যুগপুরুষ শিখিয়েছিলেন, ‘স্বাধীনতা কেউ কাউকে দিতে পারে না। তা কেড়ে নিতে হয়।’ আজকের স্বাধীন ভারতে কেন জরুরি সুভাষ-জয়ন্তী উদ্যাপন?
আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কের চোখে ভেদ ছিল না ধর্মে, ধর্মে। ইত্তেহাদ, এতমাদ, কুরবানি (ঐক্য, বিশ্বাস, বলিদান)-র জন্য সংগ্রামে নেমেছিলেন তিনি। আইন করে ধর্মের নামে দেশের নাগরিকদের বিভাজনের প্রতিবাদে সুভাষচন্দ্রের নাম তাই অনিবার্য আজও।
এমনিতে গান্ধী, সুভাষদের পথে অমিল যথেষ্ট। কিন্তু হিন্দু, মুসলিমের ঐক্যসাধন বা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আপসহীনতায় তাঁদের ১০০ ভাগ মিল। বিজেপি-শিবিরের রাজনীতিটাই হল আবার হিন্দু, মুসলিমের ভেদ ঘটানো। তাই ঠিক এই সময়েই এক নিঃশ্বাসে গান্ধী-সুভাষদের নাম উঠে আসা দরকার। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে গান্ধীজির ঢঙে চরকা কাটতে বা নেতাজি-টুপি (Netaji Subhas Chandra Bose) পরে ছবি তুলতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু সে তো রাজনৈতিক সুবিধাবাদ। তিনি বা তাঁর দল তো সুভাষ বা গান্ধীর পরম্পরার যথার্থ অনুসারী নন।
যুদ্ধবিমুখ বাঙালি জাতি, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর যাঁকে ‘দুধে-ভাতে’ করে রেখে গিয়েছিলেন, বলা যেতে পারে, সেই জাতির একমাত্র ‘বীরপুরুষ’। এই যে ‘বাঙালি যুদ্ধ করতে পারে না’, এই যে আমাদের নামে ‘ভীরু’ বলে অপবাদ, সুভাষচন্দ্র বসুর ‘রণনায়ক’ হিসেবে ভাবমূর্তি, ১৯৪৫ সালে তাঁর ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে আজাদ হিন্দ ফৌজকে নিয়ে পৌঁছে যাওয়া, এ সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ ছিল। বাঙালির যুদ্ধের ইতিহাসে শশাঙ্ক যদি হন সবচেয়ে বড় মাইলফলক, যিনি উত্তর ভারতের দাপুটে রাজা হর্ষবর্ধনকে হেলায় হারিয়ে দিয়েছিলেন, তবে একই সঙ্গে এটাও সত্যি যুদ্ধবিজয়ী শশাঙ্ক নিজের রাজত্বকে উত্তর ভারতে বিস্তৃত করার কথা ভাবেননি। তাই বাঙালির কোনও দিন রণবলে বলীয়ান এমন কোনও নায়ক বা ‘আইকন’ নেই। বারো ভুঁইয়ারা মুঘল সেনাপতি মান সিংহের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত প্রতিরোধ গড়লেন বটে, কিন্তু যুদ্ধে তো শেষ পর্যন্ত সেই দিল্লির মুঘল সম্রাটের রাজপুত সেনাপতিরই জয় হয়েছিল। সুভাষচন্দ্র বসু (Netaji Subhas Chandra Bose) এই বাঙালি লোকগাথায় শুধু নায়ক নন, দুর্ধর্ষ সেনানায়ক। নায়ক হিসাবে যিনি শুধু কংগ্রেস সভাপতি হননি, পরবর্তীকালে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর প্রতিনিধি পট্টভি সীতারামাইয়াকে নির্বাচনে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। শশাঙ্কের হর্ষবর্ধনকে যুদ্ধে পরাভূত করার পরে, ভারতভূমে বাঙালির হৃদয় কুলপতি হিসেবে এ রকম উত্থান আর কোনও রাজনীতিকের হয়নি। ‘ভীরু জাতি’র ‘মিথ’কে চুরমার করে দিয়ে সুভাষচন্দ্র বসুর ছবি সেদিন থেকেই আমাদের হৃদয়ে পাকাপাকিভাবে গাঁথা হয়ে গিয়েছে। তাঁর ‘দিল্লি চলো’ স্লোগান আসলে আহত, অপমানিত বাঙালি জাতির দিল্লি দখলের ডাক।
সুভাষচন্দ্র বসুর ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বা ‘মুসলিম প্রীতি’র কথা সর্বজনবিদিত। তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের যদি একটি ভিত্তি হয় দেশপ্রেম, তবে অপরটি অবশ্যই ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। আর মানবীবিদ্যা চর্চার নিরিখে বলতে পারি, সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর রাজনীতিতে, তাঁর তৈরি সেনাবাহিনীতেও নারীকে আলাদা মর্যাদা এবং গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ওই যে সামরিক উর্দিতে তিনি ভারতীয় নারীকে সাজিয়ে ফেললেন, এবং তাঁদের কুচকাওয়াজে ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’ গাইতে দিলেন— মানতেই হবে, সেই সূত্রে ক্ষমতার অলিন্দে নারীর প্রবেশাধিকারের ছাড়পত্র মিলে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন- মহকুমা হাসপাতালের পরিকাঠামগত উন্নয়নের কাজ শুরু হবে শীঘ্রই : মুখ্যমন্ত্রী
বর্তমানে যখন সমগ্র ভারত সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে দ্রুতবেগে নিমজ্জমান, তখনও যে বাংলাকে জয় করতে সেই রাজনীতির এতখানি বেগ ও অতখানি দুশ্চিন্তা— সেটাই প্রমাণ করে বাংলার ঐতিহ্যের ওই ‘অংশ’টুকুর জোর। বাঙালি এখনও নিজেদের মনীষীদের বলে-যাওয়া কথা ও করে-যাওয়া কাজের সূত্রে নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্নটুকুতেই তার জোর। সংস্কৃতিতে অবগাহন যতই তাচ্ছিল্যকর হোক, সেই সূত্রে অন্তত মানবতাবাদের কিছু উচ্চারণ বাঙালির কর্ণকুহরে প্রবেশ করে। নেতাজি যে বাঙালির মনোভূমিতে আজও লীন, তা কেবল বাঙালির মানসিক ব্যাধি নহে, ‘বৃহৎ’-এর প্রতি প্রণতির সম্মেলক বাসনাও বটে। নেতাজি সুভাষ অসম্ভবকে সম্ভব করতে চেয়েছিলেন, জীবন তুচ্ছ করে স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। তাঁর তুলনীয় স্বপ্নদর্শী নেতা পরাধীন ভারতে খুঁজে পাওয়া ভার। এই স্বপ্নের গৌরবে যদি বাঙালি ভর করতে চায়, তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা চলে না।
মুশকিল বাধে যখন এই স্বপ্নের ‘অংশ’টি বাইরে কেউ না বুঝেও বুঝবার ভান করেন। বাঙালির মানসে ঠিক কোথায় নেতাজির স্থান, সেই সন্ধান না পেয়ে ভিত্তিহীন মাতামাতি শুরু করেন। মোদিবাবুরা ভোটের তাগিদে নেতাজিকে স্মরণ করতে গিয়ে ভুলে যান যে, কলিকাতা বন্দরের নাম তাঁরা শ্যামাপ্রসাদ রেখেছেন যখন ডকের নামে আছেন নেতাজি, ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে নেতাজিকে (Netaji Subhas Chandra Bose) জওহরলাল নেহরুর ‘শত্রু’ হিসাবে তুলে ধরেছেন। তাঁরা ইতিহাস জানেন না। নেতাজির জন্মদিনকে ‘পরাক্রম দিবস’ নাম দিয়েছেন, কেননা তাঁরা ঘোড়ায়-চড়া নেতাজিকে শুধু পরাক্রমশালী যোদ্ধা ভাবেন, দেশের ঐক্যস্বপ্নে বিভোর দেশপ্রেমিক ভাবেন না। ‘পরাক্রম’ শব্দটি হিন্দিতে সুমধুর হলেও বাংলায় কিন্তু তার দ্যোতনা নেতিবাচক। তাঁরা বাংলা ভাষা জানেন না।
বস্তুত তেইশ জানুয়ারির জন্য ‘দেশপ্রেম দিবস’ নামই উপযুক্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে সুভাষচন্দ্র ‘সেরা দেশপ্রেমিক’, বলে গিয়েছেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী। বলেছেন, সুভাষ একাই দেশকে শিখিয়েছেন, কী ভাবে ‘শ্রেণি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে আত্মত্যাগ ও ঐক্য’ তৈরি করিতে হয়। বিজেপি শুনছে কি?
নেতাজিকে শ্রেণি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে ‘ঐক্য’ ছাড়া কোনও কিছু দিয়েই সম্মান দেওয়া যাবে না। কোনও মাল্যদান বা বাণী-বিতরণেই নয়। এই কথাটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন ও মানেন। বাকি ভারতকেও সেই কথাটা বুঝতে হবে।