নেপথ্য গায়িকা হিসেবে খ্যাতি অর্জন
স্নেহ করতেন শচীন দেববর্মন। ছিলেন বড় দাদার মতো। আগলে রাখতেন। একটু অন্যরকম সুর বাঁধলেই ভাবতেন গীতার কথা। শচীনকর্তা বলতেন, ‘‘ভাল করে গাইতে হবে। সারা দেশে যেন বাঙালির মান বজায় থাকে।’’ গীতা মনপ্রাণ উজাড় করে গাওয়ার চেষ্টা করতেন। ফল পেতেন হাতেনাতে।
১৯৪৭ সালে ‘দো ভাই’ ছবিতে গেয়েছিলেন গীতা। শচীন দেববর্মনের সুরে। অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ‘মেরা সুন্দর স্বপ্না বিত্ গ্যয়া’ গানটি। ওই গানের মাধ্যমেই নতুন গায়িকা হিসেবে গীতা সারা ভারতে হিন্দি ছবির নেপথ্য গায়িকা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। যদিও তার আগে, ১৯৪৬ সালে, কে হনুমান প্রসাদের সুরে ‘ভক্ত প্রহ্লাদ’ ছবিতে গান গেয়েছিলেন। তখন তিনি ষোলো।
দু’জনে মুখোমুখি
১৯৫১ সালে শচীন দেববর্মনের সুরে ‘বাজ়ি’ ছবির গান রেকর্ডিং করেন গীতা। অসামান্য সব গান। স্টুডিওয় উপস্থিত ছিলেন ছবির প্রযোজক-পরিচালক গুরু দত্ত। গীতার গান তাঁকে রীতিমতো পাগল করে দেয়। দু’জন মুখোমুখি হন। কথা বলেন। গীতারও ভাল লেগে যায় গুরুকে। দু’জনের মধ্যে রচিত হয় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ১৯৫৩-র ২৬ মে, তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। গীতা ঘোষ রায়চৌধুরী হয়ে যান গীতা দত্ত।
আরও পড়ুন-রোমানিয়ার পার্লামেন্টে ভালুক হত্যার অনুমতি
অসামান্যতাকে মান্যতা
সেই সময় বিভিন্ন ছবিতে গীতার পাশাপাশি গেয়ে চলেছেন লতা মঙ্গেশকর। আশা ভোঁসলে তখনও অনেক দূরে। ১৯৫২ সালে আরব সাগর তীরে পা রাখেন এক তরুণ সংগীত পরিচালক, ও পি নাইয়ার। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। প্রথম হিন্দি ছবি ‘আসমান’। রেকর্ডিংয়ে লতার গাওয়া চারটি গান অপছন্দের কারণে বাতিল করে দেন। এরপর আর কোনওদিন কোনও গান লতাকে দিয়ে গাওয়াননি। তা সত্ত্বেও নিজেকে সুরকার হিসেবে সাফল্যের শিখরে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ভরসা করতেন গীতার কণ্ঠের উপর। এই সুরকার-গায়িকা জুটি শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন অসংখ্য হিট গান। শচীন দেববর্মন, ও পি নাইয়ারের পাশাপাশি পঙ্কজকুমার মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, মদনমোহন, রবি, তিমিরবরণ, কানু রায়-সহ অনেকেই মান্যতা দিয়েছেন গীতা দত্তের অসামান্যতাকে। নিজেদের সুরে তাঁকে দিয়ে গাইয়েছেন একটার পর একটা গান।
সুচিত্রার ঠোঁটে
১৯৫৭ সালের বাংলা ছবি ‘হারানো সুর’। নায়ক উত্তমকুমার। নায়িকা সুচিত্রা সেন। ছবিতে ছিল দু’টি গান। পুরুষকণ্ঠের গানটি গাইবেন ছবির সংগীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। নারীকণ্ঠের গানটির জন্য হেমন্ত ভাবলেন গীতার কথা। প্রযোজক উত্তমকুমার ও পরিচালক অজয় কর আপত্তি জানালেন। কারণ, সেই সময় সুচিত্রা মানেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বললেন, এই গানটি গীতা ছাড়া আর কেউ সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবে না। গীতা গাইলেন— ‘তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার’। ভরপুর রোমান্টিক দৃশ্যে সেই গানে ঠোঁট মেলালেন সুচিত্রা। বাকিটা ইতিহাস।
আরও পড়ুন-টোকিওর পদক ভুলেই প্যারিসে নামছি : নীরজ
পাখির পায়ে বেড়ি
গীতার যখন বিয়ে হয়, তখন তিনি খ্যাতির মধ্যগগনে। তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে তাঁর সাফল্যের নৌকো। নতুন নতুন গান আসছে ঝুলিতে। তাঁর কণ্ঠে সুরকাররা পেতেন নির্ভরতা। সেই সময় গুরু পায়ের তলায় জমি ঠিকভাবে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। হতাশা গ্রাস করছিল তাঁর মধ্যে। সংবাদমাধ্যমে লেখা হচ্ছিল, গুরু নাকি গীতার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত। এইসব খবর আরও বেশি বিষিয়ে তুলেছিল গুরুর মন। দাম্পত্য জীবন থেকে হারিয়ে যেতে থাকল সুখ। গুরু কড়া নির্দেশ দিলেন গীতাকে, তাঁর ছবি ছাড়া আর অন্য কোথাও গান গাওয়া চলবে না। এ যে অসম্ভব! পাখির পায়ে বেড়ি পরানোর মতো। তবু সংসারের কথা ভেবে, তিন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে গুরুর নির্দেশ মেনে নিলেন গীতা। এড়িয়ে গেলেন সংঘাত।
অবসাদে আক্রান্ত
তবে মাঝেমধ্যে লুকিয়ে রেকর্ডিংয়ে যেতেন। গুরু বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে। আবার স্বামীর ফেরার আগে বাড়িতে ঢুকে পড়তেন। ঘড়ি দেখে কি গান হয়? তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কাজে মন বসাতে পারছিলেন না। প্রভাব পড়েছিল গানে। সুরকাররা বুঝছিলেন। কিন্তু জনপ্রিয় শিল্পীকে কিছু বলতেও পারছিলেন না। তবে কেউ কেউ সরে আসছিলেন গীতার থেকে। কাজ কমে আসতে থাকে ‘গানের রানি’র। ধীরে ধীরে চেপে বসে হতাশা। সেই সময় স্বামী সম্পর্কে কানে আসতে থাকে নানারকম কথা। কোনও এক নায়িকার সঙ্গে নাকি সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন গুরু। মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হলেন গীতা।
ফিরল হারানো ছন্দ
গুরু চেষ্টা করলেন স্ত্রীকে স্বাভাবিক করে তুলতে। গীতাকে নায়িকা করে ‘গৌরী’ নামে একটি বাংলা ছবির পরিকল্পনা করলেন। হারানো ছন্দ এবং আনন্দ ফিরে এল দাম্পত্য জীবনে। শুরু হল কাজ। ছবির জন্য শচীন দেববর্মনের সুরে গীতা গাইলেন ‘জানি ভোমরা কেন কথা কয় না’ এবং ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’ গান দুটি।
কিন্তু সুখ দীর্ঘস্থায়ী হল না। ফের দেখা দিল জটিলতা। ক্রমেই দাম্পত্যের রসায়ন নষ্ট হতে লাগল। মাঝপথেই বন্ধ হয়ে গেল ছবির কাজ। মুষড়ে পড়লেন গীতা। খানখান হয়ে গেলেন। মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন স্বামীর থেকে। তীব্র হতাশা গ্রাস করল। ডুব দিলেন মদিরায়। ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল তাঁর রূপ, যৌবন। কমে গেল গলার ঝাঁজ।
আরও পড়ুন-ফের বিপুল কর্মসংস্থান রাজ্যে! শূন্য প্রধান শিক্ষক পদে দ্রুত নিয়োগ
অত্যাচারের ফল
১৯৬৪-র ১০ অক্টোবর, আত্মহননের পথ বেছে নিলেন গুরু দত্ত। সেই ধাক্কা নিতে পারলেন না গীতা। চরমভাবে ভেঙে পড়লেন। তখন তাঁর পাশে দাঁড়ালেন কয়েকজন সুরকার, প্রযোজক। গীতা আবার নতুন উৎসাহে শুরু করলেন কাজ। কিন্তু হারানো জনপ্রিয়তা আর ফিরল না।
একটা সময় দিনের পর দিন নিজের উপর অত্যাচার করেছেন। হাতেনাতে পেলেন তার ফল। আক্রান্ত হলেন সিরোসিস অফ লিভারে। ১৯৭২-এর ২০ জুলাই, মাত্র ৪১ বছর বয়সে চলে গেলেন চিরঘুমের দেশে, ওই সুরভরা দূর নীলিমায়। রেখে গেলেন অসংখ্য মনমাতানো গান। যেমন— ‘একটু চাওয়া আর একটু পাওয়া’, ‘শচীমাতা গো’, ‘কৃষ্ণচূড়ার আগুন তুমি’, ‘কত গান হারালাম’, ‘কাচের চুড়ির ছটা’, ‘নিশিরাত বাঁকা চাঁদ’, ‘ঝনক ঝনক কনক কাঁকন’, ‘বাঁশি বুঝি সেই সুরে’, ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়’, ‘এই মায়াবী তিথি’ ইত্যাদি। এইসব গান শ্রোতাদের প্রতি তাঁর গীতাঞ্জলি।