ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (Netaji Subhas Chandra Bose) এক অবিস্মরণীয় নাম। তাঁর বীরত্ব, আদর্শ ও নেতৃত্ব আজও কোটি কোটি মানুষের মনে প্রেরণা জোগায়। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হল, ভারতের বর্তমান পাঠ্যপুস্তকগুলিতে নেতাজির অবদান ও তাঁকে নিয়ে আলোচনা সীমিত। তাঁর অবদানের তুলনায় যে পরিমাণ তাকে নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত ছিল, তার থেকে আজকের সমাজ বঞ্চিত। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে যেখানে গান্ধী-নেহরু-প্যাটেলদের নিয়ে আলোচনা বিস্তৃত, সেখানে নেতাজির জায়গা ‘‘তোমরা আমায় রক্ত দাও; আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’’তেই সীমাবদ্ধ। ‘ফুট নোট’-এর মতো স্থান পেয়েছেন নেতাজি। এই পরিস্থিতিতে আমাদের সমাজের এক অনুদার সময় এসে উপস্থিত। নতুন প্রজন্মের কাছে এই লড়াকু বীরকে আড়ালে রাখতে চাওয়ার এ এক সঙ্কীর্ণ প্রচেষ্টা।
ভারতের কিছু বোর্ড, যেমন CBSE বা সেন্ট্রাল বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ একটি শিক্ষা বোর্ড, যার পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যবই নির্ধারণে সরাসরি কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ থাকে। এই বোর্ডের অন্তর্গত বিদ্যালয়গুলোতে ব্যবহৃত NCERT-এর বইগুলোতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে (Netaji Subhas Chandra Bose) নিয়ে আলোচনা সীমিত এবং একমুখী। আজাদ হিন্দ সরকার, তাঁর আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বা তাঁর সমাজতান্ত্রিক দর্শন, এসব গুরুত্বপূর্ণ দিক প্রায় উপেক্ষিত। কেন্দ্রীয় সরকারের আদর্শগত অবস্থান ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিল না থাকায় নেতাজির ভাবমূর্তি পাঠ্যক্রমে খাটো করে উপস্থাপন করা হয়—এ এক পরিকল্পিত নীরবতা। CBSE-র পাঠক্রমে নেতাজির উল্লেখ থাকলেও তাঁর অবদান, আজাদ হিন্দ ফৌজ, আজাদ হিন্দ সরকার গঠন, আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টাগুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয় না।
আরও পড়ুন- সকালে গ্রেফতার ছেলে, রাতে পুলিশের জালে মা
ICSE বোর্ডের ইতিহাসের পুস্তকে নেতাজির জীবনী ও কর্মকাণ্ডের কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা থাকলেও অন্যদের তুলনায় তাঁর অবদান সমান গুরুত্ব পায় না।
এবার আসি আমাদের রাজ্য, তথা পশ্চিম বাংলার কথায়। পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ (WBBSE) ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ (WBCHSE) তাঁদের পাঠ্যক্রমে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অবদানকে তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। মাধ্যমিক স্তরের ইতিহাস ও উচ্চমাধ্যমিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ্যক্রমে নেতাজির জাতীয়তাবাদী দর্শন, আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন ও তাঁর আন্তর্জাতিক ভূমিকা নিয়ে তথ্যপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। একাদশ শ্রেণির নতুন পাঠ্যক্রমে নেতাজির রাজনৈতিক মতাদর্শ, কংগ্রেসের সঙ্গে মতবিরোধ, এবং বিকল্প পথ গ্রহণের ব্যাখ্যা শিক্ষার্থীদের সামনে আনা হয়েছে। তাঁর জীবনসংগ্রামকে শুধুমাত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হিসেবে নয়, বরং একজন আদর্শ ও বিকল্প চিন্তাধারার জাতীয় নেতা রূপে উপস্থাপন করার চেষ্টা দেখা যায়। এটা এই পাঠ্যক্রমের একটি প্রশংসনীয় দিক।
আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশার কটক শহর নেতাজির জন্মস্থান এবং তাঁর স্কুল জীবন সেখানেই অতিবাহিত হয়েছিল। সেই কারণে OBSE বা ওড়িশা বোর্ড তাদের পাঠ্যক্রমে নেতাজির জীবনী ও তাঁর অবদানকে সম্মানজনকভাবে উপস্থাপিত করেছে।
অন্যান্য রাজ্যের বোর্ডে নেতাজির উল্লেখ থাকলেও, তাঁর অবদানে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপনা করার প্রশ্নটি বোর্ড ভেদে ভিন্ন।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (Netaji Subhas Chandra Bose) ছিলেন প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতন্ত্রী এবং আন্তর্জাতিকতাবাদী মনোভাবের ধারক। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রে ছিল মানবতা, জাতিভেদ নয়। আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণা দিয়েই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে ধর্ম, বর্ণ, জাতির ভেদাভেদ ছাড়িয়ে সকল ভারতবাসীকে এক ছাতার নিচে এলে তারা দেশকে স্বাধীন করার জন্য লড়বে। কিন্তু আজকের দিল্লির শাসকদের আদর্শ অনেকটাই এই মূল্যবোধের বিপরীতমুখী। আমাদের ভারতের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার যে কতটা ‘হিন্দুত্ববাদের’ প্রবর্তক ও সংখ্যালঘুদের প্রতি তাদের ঘৃণা, তাদের উন্নয়নের প্রতি অনীহা ভারতবাসীর চোখ এড়ায়নি। এটা কোথাও গিয়ে নেতাজির মতাদর্শের সাথে কোনওভাবেই মেলে না।
তিন হাজার ভারতীয় সৈন্যকে নিয়ে নেতাজির গড়ে তোলা আজাদ হিন্দ বাহিনীতে তিনি প্রথমেই এমন একটা দারুণ কাজ করে ফেলেন যা আজকের দিনেও আমাদের অবাক করে। তিনি বলেছিলেন হিন্দু-মুসলমান-শিখ যে যাই হোক না কেন, সকলে একসঙ্গে খেতে বসবে, সবাই একসঙ্গে থাকবে। জাতপাত নিয়ে ঝগড়াঝাটি-অশান্তি তাঁর অপছন্দের ছিল। নেতাজির সহযোগী আবিদ হাসান প্রথম ভাবেন, সকল ধর্ম সমন্বয়ে এত মানুষ যখন একসঙ্গে থাকবে, তখন আমাদের মূল জয়ধ্বনি হবে ‘জয় হিন্দ’। সৈনিকদের নিজেদের এই ভাবনা দেখে নেতাজি নিজেকে সফল ভাবতে পেরেছিলেন।
নেতাজির দর্শন, ভাষণ ও অবস্থান যদি খুঁটিয়ে দেখা যায়, তাহলে এটা স্পষ্ট হয়—তিনি কট্টর হিন্দুত্ববাদ, সাম্প্রদায়িকতা বা বিভাজনমূলক রাজনীতির একেবারে বিরুদ্ধে ছিলেন। এটাই আজকের শাসক শ্রেণির জন্য অস্বস্তির জায়গা।
নেতাজি সবসময়ই বিশ্বাস করতেন, ভারতের মুক্তির পথ ধর্মনিরপেক্ষতা ও সর্বধর্ম সমন্বয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান—সব ধর্মের মানুষেরা একসঙ্গে লড়াই করেছিলেন, এবং তিনি একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন, “আমরা এমন একটি ভারত গড়তে চাই, যেখানে হিন্দু, মুসলিম, শিখ—সবাই সমান অধিকার পাবে।” তিনি আরও বলেন, ‘‘ধর্মকে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া উচিত। ধর্ম ব্যক্তিবিশেষের বিষয় হওয়া উচিত, ব্যক্তি হিসেবে মানুষ যে ধর্ম পছন্দ করে তাহা অনুসরণ করা পূর্ণ স্বাধীনতা থাকিবে, কিন্তু ধর্মীয় কিংবা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের দ্বারা রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত নয়। ইহা পরিচালিত হওয়া উচিত শুধু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক বিচারবুদ্ধির দ্বারা।’’
এই আদর্শ বর্তমান উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ঠিক বিপরীত, যেখান থেকে ধর্মের ভিত্তিতে জাতীয়তা নির্ধারিত হয়।
আমাদের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার যে রাজনৌতিক দলের সরকার, সেই বিজেপি হল ভারতীয় জনসংঘের ধারাবাহিক উত্তরসূরি, আর শ্যামাপ্রসাদ সেই ধারা ও চিন্তার আদিপুরুষ। বিজেপি তাঁকে তাদের আদর্শিক পথপ্রদর্শক মনে করে। অনেক বক্তৃতা ও নির্বাচনী প্রচারে তাঁকে‘বিজেপির আদ্যপুরুষ’ বলেও অভিহিত করা হয়।
শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন হিন্দু মহাসভার সদস্য, যিনি নেতাজির সঙ্গে একাধিকবার আদর্শগত বিরোধে জড়িয়েছেন। নেতাজি কলকাতায় যখন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক হিসেবে শ্যামাপ্রসাদের নিয়োগের বিরুদ্ধে ছিলেন, তখন থেকেই তাঁদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। নেতাজির মতে, শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের জায়গা নেই।
নেতাজি কট্টর হিন্দু মহাসভার ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য ক্ষতিকর মনে করতেন। তিনি সর্বদা একটি inclusive secular India-র স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে কোনও ধর্মের আধিপত্য থাকবে না।
এই আদর্শিক অবস্থানগুলো বর্তমান শাসক দলের ইতিহাসবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ আজ যেভাবে পাঠ্যক্রমে ইতিহাসকে পুনর্লিখন করা হচ্ছে, তাতে এমন একজন নেতা যিনি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও একচেটিয়া জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন, তাঁকে একদম সামনে নিয়ে আসা আজকের শাসকদের নিজস্ব রাজনীতির জন্য অস্বস্তিকর। তাই তাঁর গল্প হয় ‘ছোট্ট অনুচ্ছেদে’ গুম করে দেওয়া হয়, নয়তো ‘ঐতিহাসিক বিতর্ক’ বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়।
এই কথাগুলো আমাদের পাঠ্যপুস্তকে নেই। আর যতদিন তা না থাকবে, ততদিন ইতিহাসের একটি বড় অধ্যায় থাকবে অন্ধকারে। সময় এসেছে, ইতিহাসে সত্যকে ফিরিয়ে আনার। সুভাষচন্দ্র বসুকে পাঠ্যপুস্তকে শুধু ‘উল্লেখযোগ্য’ নয়, ‘অবিচ্ছেদ্য’ করে তোলার। কারণ ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না— শুধু মনে রাখে, কে ছিল, আর কাকে ভুলে যাওয়া হয়েছিল।