২০২২ –এ পা

খ্রিস্ট নববর্ষের শুরুয়াৎ হয়ে গেল। তামাম দুনিয়া মেতে উঠল মহাসমারোহে। আপাত শিথিল ছিল অতিমারির প্রতিবন্ধকতা। ওমিক্রনের বার্তার মাঝেই ২০২২-এ পা দিল দুনিয়া। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ তাদের নিজেদের ট্র্যাডিশন অনুযায়ী নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। বর্ষবরণ, নিউইয়ার নিয়ে দেশের- দশের নানা সংস্কার, নানান খাবারদাবার। সবটাই আগামীর সমৃদ্ধি ও সাফল্যের কামনায়। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

একত্রিশ ডিসেম্বর পেরিয়ে আজ হ্যাপি নিউ ইয়ার (New Year)। শতসহস্র দুর্দশা, সংকটপূর্ণ অতিমারির আঘাত সহন করে নতুন বছরে পদার্পণ করল এই পৃথিবী। নতুন আশার আলোয় বুক বেঁধে সব কিছু ভুলে তারা নতুন বছরকে স্বাগত জানাল। পদে পদে মৃত্যুর হাতছানিকে উপেক্ষা করে অনেকটা পরিপক্ক, কঠিন, দৃঢ় জগৎবাসী হাসলেন, নতুন সূর্যে স্নাত হলেন। ২০২১-এর অভিঘাত ভুলে ২০২২ এর সূচনা হয়ে গেল। অনেক কিছু ভুলে আবার এগনোর পালা। ইতিমধ্যেই ওমিক্রনের বার্তা এসে গেছে। অজানা আতঙ্ক তার প্রথম পরিচয় সেরে ফেলেছে। আমরা কেউ জানি না নতুনের ঝুলিতে কী আছে। কিন্তু নতুন বছরের এই দিনটা সবার বড় প্রিয়। গোটা পৃথিবীর সর্বধর্ম এবং ভাষাভাষীর মানুষেরা এই খ্রিস্ট নববর্ষের উপর নির্ভরশীল। নতুন বছর হল সেই সময়, যখন থেকে একটা নতুন পঞ্জিকার বছর শুরু হয়। বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত বর্ষপঞ্জি হল গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি। সেই অনুসারে নতুন বছর শুরু হয় জানুয়ারির ১ তারিখে। রোমান এবং জুলীয় (জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে) বর্ষপঞ্জি দুটির ক্ষেত্রে এটি এক। বর্ষবরণ উৎসব বহু প্রাচীনকাল থেকে পালিত হয়ে আসছে। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে মেসোপটেমীয় সভ্যতায় প্রথম বর্ষবরণ উৎসব পালনের প্রমাণ মেলে। বর্তমান ইরানের প্রাচীন নাম হল মেসোপটেমিয়া। এই মেসোপটেমীয় সভ্যতার চারটে ভাগ রয়েছে। সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, অ্যাসেরীয় সভ্যতা, ক্যালডীয় সভ্যতা। এর মধ্যে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার কালে বর্ষবরণ (NewYear) বা ইংরেজি নিউ ইয়ার পালন শুরু হয়। খুব জাকঁজমকপূর্ণ ছিল সেই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। কিন্তু মজার কথা হল, ওই বর্ষবরণ কিন্তু জানুয়ারির এক তারিখে পালিত হত না। ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় বর্ষবরণ হত বসন্তের প্রথমদিনে। বসন্তের প্রথম চাঁদ উঠলেই শুরু হত বর্ষবরণ। এর পরবর্তীতে বর্ষবরণ পালন করে রোমানরা। রোমুলাস ক্যালেন্ডারে বছর শুরুর মাসটি ছিল মার্টিয়াস বা মার্চ মাস। জানুয়ারি মাসের নামকরণ হয় রোমান দেবতা জানোসের নামানুসারে। জানোসের অর্থ হল দরজা। রোমান সম্রাট সিজার সিদ্ধান্ত নিলেন জানুয়ারির দরজা দিয়েই নতুন বছর শুরু হওয়া উচিত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫-এ জুলিয়াস সিজার তাঁর নতুন জুলীয় বর্ষপঞ্জি কার্যকর করেছিলেন। সেই অনুযায়ী তখন ১ জানুয়ারি থেকে নতুন বছরের সূচনা হয়। আমাদের বারোটা ইংরেজি মাসের নামকরণ বেশিরভাগই রোমান দেবতা এবং সম্রাটদের নামানুসারেই হয়েছে। নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমেরিকার নিউইয়র্কের টাইমস স্কোয়ার, প্যারিসের আইফেল টাওয়ারে বর্ণিল, জাকঁজমকপূর্ণ বর্ষবরণের আতশবাজির খেলা। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নিজস্ব কিছু রিচ্যুয়াল রয়েছে এই নিউ ইয়ারকে ঘিরে। কিছু নিয়মরীতি তাঁরা পালন করেন নতুন বছরকে সাফল্য এবং সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ করে তোলার উদ্দেশ্যে।

স্পেন
নিউ ইয়ারের সূচনা পর্বে ঘড়ির কাঁটার বারোটা ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে বারোটি আঙুর খান স্পেনবাসী। স্পেনে নিউ ইয়ার ইভকে বলা হয় নোচিভিজা, যার অর্থ পুরনো রাত। পুরনো রাতকে বিদায় জানাতে বারোটা আঙুর তাঁদের কাছে সৌভাগ্যর প্রতীক। এক এক করে বারোটা আঙুর খেয়ে তাঁদের বারোটি ইচ্ছাপূর্তির স্বপ্ন দেখেন। স্পেনের ট্র্যাডিশনাল নিউ ইয়ার (New Year) ইভ-এর প্রধান খাবার হল লেনটিল স্টিউ উইথ চোরিজো। স্পেনের বিখ্যাত ওয়াইন কাভা এবং টোস্ট খেয়ে তাঁরা স্বাগত জানান নতুন বছরকে। ওয়াইন নেবার ঠিক আগে পানীয়ের গ্লাসে সোনার আংটি ফেলে দেবার রীতি প্রচলিত রয়েছে। এই সবকিছুই ভালবাসা, সৌভাগ্য, সম্পদ সমৃদ্ধির জন্য। নতুন প্রেমের স্বপ্ন পূরণে স্পেনের যুবক-যুবতীরা ওয়াইনে ফেলে দেন টুকটুকে লাল স্ট্রবেরি বা রাস্পবেরি।

ব্রাজিল
শুধু স্পেন নয়, ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যেও বর্ষবরণে আঙুর খাবার রীতি রয়েছে। কারণ তাঁদের রহন সহনে অনেকটাই রয়েছে ইউরোপীয় প্রভাব। এছাড়া ব্রাজিলবাসীর প্লেটে থাকে চাল, ডাল, বেদানা এবং লেনটিল সুপ। মনে করা হয় নতুন বছরের (New Year) শুরুটা এইসব খাবার দিয়ে হলে আগামী গোটাবছর তাঁদের আর্থিক উন্নতির পথ প্রশস্ত হবে। এইদিন ব্রাজিলে সাদা পোশাক পরার রীতি রয়েছে, যা শান্তির প্রতীক। শান্তির বাণী দিয়ে শুরু করতে চান তাঁরা নতুন বছর।

মেক্সিকো
মেক্সিকান বর্ষবরণ শুরু হয় বারোটা কয়েন দিয়ে। এই বারোটা কয়েন মেক্সিকোবাসী দরজার বাইরে রেখে দেন এবং ঝাড়ুর সাহায্যে ঝাঁট দিয়ে সেই কয়েন তাঁরা ঘরে নিয়ে আসেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন এই কয়েনগুলোই বছরভর নিয়ে আসবে আর্থিক উন্নতি এবং সাফল্য। টোস্ট আর শ্যাম্পেন বর্ষবরণের (New Year) অন্যতম অঙ্গ। ওই শ্যাম্পেনে একটা আংটি ফেলে তাঁরা সৌভাগ্য এবং সম্পদের জন্য প্রার্থনা করেন। এর সঙ্গে তাঁদের ফুড প্ল্যাটারে থাকে ট্রাডিশনাল মেক্সিকান ডিশ বাকলাও (টম্যাটো আর অলিভ দিয়ে করা শুকনো মাছ)। এর সঙ্গে কলাপাতায় মোড়া একধরনের বিশেষ খাবার যার নাম ‘টামালেস’ বা ‘তামালে’ থাকে মেক্সিকানদের প্লেটে। মাংস, কর্ন এবং পনির দিয়ে তৈরি এই পদ একধরনের সুপের সঙ্গে পরিবেশন করা হয় ।

জাপান
জাপানিরা ঘরের বাইরে খড়ের টুকরো ঝুলিয়ে রাখেন। যাতে কোনও অশুভ আত্মা তাঁদের ঘরে প্রবেশ করতে না পারে সেই কারণেই এই রীতি মানা হয়।

পরিবারের মঙ্গলকামনায় তাঁরা এটা করেন তাঁরা। গরমাগরম ব্রথে ডোবানো তশিকশি নামের বিশেষ ধরনের সোবা নুডলস খেয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় জাপানিরা। এই সোবা নুডলস খুব দৈর্ঘ্যে খুব লম্বা হয় । জাপানিরা মনে করেন নতুন বছরে এই নুডলসের মতোই দীর্ঘ হবে তাঁদের সুখ-সমৃদ্ধি। বর্ষবরণের রাতে অবশ্যই থাকে জাপানি ট্রাডিশনাল রাইস কেক মোচি। নানারকমের হয় রাইস কেক। জাপানি নিউইয়ারের ট্রাডিশনাল রাইস কেকটির নাম হল কিনাকোমোচি। আর থাকে ডেটনাকি সুইট ওমলেট।

আরও পড়ুন-প্রতিষ্ঠাদিবসে কলম ধরলেন মহাসচিব তথা শিল্পমন্ত্রী

কোরিয়া
কোরিয়ানদের নিউইয়ার সেলিব্রেশন শুরু হয় জানুয়ারি থেকেই। তবে ফেব্রুয়ারির এক তারিখে কোরিয়ান লুনার নিউইয়ার। তবে জানুয়ারি নিউইয়ারেও কোরিয়ানরা আনন্দে মেতে ওঠে। কোরিয়ানট্র্যাডিশনাল পোশাক হানবক পরার,রীতি রয়েছে এই সময়। বর্ষবরণের রাতে রাইস কেক, মাংস,সামুদ্রিক শ্যাওলা দিয়ে তৈরি তেওকগুক স্যুপ পরিবারের সকলে মিলে খাওয়াটাই রীতি কোরিয়ানদের। নবজীবন, সৌভাগ্যর প্রতীক এই স্যুপ।এই দিন তাঁরা পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি কামনা করে থাকে একটি বিশেষ রীতিতে।

স্কটল্যান্ড
স্কটল্যান্ডে নতুনবছরে পদার্পণের রীতিটি খুব সুন্দর। ওইদিন মধ্যরাতের পর যে পুরুষ প্রথম বাড়িতে পা দেয় সে সৌভাগ্য নিয়ে আসে এমনটাই মনে করা হয়। এই সময় পুরুষেরা সঙ্গে করে টাকা , রুটি আর কয়লা ইত্যাদি নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে। মনে করা হয় যা তারা নিয়ে আসবে এইদিন সারা বছর সেইসব সামগ্রীর অফুরন্ত থাকবে পরিবারে। অর্থাৎ অভাব হবে না কোনও কিছুর। স্কটল্যান্ডবাসী বর্ষবরণের দিন স্কটিশ ডিনারে স্টিক পাই, ব্ল্যাক বান, হুইস্কি আর টোস্টের সঙ্গে মহাসমারোহে গ্রহণ করেন নতূন বছরকে।ঞ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন মুলুকের বর্ষবরণ শ্যাম্পেন টোস্ট,মজা হুল্লোড়, আলোর বর্ণাঢ্য উপস্থাপনা দিয়ে শুরু হয়। ওই দেশের বর্ষবরণে প্রথা মেনে তাঁদের প্লেটে থাকে ব্ল্যাক আইড পিজ নামক একধরনের বিনস জাতীয় খাবার। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামী সৈনিকরা যুদ্ধের সময় বিনস খেয়ে কালযাপন করতেন বলে বিশ্বাস করেন মার্কিনিরা। তাই এই খাবার নতুন বছরে তাঁদের সৌভাগ্য,সৌদার্হ্য, সম্পদ করবে এটাই বহুযুগের ধারনা। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দারা শর্ষের শাক বা কলার্ড ,কর্ণ ব্রেড ও শুয়োরের মাংস খেয়ে তাঁরা নতুন উন্নত জীবনের প্রার্থনা করে।

পোল্যান্ড
পোল্যান্ডের বর্ষবরণ উৎসব খুব মজার। পোল্যান্ডের তরুণীরা এইদিন খরগোশের মতো পোশাক পরে এবং বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি জোগাড় করে যতটা সম্ভব চিবিয়ে খায়। তারা মনে করে শাক সবজি চিবিয়ে খেলে নাকি নতুন বছর অনেক সুন্দর এবং আশাপ্রদ হয়ে উঠবে। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে সমগ্র পোল্যান্ড বাসী খায় কানাপকি নামক একধরণের খোলা স্যান্ডুইচ। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান মানুষেরা স্মোকড ফিশ দিয়ে তৈরি একধরনের বিশেষ ডিশ পিকলড হ্যারিং খেয়ে সেলিব্রেট করে বর্ষবরণ (New Year)।

ইতালি
ইতালীতে আলু ও ডালের স্টু পরিবেশন করা হয় থার্টিফাস্টের ডিনারে। আর থাকে সাতটা ড্রাই ফ্রুট এবং নাটস। এর মধ্যে থাকে আমন্ড, চিনেবাদাম বা পিনাট, হাজেলনাট,ওয়ালনাট বা আখরোট,খেজুর , কিশমিশ,ও শুকনো ফিগস । তারা মনে করে সৌভাগ্য এবং সাফল্য, ভালবাসা ও সম্পদের প্রতীক এই সব খাবার। নতুন বছরকে আরও সুন্দর করে তুলতে ইতালীবাসী বাড়ির পুরনো সামগ্রীকে বিদায় জানায়। জানলার বাইরে রেখে দেন সেইসব বস্ত যার মধ্যে থাকে পুরনো আসবাবও।

গ্রিস
গ্রিকরা মনে করেন পেঁয়াজ হল নবজন্মের বা পুনর্জন্মের প্রতীক। তাই বর্ষবরণের রাতে তাঁরা পেয়াজের সারি লম্বা করে দড়িতে বেঁধে ডোরহ্যাঙ্গিং এর মতো করে ঝুলিয়ে রাখে। এই রীতি গ্রীস বাসির উন্নয়নের প্রতীক।এর সঙ্গে বর্ষবরণে গ্রীসবাসির ট্রাডিশনাল প্ল্যাটার সমৃদ্ধ হয় ভাসিলোপিটা নামের নিউইয়ার কেক,টমেটো স্যুপ, ক্যাবেজ স্যালাড,বিফ স্টিউ এবং রোস্টেড পর্ক,গ্রিক পাস্তা এবং ওয়াইন দিয়ে। দারুণ সব খানাপিনা নিয়ে মেতে ওঠে গ্রিসবাসী।

রাশিয়া
রাশিয়ান স্যালাড ছাড়া এই দেশের বর্ষবরণ অসম্পূর্ণ। ট্রাডিশনাল রাশিয়ান স্যালাড অলিভিয়ের খাওয়া এই দিন মাস্ট। পটেটো, ক্যারট, পিকল,গ্রিন পিস,এগ, চিকেন এবং মেয়োনিজ দিয়ে তৈরি এই স্যালাড, ওয়াইন এবং টোস্ট রাশিয়ান নিউইয়ার ইভের ডিনারের প্রধান অঙ্গ। নতুন পোশাক, জমজমাট আলোকজ্জ্বল সমারোহ নিয়ে মেতে ওঠে রাশিয়া।

নেদারল্যান্ড
ডাচেরা তাঁদের বর্ষবরণ যাপন করেন বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সকলকে নিয়ে পার্টি, ওপেন এয়ার কনসার্ট, আতশবাজির খেলায় শামিল হয়ে। এর সঙ্গে তাঁদের সেলিব্রেশনের অঙ্গ হিসেবে থাকে কিছু ট্র্যাডিশনাল ডাচ ডিশ। যেমন- সপ্লিট পি স্যূপ উইথ স্মোকড সসেজ, অলিবলেন (একধরনের ডিপ ফ্রাই করা ডাচ ডোনাট)এই ডোনাট ফলের টুকরো দিয়ে সাজানো হয়। এটি ডাচেদের কাছে নতুনবছরে সৌভাগ্যর প্রতীক। এছাড়া তাঁদের প্লেটে থাকে সুইট ব্রেড এবং অ্যাপেল বেইনেটস( আপেলের ডোনাট)। এই সময় তাঁরা নর্থ সি, লেক আর ক্যানেলে ডুব দিয়ে জলকেলিতেও মত্ত হয়।

Latest article