সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি যিনি ভারতের ৫০তম প্রধান বিচারপতিও সেই ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের দুই পালিত কন্যা মাহি এবং প্রিয়াঙ্কা জন্ম থেকেই বিরল এক রোগের শিকার যার নাম নেমালিন মায়োপ্যাথি। প্রচার থাকলেও এই রোগটি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সেভাবে সচেতনতা নেই। শুধু তাই নয় এই রোগ নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে চিকিৎসকদের মধ্যেও। ফলে অভিভাবকদের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অভিভাবকরাও এই রোগ সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত থাকেন না।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী পঞ্চাশ হাজার লোকের মধ্যে একজনের নেমালিন মায়োপ্যাথি দেখা যায়। একে রডি বডি ডিজিজ বা রড মায়োপ্যাথিও বলে। উত্তর আমেরিকার গবেষক পি ই কোহেন এবং জি এম শাই ১৯৬৩ সালে তাঁদের গবেষণাপত্রে রোগটির নামকরণ করেছিলেন নেমালিন মায়োপ্যাথি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিনের বক্তব্য অনুযায়ী, নেমালিন মায়োপ্যাথি শরীরে পেশির সমস্যা বা মাসল ডিসর্ডার। মায়োপ্যাথি শব্দটার অর্থ পেশি-রোগ। এই রোগে মূলত হাড়ের সঙ্গে যুক্ত থাকা পেশিগুলির সমস্যা হয়। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির পেশির ফাইবারগুলোয় সুতোর মতো রড থাকে। যাকে নেমালিন বডিও বলে। এতে হাঁটতে চলতে, হাত পা নাড়াতে, ঘাড় ঘোরাতে, এক্সপ্রেশন দিতে অর্থাৎ এককথায় সচল থাকতে সমস্যাগুলো হয়। চিকিৎসকদের মতে এই রোগে শিশুর সমস্ত স্কেলিটল মাসলসগুলোতেই দুর্বলতা দেখা দেয়। ফলে এই স্কেলেটল মাসলগুলো যেখানে যেখানে রয়েছে যেমন রয়েছে উপরের বাহু, পা, কাঁধ, মুখ, পেলভিস, টরসোয় সমস্যা তৈরি হয়।
আরও পড়ুন-বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বেড়েছে কেন্দ্রের বরাদ্দ! ৫ রাজ্যে বাঘের মৃত্যুর গ্রাফও ঊর্ধ্বমুখী
হালকা ধরনের নেমালিন মায়োপ্যাথি বা জন্মগত নেমালিন মায়োপ্যাথি থাকলে রোগী কারও সাহায্য ছাড়াই হাঁটাচলা করতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুতর অর্থাৎ অ্যামিশ নেমালিন মায়োপ্যাথির কোনও প্রতিকার নেই। অ্যামিশ নেমালিন মায়োপ্যাথি ছাড়া জন্মগত এই রোগে অনেকেই সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে দীর্ঘ জীবন পান।
ধরন
জন্মগত নেমালিন মায়োপ্যাথি : এটি নেমালিন মায়োপ্যাথির সবচেয়ে সাধারণ প্রকার।
ইন্টারমিডিয়েট কনজেনিটাল নেমালিন মায়োপ্যাথি : এতে জন্মগত সাধারণ মায়োপ্যাথির কম উপসর্গ এবং গুরুতর মায়োপ্যাথির বেশি উপসর্গ থাকে।
গুরুতর জন্মগত নেমালিন মায়োপ্যাথি : এই অবস্থা জন্মমুহূর্ত থেকেই দেখা যায়।
শৈশবের শুরুর নেমালিন মায়োপ্যাথি : এই ধরনটা ফুটে ওঠে ১০ থেকে ২০ বছর বয়সের মধ্যে।
প্রাপ্তবয়স্কের নেমালিন মায়োপ্যাথি : এক্ষেত্রে ২০ থেকে ৫০ বছর বয়সের মধ্যে এই রোগ বোঝা যায়।
অ্যামিশ নেমালিন মায়োপ্যাথি : এই ধরনের অ্যামিশ নেমালিন মায়োপ্যাথি শিশুমৃত্যুর জন্য দায়ী হয়।
বুঝতে হবে উপসর্গ
নেমালিন মায়োপ্যাথি নিয়ে জন্মানো শিশুর মায়ের দুধ টানতে অসুবিধে হয়। তখন তাকে টিউবের মাধ্যমে ফিড করানোর দরকার পড়ে। ফলে বাচ্চা রুগ্ণ হয়। ওজন বাড়ে না।
সারা শরীরের পেশি দুর্বল হয়। মূলত মুখ, গলা, বুক ও পেটের অংশ এবং এদের সংলগ্ন অঙ্গগুলোর পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে।
গুরুতর ক্ষেত্রে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত পেশি দুর্বল হয়। ফলে শিশুর শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
পেশি-দুর্বলতা সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে। রোজকার কাজ এই কারণে ব্যাহত হয়।
নেমালিন মায়োপ্যাথি থাকলে খাবার চিবোতে ও গিলতে সমস্যা হয়। যার জন্য পুষ্টির অভাব দেখা যায় বেশিরভাগ রোগীর দেহেই।
নেমালিন মায়োপ্যাথি থাকলে শিশুরা অন্যদের তুলনায় কিছুটা দেরিতে হাঁটাচলা শুরু করে। অনেক সময় হুইলচেয়ার বা ওয়াকারের সাহায্য নিতে হয়।
চেস্ট ইনফেকশন দেখা দিতে পারে এমনকী নিউমোনিয়া পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।
পেশির দুর্বলতার কারণে মুখের মাসলগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। যাকে মায়োপ্যাথি ফেসও বলে। মুখে কোনও অভিব্যক্তি তৈরি করতে পারে না অর্থাৎ এক্সপ্রেশন দিতে অক্ষম হয় নেমালিন মায়োপ্যাথিতে আক্রান্তরা। মুখটা ফোলা-ফোলা হয়।
প্রাপ্তবয়স্কদের নেমালিন মায়োপ্যথির সমস্যার প্রধান লক্ষণ হল শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা।
গুরুতর হতে থাকলে কথা বলায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেরুদণ্ডের অস্বাভাবিক অনমনীয়তা।
বুকের পাঁজরগুলোর অস্বাভাবিকতা আসে।
আরও পড়ুন-অস্কারের নমিনেশন পেল ইমনের গাওয়া গান
পরীক্ষানিরীক্ষা
বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে তাঁরা প্রথমে বংশগত ইতিহাস এবং উপসর্গ শুনে যদি বোঝেন যে নেমালিন মায়োপ্যাথি তাহলে বায়োপসি করতে দেন। বায়োপসিতে মাসল টিস্যুর মধ্যে নেমালাইন বডিকে সঠিক চিহ্নিত করতে পারে। এরপর চিকিৎসা এগোয়।
ইলেক্ট্রোমায়োগ্রাফি বা ইএমজি টেস্ট। এই পরীক্ষা থেকে পেশি এবং স্নায়ু কতটা ভাল কাজ করছে বা কোনও অস্বাভাবিকতা আছে কি না তা বোঝা যায়।
এ ছাড়া এখন জেনেটিক টেস্ট বা ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ নির্ণয় অনেকটাই সহজতর হয়েছে। নেমালিন মায়োপ্যাথির ইতিহাস রয়েছে এমন পরিবারের জেনেটিক টেস্ট খুব জরুরি।
চিকিৎসা
বিভিন্ন ধরনের মাসল থেরাপি, ফিজিক্যাল থেরাপি, স্পিচ থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা হয়। বাইপাপ মেশিন ব্যবহার করলে শ্বাসকষ্টের সমস্যা কমে পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যায়াম করতে পরামর্শ দেওয়া হয় যা মাসল স্ট্রেংন্থ বাড়াতে সাহায্য করে। স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ খুব কার্যকরী এক্ষেত্রে। এছাড়া হাঁটাচলার জন্য বিভিন্ন সাপোর্ট দেওয়া হয়।
উপসর্গ গুরুতর হলে মেকানিকাল ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করা হয় যখন রোগী ঘুমোন তখন যাতে শ্বাস নিতে পারেন।