ভারতবর্ষের ছোট্ট একটা গ্রাম, ভাওনামাউ। সেই গ্রামের রজনী এখন অষ্টাদশী। তার লড়াই শুরু হয়েছিল ১৪ বছর বয়সে। রজনী স্বপ্ন দেখত স্কুলে যাওয়ার, স্বপ্ন দেখত দেশ গড়ার। তার যখন ১৪ বছর বয়স তার মা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করে। তখন থেকেই শুরু হয় রজনীর লড়াই। পরিবারের বিরুদ্ধে। সমাজের বিরুদ্ধে। তাঁর নিজের বিয়ে ভাঙার লড়াই। প্রতিদিনই পরিবারকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, তিনি বিয়ে করতে চান না। তাঁর মাকে মনে করান অল্প বয়সে বিয়ে এবং বাচ্চা নিয়ে তাঁর কত কষ্ট হয়েছিল। নিজের চেষ্টায় রজনী বাবা-মাকে বুঝিয়ে নিজের বিয়ে ভেঙে দেন। এখান থেকেই তাঁর লড়াই শুরু। তিনি উত্তরপ্রদেশে তাঁর ছোট্ট গ্রামে মেয়েদের শেখান কীভাবে তাঁর বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে। তিনি শেখান কীভাবে বিয়ে না করে, পড়াশোনা করে তাঁদের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।
‘রজনী’ এখনও বাকি
উত্তরপ্রদেশের এই ছোট্ট গ্রামে একের পর এক ঠিক হয়ে থাকা বাল্যবিবাহ তিনি ভেঙে দেন। কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে তৈরি করেন নিজস্ব দল। রজনীদেবী অকপটে স্বীকার করেন নিজের জীবনের বিয়ে ভাঙার কাহিনি। ক্লাস এইটে পড়ার সময় তিনি জানতে পারেননি তাঁর বিয়ে ঠিক হয়েছে। যাঁর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। যেহেতু ১১ বছর বয়সে তাঁর মায়ের বিয়ে হয়েছিল, তাই তাঁর মায়ের এবং গ্রামের অনেক প্রবীণের ধারণা ছিল বয়ঃসন্ধির আগেই বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। বিয়ের সময় মেয়ের বয়স যত কম হবে তত ভাল। টাকা-পয়সার ব্যাপারটা আছেই। এছাড়া সম্মানেরও ব্যাপার আছে। কোনও কন্যাসন্তান যদি অবিবাহিত থাকে তাহলে তা পরিবারের জন্য অসম্মান বা লজ্জাজনক। নিজের বিয়ে ভেঙে দিয়ে প্রতিদিন রজনী এখন সাইকেল চালিয়ে ৪০ মাইল দূরে কলেজে পড়তে যান।
নতুন বিয়ের ফুল
কয়েক বছর আগের ঘটনা। পুরুলিয়ার শিউলি আর কোচবিহারের রোকেয়া নিজেদের বিয়ে ভেঙে দেয়। কারণ তখনও তাদের বিয়ের বয়স হয়নি। আর পাকা দেখার দিন বাড়ির জানলা দিয়ে লুকিয়ে শুনতে পায় হাজার হাজার টাকা পণ চাইছে পাত্র। বাংলার এই দুই কন্যাশ্রীর জীবন যুদ্ধটা একেবারে অন্যরকম। একদিকে গরিব বাবা-মায়ের উপরে পণের বোঝা। অন্যদিকে তাদের অদম্য পড়ার ইচ্ছে। টিভিতে খবর দেখে তারা জানতে পেরেছে কচি বয়সে বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিতে চাইলে, পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ সে-বিয়ে রুখে দেবে। বাংলার এই কন্যাশ্রীরা বাবা-মায়ের ঠিক করা বিয়ে ভেঙে দেয়। স্ফুলিঙ্গের মতো তাদের এই লড়াই ছড়িয়ে পড়ে বাংলার গ্রামে গ্রামে। বিয়ে ভাঙার খেলায় মেতে ওঠে তারা ন্যায্য দাবিতে। তাদের সম্বল এবং ভরসা জোগায় সরকার।
রক্ত মাপার দিন
পাঞ্জাবের আরেক মেয়ের গল্প। রসবিন্দর কাউর। নিজের বিয়ে ভেঙে দেন বিজ্ঞানমনস্কতার কারণে। রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করার পর বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি পান। সেখানেই পরিচয় হয় তরুণ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। প্রথম পরিচয় থেকেই প্রেম-ভালবাসা। তারপর ঘর বাঁধার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়, ছোট্ট একটা মেডিক্যাল রিপোর্টে। দুই পরিবার বিয়ের ডেট ঠিক করে, আয়োজন সম্পন্ন প্রায়, এমন সময় রসবিন্দর ঠিক করেন তাঁদের থ্যালাসেমিয়া টেস্ট করাতে হবে। নিজেদের জন্য, পরের প্রজন্মের জন্য। রিপোর্ট হাতে আসার পর আকাশ ভেঙে পড়ে মাথায়। বিয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান রসবিন্দর। ভেঙে দেন নিজের বিয়ে। ইঞ্জিনিয়ার প্রেমিককে বোঝানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। প্রেমিক হয় সেরা বন্ধু। ভালবাসা অটুট থাকে। সংসার বাঁধার স্বপ্ন ফেড হয়ে যায়।
আরও পড়ুন-সাহস থাকলে তৈরি করুন গুজরাত-মণিপুর ফাইলস, বিবেককে চ্যালেঞ্জ তৃণমূলের
সিভিল স্কোর :
বিয়ের নতুন শর্ত
ভারতবর্ষে বিয়ে নিয়ে নানা শর্ত রয়েছে। শহরে গ্রামে বহু ঠিক হওয়া বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে শুধু সেই শর্ত পূরণ না হওয়ার জন্য। এই বছর মহারাষ্ট্রের মূর্তিজাপুরে একটি বিয়ে ভেঙে দেওয়ার ঘটনা ঝড় তুলেছে চারদিকে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর কন্যা তার হবু বরের সিভিল স্কোর দেখতে চান। সেই স্কোর দেখে বেঁকে বসেন। দেখেন বরের বহু ঋণ রয়েছে। তার মধ্যে একাধিক ঋণ অনাদায়ী। তাই এমন পাত্রকে বিয়ে করতে বেঁকে বসেছেন পাত্রীটি। এককালে রেডিও-টেলিভিশন-এ সরকারি বিজ্ঞাপনে বলা হত, বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর ঠিকুজি-কুষ্টি দেখার আগে রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট দেখুন।
থ্যালাসেমিয়া, এইচআইভি যাই হোক না কেন তা থেকে যেন ভবিষ্যতে রোগ না ছড়ায়। এবার বিজ্ঞাপন বদলে দেওয়ার সময়। রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টের সঙ্গে পাত্র-পাত্রীর সিভিল স্কোর দেখে নিন। সংসারের এই দীর্ঘ ইনিংস শুরু করার আগে জেনে নেওয়া ঠিক কতখানি ঋণের বোঝা নিয়ে ইনিংস শুরু হচ্ছে। এটাও জানা দরকার সম্পর্কের উল্টো দিকে থাকা মানুষটির কতটা আর্থিক দায়িত্বজ্ঞান। এ কথা ঠিক যে, কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে লোন না নিলে ক্রেডিট রেটিং বা সিভিল স্কোর তৈরি হয় না। ফলে সব পাত্র-পাত্রীর ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। কিন্তু যাঁদের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য তাঁরা যদি ব্যবহার করেন তাহলে ভবিষ্যতে বহু সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। সিভিল স্কোর বোর্ড সচল থাক কিন্তু সিভিল স্কোর এমন কী শর্ত যার জন্য বিয়ে পর্যন্ত ভেঙে দিচ্ছে পাত্রীরা! সিভিল স্কোর ঠিক করেন ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো লিমিটেড। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে চারটি ক্রেডিট ইনফরমেশন কোম্পানিকে লাইসেন্স দিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এই সিভিল। এই কোম্পানি ৬০ কোটি মানুষ এবং ৩২ কোটি ব্যবসার ক্রেডিট সংক্রান্ত ফাইল রক্ষণাবেক্ষণ করে। এই আমেরিকার বহুজাতিক গোষ্ঠী ট্রান্স ইউনিয়নের অংশ। তাই ভারতে ক্রেডিট স্কোর সিভিল ট্রান্স ইউনিয়ন স্কোর নামে পরিচিত। ক্রেডিট সংক্রান্ত ইতিহাস তার রেটিং, নিয়মিত পরিশোধ এগুলো নিয়েই তৈরি হয় সিভিল স্কোর। সাধারণত এই লোন নেওয়া ব্যক্তির সিভিল স্কোর ৩০০ থেকে ৯০০-এর কাছাকাছি হতে পারে। ৯০০-এর যত কাছাকাছি হবে ক্রেডিট রেটিং তত ভাল হবে। এর মাধ্যমে ব্যক্তির ক্রেডিট ইতিহাস, ব্যাঙ্ক রিপোর্ট, ঋণ গ্রহণ, পরিশোধ এসবের গাণিতিক মিথস্ক্রিয়াতে তৈরি করা ভবিষ্যদ্বাণী। যা সাহায্য করে ব্যাঙ্কগুলোকে বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনও ব্যক্তি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কতটা যোগ্য তা নির্দেশ করে। একদিনে এই স্কোর তৈরি হয় না। এই স্কোর তৈরি হতে ১৮ থেকে ৩৬ মাস সময় লাগে। তবে সিভিল স্কোর কম হলেও কোনও কোনও ব্যাঙ্ক আবেদনটি আর বিবেচনা নাও করতে পারে। ৭০০-এর উপরের স্কোরকে ভাল সিভিল স্কোর বলে বিবেচনা করা হয়। যাঁরা সিভিল স্কোর ভাল করতে চান তাঁদের কতগুলো বিষয়ের উপর নজর রাখতে হয়। ক্রেডিট কার্ডের বিল ঠিক সময়ে পরিশোধ করা। লোনের EMI মিস না করা। আর্থিক বিষয়ে কনসিস্টেনসি বজায় রাখা ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-কুৎসাকারীদের মুখে ঝামা ঘষে কলকাতাই এখন দেশের অন্যতম সেরা তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র
জানি না তোমার শর্ত
মহারাষ্ট্রের যে মেয়েটি সিভিল স্কোরের কারণে বিয়ে ভেঙে দিয়েছেন তিনি নিঃসন্দেহে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী। তাই সিভিল স্কোর যাচাই করার হিম্মত দেখিয়েছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় ভারতের অনেক পাত্রীরই সে-সুযোগ থাকে না। এমনকী সুযোগ থাকলেও সেই আর্থিক সচেতনতা বহু পাত্রীর নেই। ফলে দুর্বল সিভিল স্কোরওয়ালা পাত্রের সঙ্গে বিয়ের পর সংসারে আর্থিক নানা সমস্যা হতে পারে। ভারতের অর্থনৈতিক ছবিটা এমন যে এই অমৃত মহোৎসবের কালেও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ৭৫ শতাংশের বেশি মেয়ের কর্মসংস্থানের কথা বলতে ভরসা পান না। ফলে অনেক বিবাহিত মেয়েই আর্থিকভাবে তাঁদের স্বামীর উপর নির্ভরশীল। তাঁরা জানতেও পারেন না তাঁর স্বামী কতখানি ঋণে জড়িয়ে আছেন। কতটা আর্থিকভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন। এমনকী পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপড়শির সাথে কথা বলেও পুরো ছবিটা বোঝার সুযোগ নেই। তাই মহারাষ্ট্রের এই মেয়েটি পথ দেখিয়েছেন পাত্র নির্বাচনের। নাগরিক জীবনে তৈরি করেছেন সচেতনতা। বিয়ে যে শুধু স্বপ্ন নয়, সংসার যে শুধু ফ্যান্টাসি নয়, বাস্তবের মাটিতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিয়ের নতুন শর্ত তৈরি করছে প্রগতিশীল পাত্রীরা। আগামী দিনে কনে বিয়ের পিঁড়িতে বসার আগে আরও একবার কি গলা ছেড়ে এ-গান গাইতে পারবে— আমি যে নিজেই মত্ত/ জানি না তোমার শর্ত,/ যদি বা ঘটে অনর্থ/ তবুও তোমায় চাই…