আবার একটা নতুন বছর। নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন নিয়ে নতুনের উদযাপনে আমরা তৈরি। এই নতুন বছরই আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে কোনও শেষেরই কিন্তু একটা নতুন এবং সুন্দর শুরু আছে, তা নতুন বিবাহিত জীবনে প্রবেশে হোক বা নতুন মাতৃত্বে হোক, সম্পর্কের ব্রেক আপ-এর পরের ফুরসতে নিজেকে আবিষ্কার করে হোক, চাকরি থেকে অবসরে হোক বা বিবাহবিচ্ছেদের পরে হোক তফাত শুধু আমাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গির। তাহলে সব শেষেরই সেই নতুন শুরুটাই হোক পজিটিভিটি দিয়ে আর আত্মবিশ্বাস দিয়ে।
আরও পড়ুন-শহরে জমে উঠেছে বাংলা সঙ্গীত মেলা
পুরনো চাকরি শেষে
নতুনের শুরু হোক নতুন বছরের প্রতিটা সকালেই। যা কিছু পুরনো, জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে থাকা ধ্যান-ধারণা, মন-মানসিকতা, যা কিছু স্থবির তা এবার সচল হোক। যেমন পুরনো চাকরি। যা এতদিন হয়তো ছিল আপনার কমফোর্ট জোন। এমন এক স্বস্তির জায়গায় আপনি বেশ গেড়ে বসেছিলেন অনেকগুলো দিন। চেনা বন্ধু, আর চেনা শত্রু দুই ডিল করা সহজ ছিল সেখানে। চেনা পরিবেশ তাই চোখ বন্ধ করেও চলা যেত। হঠাৎ করেই সেই চাকরিটা আর নেই। তাহলে কি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে! কখনওই না। পুরনোকে আঁকড়ে পিছিয়ে পড়ার চেয়ে, ভয় না পেয়ে এগিয়ে যাওয়ার নামই তো জীবন। তাহলে নতুন বছরে এগিয়ে যান না আরও এক ধাপ। কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে পড়েছেন আর তো চিন্তা নেই। কিছুদিন নিজেকে সময় দিন। তাড়াহুড়ো করে মরিয়া হয়ে চাকরি খুঁজতে যাবেন না। একটানা করলেন তো অনেকদিন। হাতে ছিল না ফুরসত বা ছুটি কোনটাই। এবার খানিক দিন ফুরসত নিন, সঙ্গে একটু বিশ্রাম। ভাবুন না যা মন চায়। করুন যা খুশি। তারপর রয়েবসে সিদ্ধান্ত নিন। সব সময় চাকরিই যে করতে হবে তার কী মানে। নিজেও তো কিছু করতে পারেন। প্রথমেই বেশি ইনভেস্টমেন্টে বেশি না-ই-বা গেলেন। ধীরে ধীরে এগোন। যদি রিস্ক নিতে পারেন এবং লেগে থাকেন তবে জয় কিন্তু আপনার নিশ্চিত।
নতুন বিয়ের পিঁড়িতে
সদ্য কি চারহাত এক হয়েছে? নতুন বছর যেমন অনেক লুকনো সারপ্রাইজ নিয়ে আসে তেমনই নতুন বিবাহিত জীবনও। দাম্পত্যের টক, ঝাল, মিষ্টি, সমীকরণ খুব মজার। একসঙ্গে এখন আর শুধু রোমান্টিসিজম নয়, সুখ, দুঃখ,ঝামেলা সব ভাগ করে নিতে হবে। এখন থেকে আপনার জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে, ঘরে বাইরে সঙ্গে থাকবে আরও একজন। শুধু স্বামী নয়, হয়তো থাকবে গোটা নতুন সংসারও। শাশুড়ি, শ্বশুর, দেওর। এই মানুষগুলোর সঙ্গেই এখন থেকে রোজনামচা। নতুন সংসারের রহন-সহন, খাওয়াদাওয়া আপনার সঙ্গে নাও মিলতে পারে বরং না মেলার সম্ভাবনাই বেশি। কিছুদিন না হয় একটু মানিয়ে নিলেন। বাড়িটা যদি আগে থেকে চেনা হয় তবে অসুবিধের কথা বলতে সমস্যা নেই যদি তা না হয় তাহলে খানিকদিন অপেক্ষা করুন। জানবেন উল্টোদিকের মানুষগুলোও কিন্তু আপনার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করছে। সমস্যা বলুন কারণ জীবনসঙ্গীর দায়িত্ব পরস্পরকে ভাল রাখার। সপ্তাহান্তে একটা দিন একটু নিজের পছন্দের রান্না করে সবাইকে খাওয়ান। মাসে একটা দিন সবাই মিলে বেড়াতে যান। নিশ্চয়ই নব দম্পতির প্রাইভেসি জরুরি, রইল তো পড়ে মাসের বাকি দিনগুলো। একে অপরকে সোজা ভাষায় কথা বলুন, ঘুরিয়ে নাকটা দেখাবেন না। প্রশংসা করুন সরাসরি, এতে সবকিছু সহজ হয়ে যাবে অনেকটাই। এমনকী পরিবারের মানুষদের ক্ষেত্রেও তাই। তাঁদের পছন্দ-অপছন্দকে যদি গুরুত্ব দেন তাঁরা দিতে বাধ্য।
আরও পড়ুন-আগুনের ফুলকি
ব্রেক-আপকে নতুন করে মেক আপ
সব-সম্পর্কই সুমধুর হবে এমনটা নয়। হতেই পারে গতবছর যে সম্পর্কের শুরু হয়েছিল সেটা আর মেন লাইনে নেই, একটু কর্ড লাইনে হাঁটছে। যাকে সঙ্গী ভেবেছিলেন সে আপনার জন্য কমপ্যাটেবল নয়। এখন কিছু করার নেই সম্পর্কের লেবু চটকে তেতো করে ফেলার চেয়ে সময় থাকতে বেরিয়ে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ। আপনার সঙ্গে মিস-ম্যাচ বলেই যে সেই মানুষটা খারাপ এমন কিন্তু নাও হতে পারে। খারাপ আর ভালটা ভীষণ আপেক্ষিক। তা সত্ত্বেও নতুন বছর ব্রেক-আপটা একটু চাপের বইকি। হঠাৎ করেই একটু একা লাগতে পারে। সবকিছু বোঝার পরেও মন মানতে চাইবে না, অবসাদও আসতে পারে। এখনই নিজের মনের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া আর বন্ধুত্বের দরকার। মনের সব কথা আপনি শুনবেন না। কোনও একজন ভাল বন্ধুর সঙ্গে এই ক্রাইসিসটা শেয়ার করতে পারেন। এমন ক্রাইসিসে সবচেয়ে কাজের বন্ধু হল পরিবার। যদি পরিবার আপনার পাশে থাকে কোনও হার্ডলসই কঠিন নয়। প্রিয়জনকে মনের কথা খুলে বললে অনেকটা হালকা লাগবে। সবাই মিলে কোথাও একটা ছোটখাটো ট্রিপ করতে পারেন। ভুলেও কোনও নেশার দিকে হাত বাড়াবেন না এতে সমস্যাই বাড়বে। সেল্ফ লাভ অনেক বড় বড় সমস্যা থেকে আপনাকে বের করে আনবে। তাই নিজেকে ভালবাসা অভ্যেস করুন। নিজেকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিন।
নতুন মায়ের প্রোমোশনে
তোজোর জন্ম ইস্তক ঘুম নেই মনীষার। বাচ্চাটা দিনে ঘুমোয় আর সারারাত জাগে। কী করবে সে? সত্যি সন্তান গর্ভে ধারণের সময় থেকেই একটা মেয়ের জীবন আমূল বদলে যায়। এই নতুন শুরুটা যেমন ঝক্কির, তেমন স্ট্রেসফুল আবার তেমনই আনন্দেরও। আসলে যে কোনও নতুনকে আবিষ্কার করা, নতুনের অভিজ্ঞতার, উপলব্ধি রোমাঞ্চকর হয়। একজন মায়ের প্রথম বদলটা আসে সন্তানকে গর্ভে ধারণের পর। সেটা বেশিটাই শারীরিক পরিবর্তন সঙ্গে খাওয়াদাওয়া, রহন-সহন বদলে যায়।
এরপর যখন ছোটসোনার জন্ম হল সেই পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকেন না বহু মা। চাকরি করছিলেন দুম করে ছেড়ে দিতে হয় কারণ মাতৃত্বের প্রোমোশন হয়েছে তাই এখন থেকে একজন মা ২৪x৭ অন ডিউটি। সেই পরিস্থিতিকে মানিয়ে নেওয়া শুরু। মুশকিল হল ছ-মাস পর্যন্ত শিশুকে ফিড করানো আর ইউরিন, পটি পরিষ্কার করা ছাড়া নতুন মায়ের আর কোনও কাজ থাকে না। হঠাৎ এমন এক অদ্ভুত দায়িত্বে নড়ে যায় মাতৃত্বের সুখকর অনুভূতিটাই। কারণ স্বামী বা পরিবারের আর পাঁচজনের জীবনে এই বদলটা ঘটে না। এই পিরিয়ডেই মেয়েরা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের শিকার হন। তাই এগিয়ে আসতে হবে পরিবারকেই। শ্বশুরবাড়িতে যদি হেল্পিং হ্যান্ড না থাকে মার কাছে থাকুন। এই সময় কো-পেরেন্টিং মাস্ট। একা থাকেন? স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে সামলান বাচ্চাকে। বাড়ির গুরুজনের কাছে বাচ্চাকে রেখে একটু বেড়িয়ে আসুন না খানিকটা সময়। নিজেদের মতো সময় কাটান দেখবেন হালকা লাগছে। শিশু যখন ঘুমোবে তখন নিজের কাজ, বিশ্রাম, পছন্দের যা কিছু সেরে ফেলুন। ঈশ্বরপ্রদত্ত এমন সুন্দর উপহারটিকে সবাই মিলে সামলালে, যত্ন করলেই দেখবেন নতুন প্রোমোশনটি মন্দ নয় উপরন্তু উপভোগ্য। তাও যদি অবসাদ আসে একবার কাউন্সেলিং করিয়ে নিন কারণ এই পিরিয়ডে অবসাদ আসাটা খুব নর্মাল।
পঞ্চাশের নতুন আমি
সদ্য মেনোপজ হয়েছে রমিতার। গত বছর ল্যাজে গোবরে হয়েছে সে। একবার মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল শুরু হলে পনেরোদিন ধরে চলত। অন্যদিকে ছেলে সার্থকের চিন্তা। ছেলেটা আর মা ন্যাওটা নেই বড় হয়ে গেছে। এতদিন ছেলের জন্য ফিরে তাকানোর সময় পেত না সে এখন একদম ফাঁকা। কোনও কাজ নেই মনে হয়। দুয়ে মিলে ডিপ্রেশন চরমে। আসলে পঞ্চাশ পেরনো মানেই পুরনো হিসেবে গরমিল। স্বামী, ছেলেমেয়েরা নিজের জগতে ব্যস্ত। তাহলে আপনার জগৎ? আবার নতুন করে নিজেকে সময় দেবার সেই পরম মুহূর্ত তো এসে হাজির আপনার দোড়গোড়ায়। এইসময় কিছু শিখতে মন চায় শিখুন না। শেখার তো কোনও বয়স হয় না। মহিলাদের একটা গ্রুপ হলে মন্দ কী। সপ্তাহান্তে একজোট হয়ে একটু আড্ডা হোক। এক-একজন এক-একটা রান্না করে নিয়ে যান। হোক না এর-ওর জন্মদিন পালন। ছোটখাটো পিকনিক, একটু সৎসঙ্গ। ভাল ভাল সিনেমা রিলিজ করছে একটু দেখে এলে ক্ষতি কী। ওটিটি রয়েছেই তো ভাল ভাল ওয়েব সিরিজ আপনাকে চিন্তার রসদ জোগাবে। আর শরীর সুস্থ রাখতে যোগাসন, প্রাণায়ামকে বন্ধু করে নিন। দেখবেন পঞ্চাশেই আপনি পঁচিশের আমিকে নতুন করে বরণ করে নিচ্ছেন।
আরও পড়ুন-আগুনের ফুলকি
বিয়ে ভাঙলেও নিজে ভাঙবেন না
বিবাহবিচ্ছেদ নতুন কোনও ঘটনা নয়। সম্পর্কের জটিলতায় যখন গলার কাঁটা হয় তখন সম্পর্ক রাখা দায় হয়ে যায়। কিন্তু বিচ্ছেদ যেমনই হোক তা যন্ত্রণার। সেই ভাঙনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক কিছু। প্রেমের ব্রেক আপ আর বিয়ের ব্রেক আপ দুয়ের কিন্তু আকাশ আর পাতাল ফারাক। এই ফারাকটা তিনি বোঝেন যিনি এই গোটা বিষয়টার মধ্যে দিয়ে যান বা যাচ্ছেন। একটা গোটা স্বপ্ন এলোমেলো সব প্ল্যানিং-এর দফারফা। সংসার গুটিয়ে বেরিয়ে পড়া কী আর মুখের কথা! হাজারো প্রশ্ন উঁকি দেয় মনে। ‘কেন এমন হল?’ যে শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন আবার সেখানেই দাঁড়িয়ে। হঠাৎ একটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়ে গেল। তাই বলে কি সব স্তব্ধ হয়ে যাবে? একেবারেই তা নয়। আমরা কি নতুন বছরে পিছন দিকে হাঁটব? সামনে এগোব না?
তাহলে নিজের ওপর মনোযোগ দিন। এই একটা ভাল সময় আপনি পেয়েছেন নিজেকে একটু আবিষ্কার করার। প্রাপ্তবয়স্ক তো, কে আটকাবে বেরিয়ে পড়ুন একটা লম্বা ট্রিপে। আপনি যদি সন্তানের মা, তাকে সঙ্গে নিয়ে নিন, দু’জনে মিলে আপনাদের একাকীত্ব যাপন করুন সেখানে, দেখুন বোঝাটা অনেক হাল্কা হয়ে গেছে। সঙ্গীর সঙ্গে কাটানো সময়গুলোতে আপনি অনেক কিছু শিখেছেন। সেসব বিষয় নিজের জীবনে কাজে লাগান। নিজেকে খুশি করতে যেটা মন চায় করুন। আত্মবিশ্বাসে কখনও ভাটা পড়তে দেবেন না। সাজুন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দিন নিজেকে কমপ্লিমেন্ট। দেখুন কেমন মন ভাল হয়ে যায়। একসঙ্গে বড় স্বপ্ন পূরণ করতে পারছেন না তো কী হয়েছে ছোট ছোট স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে থাকুন। প্রাণায়াম করুন নিয়মিত, এতে মনের বোঝা অনেকটা কমে যাচ্ছে। অতীত স্মৃতি চোখের সামনে রাখবেন না।
নতুন অবসরে
অবসর গ্রহণ করুন বা নাই করুন জীবনের উদ্দেশ্য এবং অর্থবোধ থাকা খুব জরুরি। অবসর আসলে জীবনের একটা ধাপ। এই ধাপগুলো যে যত বুদ্ধি করে পা রাখবে সেই তো লাভবান। তাই সেই প্রতিটা ধাপেই কর্ম করে যাওয়াটাই আসল। এই সময় মনে হতেই পারে সবকিছু থেকেও যেন নেই। এক ধরনের নিঃসঙ্গতা সবসময় তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আগে বই পড়তে ও গান শুনতে পছন্দ করতেন। এখন সেগুলোও ভাল লাগে না। সারাক্ষণ একা চুপচাপ বসে থাকা। আচ্ছা নতুন বছরে যাঁরা রিটায়ার করছেন তাঁরা নিজেদের পুরনো ইচ্ছেগুলোকে একবার চাগাড় দিয়ে দেখুন না। সেই সব শখ যা সভয়ের চাপে পূরণ করা হয়ে ওঠেনি। ছোটখাটো একটা ছাদবাগান করতে পারেন। মরশুমি ফুলগুলো যখন আপনার হাতে প্রাণ পাবে দেখবেন কত সুন্দর। নতুন করে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আবার দেখা করুন। অবসর মানেই ষাট বছর। এখনই তো নিজের দিকে তাকানোর সময়। একটু সকাল সকাল হাঁটতে বেরলে অসুবিধে কোথায়। আর ফ্যামিলি টাইম মানেই সব মুশকিল আসান। চাকরি করতে গিয়ে বাড়ির কাজ তেমন করে করতেই পারেননি একটু এবার হাতে হাতে লেগে পড়ুন। তাঁদের সঙ্গে প্রচুর সময় কাটান না, ব্যস আর আপনাকে পায় কে!