরিষদ প্রথম অংশগ্রহণ করে। সফলতা আসেনি। কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৯ সালের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র পরিষদ আশাতীত সাফল্য লাভ করে। ছাত্র পরিষদকে একই সঙ্গে সিপিএম ও সিপিআই নিয়ন্ত্রিত দুই স্বতন্ত্র ছাত্র ফেডারেশন এবং নকশালদের সঙ্গে লড়তে হয়েছিল। এই বামপন্থী ও অতিবামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলি নিজেদের মধ্যে মারপিট করলেও ছাত্র পরিষদকে ধ্বংস করার ব্যাপারে এরা ঐক্যবদ্ধ ছিল। নকশাল ছাত্ররা সাধারণ-দরিদ্র মানুষকে আচমকা হত্যা করে, ট্রাম-বাস পুড়িয়ে, প্রধান শিক্ষককে গলা কেটে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়ে ত্রাস, ভয় ও অস্থিরতার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। অপরদিকে প্রিয়দা-সুব্রতদার নেতৃত্বে ছাত্র পরিষদ শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন শুরু করল। ফলে ছাত্র-ছাত্রী ও জনগণের মধ্যে সমর্থন বাড়তে লাগল। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। জাতীয় কংগ্রেসের শোচনীয় অবস্থা। ১৯৭০-এর বিধানসভার মধ্যবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসের আসন নেমে এল ৫৫-তে। ১৯৬৭-এর চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস ১২৭ আসন পেয়ে বৃহত্তম দল হয়েছিল, যদিও কোনও দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কেন্দ্রের অবস্থাও ভাল ছিল না। কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হল এবং ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাল। সিপিআই-সহ বামপন্থীদের সমর্থনে সরকারের অস্তিত্ব কোনওভাবে বজায় থাকল। এই পরিস্থিতিতে ছাত্র পরিষদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হল। প্রিয়-সুব্রত জুটি ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা-প্রেরণার সৃষ্টি করল। মনে পড়ে দক্ষিণ কলকাতার ছাত্র পরিষদের আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল শ্যামাপ্রসাদ কলেজ। মন্টুদার (তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রচেষ্টায় সংগঠন তৈরির প্রক্রিয়া আরম্ভ হল। মন্টুদা ডাকাবুকো ছিলেন। তাঁর সহযোগী ছিলেন লক্ষ্মীদা (লক্ষ্মীকান্ত বসু)। ১৯৭৭ থেকে বিধায়ক ছিলেন। অকালে চলে গেলেন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পরিষদের সঙ্গে ছাত্র ফেডারেশনের সংঘর্ষ তুমুল আকার ধারণ করেছিল। ইতিমধ্যে প্রিয়দার উত্তরাধিকারী হিসাবে সুব্রতদা ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বভার নিয়েছেন। রাজ্য ছাত্র পরিষদের সভাপতি হিসাবে বর্ধমানে গিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেন। বর্ধমানে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নুরুল এবং প্রদীপদা (ভট্টাচার্য) উঠে এলেন। নুরুল প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। এখন বেঁচে নেই। সুব্রতদার পর ছাত্র পরিষদের সভাপতি হল কুমুদ (ভট্টাচার্য)। ততদিন পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ক্ষমতাসীন হয়েছে। কুমুদের পর জয়ন্ত (ভট্টাচার্য), অশোক (দেব), বিভাস (চৌধুরী) সভাপতি হয়েছিল। ইতিমধ্যে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় চলে এসেছে। ছাত্র পরিষদ আবার সরকার-বিরোধী আন্দোলন তীব্র করেছে। এই সভাপতিরা সকলেই প্রিয়দা-সুব্রতদার অনুগামী ছিলেন। বিক্ষোভ-আন্দোলন ছাড়াও ছাত্র পরিষদ কিছু বৌদ্ধিক কাজেও লিপ্ত ছিল। ১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে কয়েক বছর পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র পরিষদের (TMCP Foundation Day) উদ্যোগে ‘অভিযান’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। কলকাতার গোয়েঙ্কা কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক হিরণলাল মজুমদার পত্রিকাটি প্রকাশের মূল দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীকালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষনীতি নিয়ে বেশ কিছু পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল। পুস্তিকা খসড়ার মূল দায়িত্বে হিরণ ছিল। হিরণের পর গোয়েঙ্কা কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন শৈবাল বাপুলি, তারপর দেবাশিস পাঠক। ১৯৮৯ থেকে কয়েক বছর ডামাডোল চলার পর ১৯৯৮-তে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলার ছাত্র আন্দোলন নতুন দিশা পেল। ফিরে এল প্রিয়- সুব্রত জুটির যুগের জোয়ার। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (TMCP Foundation Day) প্রথম সভাপতি ছিলেন বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়, যিনি বর্তমানে কলকাতা পুরসভার অন্যতম মেয়র-পারিষদ। টানা ১০ বছরের মতো সময় তিনি এই পদে ছিলেন। বাসে, লোকাল ট্রেনে, গ্রামাঞ্চলে ভ্যানে চেপে তিনি সারা রাজ্য ঘুরে বিভিন্ন কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ইউনিট গঠন করেছিলেন। ইতিম্যধ্যে আদি ছাত্র পরিষদ কংগ্রেসের মাতব্বরিতে অস্তমিত, সাইনবোর্ডে পরিণত হয়েছে। সবশেষে বলি, প্রিয়দা-সুব্রতদার ছাত্র আন্দোলনের ভাবনা, ঐতিহ্য আজ তৃণমূল ছাত্র পরিষদ বহন করে চলেছে। এই দুই নেতার স্বপ্নের প্রতিফলন হচ্ছে আজও তৃণমূল ছাত্র পরিষদের মধ্য দিয়ে।

আরও পড়ুন-কৃষিমন্ত্রীর সঙ্গে বিজ্ঞানীদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত উন্নতমানের আলু উৎপাদনে নয়া প্রযুক্তি

Latest article