হারিয়ে যাওয়া বিয়ের গান

একটা সময় পর্যন্ত বিয়েবাড়ির প্রধান অনুষঙ্গ ছিল বিয়ের গান। অঞ্চলভেদে তার প্রকারভেদ ছিল ভিন্ন ভিন্ন। বিয়ের প্রতিটা পর্বে গাওয়া হত সেই গান। অধুনা যা বিলুপ্ত-প্রায়। ঐতিহ্যবাহী সুপ্রাচীন হারিয়ে যাওয়া বিয়ের গান নিয়ে লিখলেন তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক

Must read

বিয়ে মানেই বাড়ি ভর্তি আত্মীয় সমাগম, হইচই, ঘন ঘন উলু আর শাঁখের আওয়াজ, তেল সিঁদুর ছোঁয়ানো প্রজাপতি আঁকা কার্ড, হরেক কিসিমের কেনাকাটা, গপ্পো আর বিয়ের গান। আজকের দিনে হারিয়ে গেলেও একটা সময় পর্যন্ত সমগ্র বিয়ের অনুষ্ঠান জুড়ে থাকত বিয়ের গান। বাসি বিয়ে, পান খিলি, গায়ে হলুদ, তত্ত্ব তালাশ অর্থাৎ বিয়ের সমস্ত আচার অনুষ্ঠানকে ঘিরে তখন অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত থাকত বিয়ের গান (Wedding Songs)।
আশীর্বাদ থেকে শুরু করে দ্বিরাগমন অবধি প্রতিটি আচার নিয়ে এই বিয়ের গান বাঁধা হত।

ঐতিহ্যের মঙ্গলগান
বাংলা সংস্কৃতির প্রাচীন ঐতিহ্য ছিল বিয়ের গান। বিয়ের গানের (Wedding Songs) সঙ্গে সেই সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ইতিহাস, সাহিত্য, আচার, অনুষ্ঠান সম্পর্কিত পরিচয় উঠে আসত।
প্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের বিয়েতে নাচ-গানের প্রচলন ছিল। আর এটা সাধারণত গাইত অন্তঃপুরের মহিলারা। বিশেষ করে হিন্দু বিয়েতে মেয়েলি আচার অনুষ্ঠানের একটা প্রধান অঙ্গ ছিল মঙ্গল গান। বেশিরভাগ সময়েই পরিবারের বয়স্ক মহিলারা আত্মীয় পরিজন পরিবৃত হয়ে বিয়ের একদিন-দু’দিন আগে থেকেই এই গান গাওয়া শুরু করতেন। কন্যাবিদায় পর্যন্ত চলত এই গান।
বরের বাড়িতে আবার বউ আসার পর সবাই মিলে হত আনন্দ গান এবং নাচ।
আবার এ-ও দেখা গিয়েছে যে গ্রামের বিয়েতে বিশেষ করে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য গীত গাওনি মহিলাদের ডাক পড়ত।
এইধারা অধুনা লুপ্তপ্রায়।
বিয়ের অনুষ্ঠানের এইগান ছিল আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এবং মুখে মুখে প্রচলিত।
ধরা যাক, যে কোনও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে মা, মাসি, পিসিরা যখন বিয়ের অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন তখন তাঁদেরকে ঘিরে থাকে কচিকাঁচারা।
কিছুটা শুনে শুনেই তারা মনের ভেতরে গেঁথে নিত এই সুর ও গানের কথা।
অনেক সময় দেখা দিয়েছে, এতে হয়তো কিছুটা সুরের এদিক-ওদিক হয়েছে, কথার সংযোজন বা বিয়োজন হয়েছে। তবে তাতে মূল গানের রসাস্বাদনে কোনও অসুবিধা হয় না।
বিয়ের গানের রচনা এবং পরিবেশন ও নারীরাই করতেন এবং এর শ্রোতাও নারীই। নারী মনের আনন্দ, বেদনা, হাসি-কান্না, আবেগ, উৎকণ্ঠার আনন্দের প্রকাশ ঘটে এই ধরনের গানে।
পাশাপাশি আবার নতুন দাম্পত্যজীবনের হাসি-ঠাট্টা পরস্পরকে চেনার আনন্দে মিশে থাকে গানের কথায় প্রচলিত সুরে।

কীভাবে বাঁধা হত বিয়ের গান
গবেষক শক্তিনাথ ঝা এই বিষয়ে বলেছেন, ‘বাড়ির মেয়েরা অবসরে কথায় কথায় গানবাদ্য কোনও প্রবাদ বা প্রচলিত কথা নিয়ে আলাপ শুরু হত। তারপর তারা নিজেদের স্বভাবগত কবিত্ব শক্তি দিয়ে এক-একজন মুখে মুখে এক-এক কলি যোগ করত। এভাবেই তৈরি হত এক-একটা গান। আত্মীয়-স্বজনের বিয়েতে সেসব গানই গাওয়ার চল ছিল।’
গ্রামে বিয়ের উৎসবের গানের কথা বা চরণ একসময় এমন ছিল। বর আসার আগে এই গান গাওয়া হত—
‘উলু উলু মাদারের ফুল
বর আসছে কতদূর
বর এসেছে বাগনাপাড়া
বড় বউ গো রান্নাচড়া
ছোট বউ গো জলকে যা।।’
বিয়ের গানের আরেক ঐতিহ্য। দু’জন বা তাশি মেয়ে একেক চরিত্রে অভিনয় করে কৌতুকের ছলে নেচে-গেয়ে চাপানউতোরের মধ্যে দিয়ে সুরে বাঁধা কথোপকথন চালাত।
বিয়ের বিভিন্ন পর্বে নানা আচারকে কেন্দ্র করে গানগুলো বাঁধা হত। অনুষ্ঠান ও গানের কথার মধ্যেও থাকত এক ধরনের ধারাবাহিকতা।
বন্দনা, ক্ষীর খিলানি, ঢেঁকি মঙ্গলার গান, ঝুমুর ডালা, আশীর্বাদ, গায়ে হলুদ, মঙ্গল স্নান, থুবরা বা আইবুড়ো ভাতের গান, ফিরানির গান— এই ভাবে নানা ভাগে অনুষ্ঠানের প্রতিটা পর্বে গাওয়া হত।

বন্দনা
বিয়েতে গানের আসর শুরু হয় বন্দনা গান (Wedding Songs) দিয়ে। এতে ধর্মীয় সামাজিক ও পরিবারের পূজনীয়দের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর রীতি আছে।

ক্ষীর খিলানি
বিয়ের আগের দিন অনেক পরিবারেই পাত্র বা পাত্রকে বাড়ির লোকেরা আত্মীয়-স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশী ক্ষীর, পিঠে-পায়েস, ফল-মিষ্টি ইত্যাদি খাওয়ায়। এই অনুষ্ঠানকে ঘিরেই চলতে থাকে গান।
এই খাওয়ানো নিয়েই প্রত্যেকের ভূমিকা এবং বর বা কনের মনের অবস্থা— এসবই উঠে আসে গানের কথায়।

ঢেঁকি মঙ্গলার গান
বিয়ের আগের দিন বর বা কনেকে আইবুড়ো ভাত বা থুবড়া ভাত খাওয়ানোর নিয়ম সুদীর্ঘ কালের। এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে থাকে নানা আচার।
ঢেঁকিতে চালকোটা দিয়ে শুরু হয় এদিনের পর্ব। এক ধরনের চালের পদ পাকানো। এর জন্যই প্রয়োজন হয় ঢেঁকিতে চাল কোটা। আর এই সময়ই চলে মঙ্গলগীতি।

আলম তলার গীত
এই অনুষ্ঠানে বরের বাড়িতে তৈরি হয় বিয়ের মণ্ডপ বা আলমতলা। এই মণ্ডপে এই বিয়ের সময় ভবিষ্যৎ জীবনের নানা সম্ভাবনা, নানা কিছু নিয়েই গান চলে।

ঝুমুর ডালা
এটা খুবই হইচইয়ের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। খুবই আকর্ষণীয় এই পর্ব। সরষে চালার শির তেল, হলুদ মাখা, পান খিলি, সোহাগ মানানো-সহ প্রত্যেকটা পর্বে ধরে ধরে গান হয়। আত্মীয়-বন্ধুরা আশীর্বাদমূলক গান এই পর্বে গেয়ে থাকেন।
তবে এই পর্বের সবথেকে জনপ্রিয় হচ্ছে গায়ে হলুদের গান (Wedding Songs)।
নানা অঞ্চল ভেদে এই গানের রকমফের রয়েছে।
‘হলুদ বাটো চন্দন বাটো
মেহেন্দি বাটো
বাটো ফুলের মউ
বিয়ের সাজে সাজবে কন্যা
নরম সরম বউ’।

কামান করার গান
কামান অর্থাৎ পাত্র বা পাত্রীকে নাপিত এসে নখ কেটে দেওয়া এটাও একটা পর্ব কিন্তু বিয়ের। এই পর্বেই নাপিতকে কেন্দ্র করে নানা বিদ্রুপ রঙ্গ-তামাশার মধ্যে দিয়ে ছড়া বাঁধা ও গান চলে।
শুধু তাই নয়, নাপিতও আবার প্রত্যুত্তরে নানারকম ছাড়া ও গান করে।

মঙ্গলস্নান বা কলস ভরার গান
নরসুন্দরের কামানের পর থাকে কনের বা বরের স্নানের পালা। বাড়ির মহিলারা পাড়া-পড়শি সবাই মিলে কাছের পুকুর বা কোনও জলাশয় থেকে জল আনতে যায়। এই জল আনতে যাওয়া এবং আসার সময়ই চলে জলভরার গান।

আরও পড়ুন-বিবাহমঙ্গল

আইবুড়ো ভাত বা থুবড়া থালের গান
আত্মীয় পরিজন সমাগমে হয় আইবুড়ো ভাত। আইবুড়ো অবস্থায় একেবারে শেষ পর্বে এই খাওয়া হয়। সামর্থ্য অনুযায়ী যে-যার পরিবারে নানা পদে এই খাওয়া হয়। এক উৎসবের আমেজ তৈরি হয় এই সময়ে।
অঞ্চলভেদে কেউ কেউ আবার এটাকে থুবড়া থালও বলে থাকেন।
নানা বাদ্যযন্ত্র— ঘুঙুর, ঢোল, হারমোনিয়াম নিয়ে মেয়েরা বসে গায় যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠানের গান।
লোকসাহিত্যের মধ্যে সবথেকে প্রচলিত এবং জনপ্রিয় গায়ে হলুদের গান হল—
‘কন্যা ডাক দেও তোর জননী না মাইরে
মাও দিয়া যাওক সোনা মুখে হলদিরে
হলুদা, ডাক দাও তোর জনমদাতা বাপেরে
বাবা দিয়ে যাউক তোর সোনামুখে হলদিরে।’
ধান-দূর্বা-পান-কড়ি ইত্যাদি নিয়ে বিয়ের নাচে অংশগ্রহণও করেন মহিলারা।
‘একটু ঠিক করে নাচরে ভাবের মাল্যানী
একটু গিদার করে নাচরে ভাবের মাল্যানী
তোকে আম বাগানের আম খাওয়াবো এখুনী
তোকে জাম বাগানের জাম খাওয়াবো এখুনী।’
কনের সাজগোজ নিয়েও বাঁধা হত গান। আগেই বলেছি বিয়ের প্রতিটি পর্বেরই থাকত গান। কনের সাজগোজই বা বাদ যায় কেন।
তেমনই এক সুপ্রাচীন বিয়ের গীত—
‘গাও তোলো গাও তোল কন্যা হে
কন্যা গায়ে বিয়ের শাড়ি
এই শাড়ি পিন্দিয়া যাইবেন শ্বশুর বাড়ি
কন্যা হে, গাও তোলো, গাও তোলো কন্যা হে
কন্যা পেন্দ্য নাকের ফুল
পাতাবাহার চিরুনি দিয়া তুলিয়া বান্দো চুল কন্যা হে।’
কেমন সুন্দর ভাবে শাড়ির কথাও গানে এসেছে।
‘তার পরে পর আইলা শাড়ি নাম আসমান তারা সেই শাড়িতে বান্দা আছে আসমানের তারা
তারপরে পরাইল শাড়ি নাম কনকলতা
সেই শাড়িতে লেখা আছে পরীরাণীর কথা।’
আবার কোনও কোনও অঞ্চলে কন্যা বা বরের মেজাজ চালচলন নিয়েও গানের উল্লেখ আছে।
‘দেখছি কন্যার মাথা ভালা ডাব নারিকেল জুড়াবে
দিচ্ছি কন্যার দাঁত ভালা আনারসের দানারে
দামানেরও সাত ভাই সাত ঘোড়া ছুয়ারী
একলা দামান রজার চৌদল চূয়রী
চৌদলের কিনারে পড়ে হীরালাল মতিরে
চল যাই চল যাই দামান দেখিবারে।’

কন্যাবিদায়
বিয়ের গানের সবসময় আনন্দের মুহূর্তের রানি হয় তা নয়, বাংলা সংস্কৃতিতে এই গানে দুঃখের কথা পাওয়া গেছে। পিত্রালয় ছেড়ে যখন শ্বশুরালয়ে যায় কন্যা, তখন এতদিনের চেনা বাড়ি, পরিচিত আবহ ছেড়ে মা-বাবা-ভাই-বোনেদের প্রতি যে একটা মায়ার টান সেটাই তুলে ধরা হয়েছে এই সমস্ত গানে। এইরকম অসংখ্য বিয়ের গান আছে যেখানে কন্যাবিদায়ের কথা আছে এবং কন্যাবিদায়ের সময়ে বাবা-মায়ের যন্ত্রণা, কন্যার মনের দুঃসহ কষ্ট তার বর্ণনাস্বরূপ একটি গান—
“মন বিন্দাইলাম বনে বনে
আরো কান্দন কান্দে গো মায়— ও বনে বনে
আরো কান্দন কান্দে গো মায়— ও নিরালে বসিয়া আরো কান্দ কান্দেগো মা ঠান্ডাতে বসিয়া
মায় ও যদি দরদি হইতো
কোলের ঝি-ধন মায়— ও কোলে তো রাখিত।’
কন্যা বিদায়ের আরও একটি গানে দেখা যায় কন্যা শাড়ি পরে বধূবেশে এসে দাঁড়িয়েছেন বাবা-মা-কাকার সামনে। এটা এমন একটা বেদনাবিধুর সময়, সেই হৃদয়বিদার দৃশ্য গানের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
‘পাটের শাড়ি পিইন্দা গো ঝি ধন
বাবার ছান মন খাড়া গো ঝিধন
হাইস্য মুখে দেও বিদায় বাবা
যাইতাম পরের ঘরেও বাবা
যাইতাম পরের ঘরে।
কারো লাগি পালছিলাম ঝিধন
রাজার চারহি কইরা গো ঝি-ধন
বাদশার চারহি কইরা
পরের পুতে লইয়া না জায় গা ঝি ধন রে
বুকে ছেল দিয়া
মাই ঝাল খালি কইরা…’
কষ্ট করে বড় করা কন্যেকে পরের ছেলে পরের ঘরে নিয়ে যায়। বুকে শেল বেঁধে বাপ-মা-সহ পরিবারের লোকেদের। উপায় নেই। চিরকালের নিয়ম।

আধুনিক বিয়ের গান
আজকের এই উত্তর আধুনিক সময়ে বিলুপ্তির পথে দলবদ্ধভাবে গাওয়া বিয়ের গান।
কালের নিয়ম বুঝি-বা এইরকমই।
ইতিহাস সব সময়ই পরিবর্তনের পথে চলে।
আজকের দিনে জায়গা নিয়েছে অন্য ধরনের গান। গান আজও আছে। কোনও সময় ব্যান্ডপার্টি বাজিয়ে জল সইতে যাওয়া। বাসর রাতে ইয়ারবন্ধুদের নিয়ে গান-আড্ডা। অথবা মেহেন্দি সঙ্গীত। সিনেমার গান বাজিয়ে নাচ। এতে নিজস্বতা নেই। পরিবেশনের ধরন পাল্টেছে।
তবে সে-সময়ের এক জনপ্রিয় গান আজও শোনা যায় তা হল—
লীলাবালী লীলাবালী ভরযুবতী সই মোর কি দিয়া সাজাইমু তোরে…

Latest article