দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আরএসএসের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সেই অস্বস্তি কাটাতে গেরুয়া শিবির কখনও বিবেকানন্দ, কখনও নেহরু-গান্ধীর বিপরীতে বল্লভভাই প্যাটেলকে আঁকড়ে ধরেছে। আর এখন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার— উভয়েরই মধ্যেই ‘গভীর সম্পর্ক ছিল’, এসব বলেটলে বোঝাতে চাইছে, পথ আলাদা হলেও লক্ষ্য ছিল অভিন্ন। সুভাষচন্দ্র বসু শুধু দেশ স্বাধীন করার জন্য লড়াই করেননি, এক মহান ভারত গড়ে তোলা ছিল তাঁর স্বপ্ন। আরএসএস নেতাজির লক্ষ্যপূরণে তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে চলছে। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে সঙ্ঘের অবদান নেই বলে যে ঐতিহাসিক প্রচার রয়েছে, তারই কাউন্টার ইমেজ তৈরি করার কৌশলগত লড়াই শুরু করেছে সঙ্ঘ পরিবারের নেতারা। উদ্দেশ্য, একদিকে বাংলার মানুষের কাছে ‘বাঙালির দেশপ্রেম’কে গুরুত্ব দেওয়ার কৌশল। অন্যদিকে, বাঙালিকে বার্তা দেওয়া ‘আমরা তোমাদেরই লোক’।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর দেখানো পথে কর্মসৃষ্টি, পথ দেখাচ্ছেন যুবক
ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলছে। কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পরেও কংগ্রেসের ভিতরে অতি-দক্ষিণপন্থীদের প্রতি ন্যূনতম প্রসন্ন ছিলেন না সুভাষ। হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগের যেসব সদস্য কংগ্রেসে ছিলেন, তাঁদের ঘাড় ধরে বের করে দিতে হবে বলে স্পষ্টই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। আর সেটাই ছিল তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান। নেতাজি হিন্দু মহাসভার তীব্র সমালোচনা করে বলেছিলেন, তারা ‘ধর্মের সুযোগ নিয়ে ধর্মকে কলুষিত করে।’ এমনকী তিনি হিন্দু মহাসভাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালালও বলতে ছাড়েননি। সুভাষচন্দ্র বসুর মহাসভা-বিরোধী কঠোর মনোভাব দেখে হিন্দু মহাসভার এবং পরে বিজেপির শীর্ষনেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ভয় পেয়ে তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, সুভাষ ক্ষমতায় এলে তাঁদের নির্বংশ করে ছাড়বেন।
চল্লিশের দশকের গোড়ায় স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত দিনগুলিতে নেতাজি ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ সশস্ত্র পথে নেমেছিল। তখন সাভারকরের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা তথা আরএসএস ব্রিটিশদের পক্ষে তীব্র প্রচার গড়ে তুলেছিল। তাঁরা প্রচার করেছিলেন, যুদ্ধ যখন দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়েছে তখন হিন্দুরা সেটা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করুক। ব্রিটিশ বাহিনীর সব উইং-এ ব্যাপকভাবে নাম লেখাতে হবে, আর এক মিনিটও দেরি না করে বিশেষত বেঙ্গল ও অসম প্রদেশ থেকে হিন্দুদের যুক্ত করতে হবে। ব্রিটিশদের প্রতি পরম আনুগত্য রেখে যুদ্ধ করতে হবে। পরবর্তী কয়েক বছর ধরে সাভারকর ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় রীতিমতো রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প সংগঠিত করে ব্রিটিশ বাহিনীতে ‘হিন্দু’দের নিয়োগ করতে থাকেন, যারা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ধরে এগিয়ে আসা আজাদ হিন্দ বাহিনীকে আটকাবে। এই রিক্রুটমেন্টের জন্য এমনকী একটি কেন্দ্রীয় বোর্ডও গঠন করে ফেলেন সঙ্ঘের নেতারা। ব্রিটিশ বাহিনীতে হিন্দুদের রিক্রুট করার এই উদ্যোগের পিছনে সাভারকরের আরও একটি গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল। হিন্দুরা সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলে তা পরে একটি মিলিট্যান্ট হিন্দুরাষ্ট্র গঠনে প্রভূত সাহায্য করবে। সাভারকরের এইসব রিক্রুটরা যুদ্ধশেষে সেনা থেকে বাদ পড়ে জঙ্গি হিন্দু বাহিনী গঠন করে এবং পার্টিশন পর্বে ইউপি-বিহারের বড় বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলি সংগঠিত করতে মূল ভূমিকা পালন করেছিল।
আরও পড়ুন-বিজেপির স্বৈরাচার! কল্যাণ-সহ ১০ সাংসদকে ফের সাসপেন্ড, প্রতিবাদ
আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার উদ্যোগের ফলে ভারতীয় সেপাইদের আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া সহজ হয়েছিল। কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, যুদ্ধবন্দিদের ঠান্ডামাথায় হত্যা করার ক্ষেত্রেও। ড্যানিয়েল মার্সটন তাঁর ‘দ্য ইন্ডিয়ান আর্মি অ্যান্ড এন্ড অব রাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন, সেই সময় ব্রিটিশ অফিসাররা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল আইএনএ-র যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে। আইনি পথে বিচার করার আগেই ধ্বংস করে দিতে চাইছিল তাঁদের অস্তিত্ব। অফিসাররা সেপাইদের বোঝাতে সক্ষম হয়, আইএনএ আসলে দেশদ্রোহী। বারাকপুর-বারাসতের নীলগঞ্জ বন্দিশিবিরে ১৯৪৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরের কুখ্যাত গণহত্যা ছিল তারই রেজাল্ট। গোটা রাত হেভি মেশিনগানের শব্দ শোনা গিয়েছিল। পোড়া শবের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল বহুদূর। পরদিন নোয়াই খালে রক্তবন্যা বয়ে যেতে দেখেছিল স্থানীয় মানুষ। অনেকের মতে, সেদিন অন্তত তিন হাজার যুদ্ধবন্দিকে হত্যা করা হয়েছিল। আরএসএসের হাতে যে আজাদ হিন্দ ফৌজের রক্ত লেগে আছে তা ভুলিয়ে দিতে চাইছেন। কিন্তু সেই ইতিহাস বাঙালিরা ভুলবে কীভাবে?
‘ব্রিটিশ বিরোধিতাকে ভাবা হচ্ছে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সমার্থক। এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলন, তার নেতৃবর্গ ও সাধারণ মানুষের উপর বিনাশকারী প্রভাব ফেলেছিল’। বক্তা সাভারকর। আর আজ তাঁর পথের পথিক ও মতবাদের শরিকরা বদলে দিতে চাইছে দেশের স্বাধীনতা দিবসটাও।
আরও পড়ুন-চাপে পড়ে সঞ্জয়ের ফাঁসি চেয়ে এবার হাইকোর্টে সিবিআইও
এঁরা ভুলে গেছেন, বাংলায় তাঁদের প্রধান আইকন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কপাল ফাটিয়ে দিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুর দলের কর্মীরাই? নেতাজির প্রত্যক্ষ নির্দেশেই এই বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন সেই তরুণরা। কলকাতায় হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক প্রচারসভাকে একাধিকবার বিক্ষোভ দেখিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল সুভাষচন্দ্রের যুব বাহিনী। শেষে শ্যামাপ্রসাদ নিজেই ময়দানে নামলে তাঁকেও সেই বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। হিন্দুত্ববাদীদের হীন রাজনীতি ও বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে ১৯৪০ সালের ১৪ মে এক জনসভায় নেতাজি বলেছিলেন, ‘সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে ভোটভিক্ষায় নামিয়ে দিয়েছে হিন্দু মহাসভা। ত্রিশূল ও গেরুয়া বসন দেখলেই তো হিন্দুরা ভক্তিতে মাথা নোয়ায়। ধর্মের সুযোগ নিয়ে, ধর্মকে হেয় করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির বৃত্তে প্রবেশ করছে। একে ধিক্কার জানানো সমস্ত হিন্দুরই কর্তব্য… জাতীয় জীবন থেকে এই বিশ্বাসঘাতকদের বিতাড়িত করুন। কেউ ওদের কথায় কান দেবেন না।’
এই কথাগুলো মনে করার, মনে রাখার ও মনে করানোর সময় আবার এসে গিয়েছে। বাংলার মানুষ ফের জোট বাঁধুন। ঐক্যবদ্ধ হোন।