ছায়া গায়েব করার প্রাকৃতিক জাদু

ছায়া নিঃশব্দে আমাদের সঙ্গ দেয়। কিন্তু কিছু বিশেষ দিনে ও স্থানে সেই ছায়াসঙ্গী আমাদের সঙ্গ দিতে পারে না কারণ সে নিজেই উধাও হয়ে যায়! কিন্তু কোন জাদুবলে? এই নিয়ে লিখলেন ভূ-আবহাওয়া ও মহাকাশ বিশেষজ্ঞ ড. বিশ্বজিৎ রায়

Must read

একদিন হঠাৎ দুপুরে আপনি দেখলেন নিজের কোনও ছায়া নেই! বিস্মিত হয়ে ভাবলেন ভূতুড়ে ব্যাপার না তো? না, মোটেও না। এ-এক অদ্ভুত প্রাকৃতিক ঘটনা। নাম ‘Zero Shadow Day’ বা ‘শূন্য ছায়া দিবস’। এই দিনে, দুপুরবেলা সূর্য একদম মাথার ঠিক ওপরে চলে আসে। ফলে, কোনও বস্তু বা মানুষের ছায়া একেবারে পায়ের নিচে পড়ে, দেখা যায় না। ছায়া হয় শূন্য! কিন্তু পৃথিবীর সব স্থানে তা হয় না। কেবলমাত্র নির্দিষ্ট অক্ষাংশের মধ্যেই এমন ঘটনা সীমাবদ্ধ, আর তাতেই বিজ্ঞান ও প্রকৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন।
কী এই ‘শূন্য ছায়া দিবস?’
Zero Shadow Day ঘটে তখনই, যখন সূর্য কোনও স্থানের একেবারে ঠিক মাথার উপরে বা শিরোবিন্দুতে (Zenith Position)-এ থাকে। এর মানে সূর্যকিরণ কোনও কোণ তৈরি না করে সোজাসুজি ওপর থেকে পড়ে, ফলে, ছায়া হয় একেবারে পায়ের নিচে তাই চোখে পড়ে না। ছায়া তখন তৈরি হয় না বলেই একে ‘শূন্য ছায়া’ বলা হয়। এটি ঘটে শুধুমাত্র কর্কটক্রান্তি রেখা (২৩.৫° উত্তর) ও মকরক্রান্তি রেখার (২৩.৫° দক্ষিণ) মধ্যবর্তী অঞ্চলে। এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে বছরে দুবার Zero Shadow Day দেখা যায় কিন্তু কর্কটক্রান্তি (২৩.৫° উত্তর) রেখার ওপর সাধারণত ২১ জুন ও মকরক্রান্তি রেখার ওপর ২২ ডিসেম্বর (অর্থাৎ বছরে একবার ‘শূন্য ছায়া’ দিবস)।
কেন হয়?
পৃথিবীর মেরুদণ্ড ২৩.৫ ডিগ্রি কোণে ঝুঁকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, তাই বছরে দুবার করে সূর্য নির্দিষ্ট অক্ষাংশে ঠিক মাথার উপর আসে। এই সময়ে সেখানে ছায়া ঠিক ৯০° কোণে পড়ে, যা তাত্ত্বিকভাবে ক্ষুদ্রতম ছায়া। নিচের দেওয়া চিত্রটি আমরা বোঝার চেষ্টা করব (চিত্রের সাথেই সারণিতে লেখা)।
কিন্তু ঠিক সেই একই দিনে ঐ অক্ষাংশের উত্তর বা দক্ষিণের স্থানগুলিতে ছায়া পড়বে। চিত্রে নীল দাগ বরাবর ছায়া দেখা যাচ্ছে এবং সেই ছায়াকে সাদা রেখা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ভূগোল বই থেকে আমরা জানি পৃথিবীর অক্ষরেখা ৬৬.৫° কোণে হেলানো, অর্থাৎ উল্লব রেখা থেকে ২৩.৫° (৯০-৬৬.৫ = ২৩.৫) এই কারণে সূর্য পৃথিবীর নিরক্ষরেখা থেকে উত্তরে ২৩.৫° ও দক্ষিণে ২৩.৫° পর্যন্ত তার আপাত গতিপথ সীমাবদ্ধ রাখে ফলে তার আরও উত্তরে বা দক্ষিণে কোথাও কখনও শূন্য ছায়া দিবস হয় না। কিন্তু পৃথিবীর মেরুদণ্ড যদি আরও বেশি ঝুঁকে থাকত (ধরুন প্রায় ৩০০) তাহলে দুই গোলার্ধে ৩০০ অক্ষাংশ পর্যন্ত এই রকম শূন্য ছায়া দিবস পাওয়া যেত।

পশ্চিমবঙ্গে শূন্য ছায়া দিবস
পশ্চিমবঙ্গের এক বিরাট অংশ কর্কটক্রান্তির উত্তরে ও দক্ষিণে অবস্থান করছে। কলকাতার অক্ষাংশ প্রায় ২২.৫৭° উত্তর। অর্থাৎ, কলকাতা কর্কটক্রান্তির সামান্য দক্ষিণে। তাই এখানে প্রতিবছর ১৬ মে ও ২৭ জুলাইয়ের আশেপাশে Zero Shadow Day দেখা যায়। এই দিনে দুপুর ১২টায় সূর্য ঠিক মাথার ওপরে থাকে ফলে কোনও বস্তুর ছায়া হয় না। এছাড়া বাঁকুড়া, বর্ধমান, মালদা, আসানসোল, নদিয়া বা মেদিনীপুরেও এই দিনগুলি আলাদা হয়, কারণ সবার অক্ষাংশ আলাদা (অঙ্ক কষে বের করা যায়)। কিন্তু মনে রাখতে হবে ২৩.৫০ উত্তরে যেসব স্থান আছে (যেমন, বহরমপুর, রায়গঞ্জ, বালুরঘাট বা তারও উত্তরে (মানচিত্রে দেখুন)। তারা কখনও শূন্য ছায়া দিবস পাবে না।
নদিয়ার বেথুয়াডহরি প্রায় ২৩.৫০ উ.-এ অবস্থিত তাই সেখানে তাত্ত্বিকভাবে বছরে মাত্র একবার (মোটামুটি ২১ জুন) শূন্য ছায়া দিবস দেখা যাবে। (‘তাত্ত্বিকভাবে’, ‘মোটামুটি’ ইত্যাদি শব্দ ব্যাবহার করা হয়েছে কারণ কর্কটক্রান্তি রেখা একটি কাল্পনিক রেখা কিন্তু কোনও গ্রাম বা শহরের বিস্তৃতি একটি রেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এছাড়া প্রতি বছর ২১ জুনই ক্রকটক্রান্তির ওপর সূর্য খাড়াভাবে কিরণ দেবে এমনটাও হয় না। কিছুটা এদিক-ওদিক হতে পারে)
শূন্য ছায়ার গুরুত্ব
শূন্য ছায়া দিবস ছোটদের হাতে-কলমে বিজ্ঞান শেখার এক অসাধারণ সুযোগ। স্কুলে বা বাড়িতে একটি খাড়া দণ্ড বসিয়ে দুপুর ১২টার সময় ছায়া মেপে নানা পরীক্ষা করা যায়।
বছরের বিভিন্ন সময়ে ছায়ার দৈর্ঘ্য মেপে ঋতুর পরিবর্তন বোঝা যায়।
প্রাচীন কালে এভাবেই ছায়া মেপে বছরের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। (আমার পরবর্তী লেখায় বিশেষ আলোচনা থাকবে)।
ছায়ার ভিত্তিতে তৈরি করা যায় সূর্যঘড়ি, যা দিয়ে সময় জানা যায়।
ছায়ার সাহায্যে একটি স্থানের অক্ষাংশ পর্যন্ত নির্ণয় করা যায়! (পরবর্তী লেখায় বিশেষ আলোচনা থাকবে)।
এটি কোনও বিরল ঘটনা নয়। সাধারণ মানুষ এমনকী কিছু লেখকও নিজেদের প্রবন্ধে একে বিরল ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন অথচ সেই লেখাতেই পরে লিখেছেন এটি বছরে দুবার হয়, নির্দিষ্ট অঞ্চলে ও সময়ে! এটা হয় তাঁদের অজ্ঞানতা অথবা অনিচ্ছাকৃত বিভ্রান্তির শিকার হওয়া। এটি কোনও বিরল ঘটনা নয়— বরং একেবারে নিয়মিত ও সহজবোধ্য একটি ঘটনা যা ক্রান্তীয় অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। কেউ কেউ আবার এটিকে অলৌকিক মনে করেন বা ভাবেন ‘ছায়া গায়েব’ হওয়া মানেই কোনও অশরীরী প্রভাব কাজ করছে! কিছু কুসংস্কারপ্রবণ মহলে এমন কথা ছড়াতেও দেখা যায়— যা একেবারেই ভিত্তিহীন। আসলে এটি শুধুই পৃথিবীর নিজের কক্ষপথ এবং সূর্যের অবস্থানের এক যৌক্তিক ফলাফল। এর পেছনে কোনও জাদু নেই— আছে কেবল প্রকৃতির চমৎকার ছন্দ আর হ্যাঁ— আছে তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।
উপসংহার
সূর্য, পৃথিবীর ঘূর্ণন, অক্ষাংশ, ঋতু— সবকিছুর সমন্বয়ে তৈরি হয় এই মহাক্ষণ। এটি কেবল বিজ্ঞানীদের জন্য নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও বিস্ময়কর ও রোমাঞ্চকর এবং হাতে কলমে কাজের বাড়তি সুযোগ। একটু আকাশের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি— প্রকৃতির বিস্ময় আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। আর Zero Shadow Day তারই এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

Latest article