এই মুহূর্তে সবচেয়ে চর্চিত সেলিব্রিটি কাপল ভারতীয় মহিলা দলের ক্রিকেটার স্মৃতি মান্ধানা এবং বলিউডের সুরকার পলাশ মুচ্ছলের বিয়ে আপাতত স্থগিত। পলাশ আর স্মৃতির বাগদান, গায়ে-হলুদ, সঙ্গীত— জোরদার চর্চা ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু এত আয়োজনের পরে হঠাৎই সেই বিয়ে স্থগিত হয় তার কারণ স্মৃতির বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে নতুন রূপে বিদ্যাসাগর সদন
তবে গুঞ্জন অন্য। পলাশ নাকি অন্য নারীর প্রেমে যদিও এর তেমন কোনও সত্যতা এখনও নেই কারণ যা-ই হোক, এত হাইপ্ড হওয়া একটি বিয়ে শেষমুহূর্তে স্থগিত হল! আর সেই সিদ্ধান্ত স্মৃতির।
এ তো গেল তারকাদের কথা। সাধারণ ঘরের মেয়েরাও এখন কিছু কম যান না। কয়েকটি ঘটনা তার প্রমাণ। ‘ব্লিঙ্ক-ইট ওয়েডিং’ শব্দটা এই মুহূর্তে গোটা সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ঘুরছে। নেটিজেনদের দেওয়া খুব ভাইরাল একটা শব্দ। এই শব্দবন্ধটি আগামী দিনে অনেক কিছুর সাক্ষী হবে। ট্রেন্ডিংও হয়ে উঠলে কেউ অবাক হবে না। কারণটা হল ‘ব্লিঙ্ক-ইট’-এ কোন জিনিস ডেলিভারি দিতে যতটা সময় লাগে তার চেয়েও কম সময়ে সম্প্রতি বিয়ে ভাঙল উত্তরপ্রদেশের কনে পূজার। বিয়ে ভেঙেছেন পূজা নিজেই। দেওরিয়ার বিশালের সঙ্গে ধুমধাম করে বিয়ে হয় সালেমপুরের পূজার। বিবাহ-পর্বের শেষে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছন তাঁরা। সেখানে নবদম্পতিকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার ২০ মিনিটের মধ্যে পূজা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জানান, তিনি আর শ্বশুরবাড়িতে থাকতে চান না! প্রথমে আত্মীয়স্বজনেরা ভেবেছিলেন তিনি মজা করছেন। কিন্তু পূজা নাছোড়বান্দা। আইনি বিচ্ছেদ চান সদ্য বিবাহিত স্বামীর থেকে। পঞ্চায়েতকে সাক্ষী রেখে সেদিনই বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজপত্রে সই করেন দম্পতি। এমন কাণ্ড ঘটানোর কারণ প্রথমে জানা না গেলেও পরে জানা গেছে, পূজার নাকি পাত্র এবং পরিবার পছন্দ না তাই তিনি থাকতে চাননি। এমন ঘটনায় নেটমহল তোলপাড়! আমাদের সমাজে কোনও মেয়ে পারে এমনটা করতে!
রাজস্থানের ঢোলপুরের বাসিন্দা গিরিশ কুমারের মেয়ে দীপিকার ঘটনাও একইরকম। দীপিকার সঙ্গে করৌলির যুবক প্রদীপের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। বিয়েতে বিশাল আয়োজন করেছিলেন গিরিশ। ধুমধাম করে বিয়েও হল কিন্তু গন্ডগোলের শুরু ঠিক বিয়ে মিটে যাওয়ার পর। বিয়ের পর দিন সকালে বরের সঙ্গে গাড়িতে উঠতে নারাজ দীপিকা। কারণটা কী? দীপিকার উত্তর, প্রদীপ সুস্থ নয়! কনের দাবি, তাঁর সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়ার সময় বরের হাত কাঁপছিল। তিনি সেটা ভাল করেই লক্ষ্য করেছেন। তাই দীপিকা নিশ্চিত যে, বরের নিশ্চয়ই কোনও শারীরিক সমস্যা রয়েছে। সকলকেই দীপিকা জানিয়ে দেন, ‘দুর্বল’ বরের সঙ্গে কিছুতেই তিনি সংসার করবেন না তিনি। সবাই হতবাক। অনেক বুঝিয়েও কাজ হয়নি। শেষমেশ নববধূকে না নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন প্রদীপ।
আরও পড়ুন-মিড-ডে মিলকে আকর্ষণীয় করতে নবান্ন-উৎসব স্কুলে
বিয়ের আসরে এসি নেই তাই রাগে বিয়েই ভেঙে দিয়েছেন উত্তরপ্রেদেশেরই আরও এক কনে! ঘটনাটি ঘটেছে উত্তরপ্রদেশের আগরায়। শামশাবাদ শহরে পাত্রপক্ষের তরফে ছিল বিয়ের অনুষ্ঠান। যেখানে আয়োজন করা হয় সেখানে শীতাতপনিয়ন্ত্রণের কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। ফলে কনে এবং তাঁর পরিবারের লোকজনদের তীব্র গরমে দমবন্ধকর অবস্থা হয়। শুরু হয় বচসা। সেই সঙ্গে বরের পরিবারের বিরুদ্ধে যৌতুক নেওয়ারও অভিযোগ এনে পুলিশের কাছে নালিশ জানায় কনে। এবং মণ্ডপ ছেড়ে চলে যান। পরে কনে জানান, এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিয়ে করলে সেটা হবে তাঁর জন্য অসম্মানের। স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা সেই বিয়েটা যাতে ভেস্তে না গিয়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় তার জন্য মধ্যস্থতাও করেন কিন্তু কনে নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। তিনি বিয়েটা নাকচই করেন।
ঘটনাটা উত্তরপ্রদেশের সাম্ভালা জেলার মূলহেতা গ্রামের খেসারিলালের ২০ বছরের মেয়ে শশীর। তাঁর বিয়ে ঠিক হয় আমরোহা জেলার নাগরিয়া গ্রামের বাসিন্দা অমিত রানার সঙ্গে। বাড়ি-ভর্তি লোকজন। সবাই সেজেগুজে তৈরি হঠাৎ মণ্ডপে এসে শশী বেঁকে বসলেন। তিনি বিয়ে করবেন না এই পাত্রকে। কেন? আসলে বন্ধুদের সঙ্গে বিয়ের দিন আকণ্ঠ মদ্যপান করেছিলেন অমিত! গাড়ি থেকে নেমে যখন মণ্ডপের দিকে এগোচ্ছিলেন তাঁর পা টলছিল। প্রকৃতিস্থ ছিলেন না পাত্র অমিত। খুব কষ্ট করে মণ্ডপে আসেন! ব্যস আর কী! শশী সিদ্ধান্ত নেন এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন মাতাল পুরুষকে তিনি বিয়ে করবেন না কিছুতেই। একা কনেই ভেঙে দিলেন সেই বিয়ে। বন্ধুদের দুর্বুদ্ধিতে বিয়েটাই ভেঙে গেল অমিতের।
এইসব ঘটনাই ২০২৫-এ নেটমাধ্যমে ভাইরাল। সবগুলোই সত্য ঘটনা। আজ থেকে কয়েক বছর আগে হলেও কোনও মেয়ে পারতেন তাঁর বিয়ের দিন বা বিয়ের আগের মুহূর্তে বা বিয়ে হয়ে যাওয়ার কুড়ি মিনিটের মধ্যে নির্দ্বিধায় বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে যেতে! কনের পরিবার, কন্যাদায়গ্রস্ত বাবাও কি চুপচাপ সেই দৃশ্য উপভোগ করতেন? একেবারেই না।
আসলে বদলেছে সময় এবং বদলে গেছে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির প্রতি এ-যুগের নারীর দৃষ্টিভঙ্গি। তাই আজ আর মেয়ের বাবারা কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা নন। সমাজতত্ত্ববিদ বা মনোবিদদের মতে, নারীত্বের সঙ্গে বরাবরই নম্রতা, মেনে নেওয়া বা মানিয়ে নেওয়াটাকে এক করে দেখা হয়ে এসেছে। সবটাই তারা মানিয়ে নেবে। সেই মানিয়ে নেওয়ার মধ্যেই ছিল হাজার মেনে নেওয়া। এমনটা হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকা। তাই অসুখী বিয়েতেই থেকে যেতেন মেয়েরা। শারীরিক, মানসিক অত্যাচার সয়েও বিয়ে ভাঙতেন না লোকলজ্জার ভয়ে। আজ সেই প্রয়োজন ফুরিয়েছে। পায়ের তলায় উপার্জনের জমি এবং স্ব-চেতনা তাঁদের শেখাচ্ছে স্বাবলম্বী হয়ে একাও বাঁচতে বা কোনওরকম অন্যায়কে মেনে না নিতে। উল্টোদিকের মানুষটা চাইলেই ভালবাসা, রোম্যান্স, কমিটমেন্টের চিঁড়ে আর ভিজবে না সহজে। বিয়ের পিঁড়িতে তাঁরা বসবেন কি বসবেন না সেই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ মেয়েরাই ঠিক করবেন। পছন্দের পাত্রটি যোগ্য হলেও আদৌ সারাজীবনের সঙ্গী হওয়ার উপযুক্ত কি না তা নিক্তি দিয়ে মাপবেন তাঁরাই।
সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা অনুযায়ী এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের মতো দেশে ২৮ বছরের ঊর্ধ্বে অধিকাংশ মেয়েই মনে করছেন ইচ্ছে হলে তবেই বিয়ে করব, না হলে নয়। বিয়ে এখন অপশনাল, সংসার করাটাও বাধ্যতামূলক নয়। পুরোটাই তাঁদের ইচ্ছের ওপর নির্ভরশীল। আবার সমীক্ষা বলছে, পঞ্চাশ শতাংশ নারী এটাও মনে করেন যদি বিয়ের এক মুহূর্ত আগেও মনে হয় পাত্রটি তার উপযুক্ত নয় তাহলে অনায়াসে সে এই বিয়ে ভেঙে দিতে পারে। তাতে সমাজের শ্যেনচক্ষু তাকে সইতে হলে হবে। এতে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা থাকবে না। নতুন প্রজন্মের এই মনোভাব স্পষ্ট করছে আধুনিক যুগে সম্পর্কের মানে বদলাচ্ছে আর বিয়ে সম্পর্কে মেয়েদের মনের আবেগ-উপলব্ধিও বদলাচ্ছে।
আরও পড়ুন-ফাইনালে আরও সমর্থন চান রশিদরা, আজ মোহনবাগানে যোগ দিচ্ছেন দিমিত্রি
ইদানীং সারাজীবন সিঙ্গল থাকাটা অনেক মেয়েই বেছে নিচ্ছেন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, শিক্ষা ছোট থেকে বেড়ে ওঠা, উদার পরিবেশ তাকে প্রতিবাদী হতে শিখিয়েছে। পায়ের তলায় উপার্জনের জমি এবং স্ব-চেতনা তাদের শেখাচ্ছে স্বাবলম্বী হয়ে একাও বাঁচা যায়। অনেক মেয়েরই মনে হচ্ছে, আমার জীবনটায় আমি আমার মতো করে চলব। সব কিছুই মেনে নেওয়ার, মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ইচ্ছে হলে বিয়ে বা সম্পর্কে না থেকে একাই কাটিয়ে দেওয়া যায়। তার একটা আনন্দ আছে, সেটা মেয়েরা পেতে চাইছে। তা ছাড়া, মাতৃত্বের স্বাদ পেতে বা বাচ্চাকে বড় করতেও এখন বিয়েতে থেকে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না তাদের। তাই বলে কি গার্হস্থ্য হিংসা নেই? অবশ্যই রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে প্রতি তিনজন মহিলার মধ্যে একজন গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হন। যে-দেশে ঘরের কাজের জন্য গঞ্জনা সহ্য করা মেয়েদের প্রাত্যহিক কর্ম সেই দেশে তিরিশ শতাংশের অন্যায়ের প্রতিবাদ করা বা বিয়ের মতো জীবনে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ভুল মনে হলে তা মুহূর্তে নাকচ করা নিঃসন্দেহে এক নতুন সূর্যের আশ্বাস। নারী এখন একাই আত্মবিশ্বাসী। নিজের প্রতি দৃঢ় আস্থা আর গভীর জীবনবোধ তাঁদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়িছে। সেই কারণেই সিঁদুর দানের থেকে একমুহূর্ত আগে উঠে দাঁড়াতে তাঁরা দু’বার ভাবছেন না। অসুখী বিয়ে বা ভুল সম্পর্কে থাকার চেয়ে একা থাকা তাঁদের পছন্দের হয়ে উঠছে।

