মন্দির-মসজিদ বিবাদের সুবাদে কেউ আবার নেতা হয়ে যাবেন না

দেশে চলতি মন্দির-মসজিদ বিবাদ অবিলম্বে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। সম্প্রতি এমনই মন্তব্য করেছিলেন আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবত। অথচ এর ঠিক উল্টো সুর শোনা গেল সংঘের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এ। পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যায় দাবি করা হয়েছে, সোমনাথ, সম্ভল বা দেশের অন্যান্য স্থানে ‘ঐতিহাসিক সত্য উদ্ঘাটনে’র লড়াই চলছে। সংশ্লিষ্ট স্থানের প্রকৃত ইতিহাস অনুসন্ধান যে কোনও সভ্যতার সুবিচারের জন্য জরুরি বলেও সেখানে মন্তব্য করা হয়েছে। এই আবহে পুরো বিষয়টা অসাম্প্রদায়িক অবস্থান থেকে নিরীক্ষণ করছেন ড. মইনুল হাসান

Must read

সারা দেশে মন্দির-মসজিদ নিয়ে বিতর্ক আর থামতেই চাইছে না। রামমন্দির-বাবরি মসজিদ বিতর্কের আপাত অবসান হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের রায় দেবার পর। রামমন্দির হয়ে গিয়েছে। মুসলমানরা-সহ ভারতের সব মানুষ এই রায় মেনে নিয়েছেন। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ভারতবাসী এই রায় মেনেছিলেন এমন আশা নিয়ে হয় এক দীর্ঘমেয়াদি জটিলতার অবসান হল বা হবে ভেবে। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে পরিস্থিতি দৈনিক জটিল আকার ধারণ করছে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি সারা দেশের মসজিদের নিচে কোনও না কোনও একটা মন্দির আছে বলে মনে করেছে। তাদের ইচ্ছা সব মসজিদ ভেঙে অথবা ঠেলে ফেলে দিয়ে নিচে মন্দির ছাপ বের করবে এবং এলাকাটি দখল করবে। সম্প্রতি বিষয়টি সামনে এল যে উত্তরপ্রদেশের সম্ভলের প্রাচীন মসজিদ নিয়ে। হিন্দুত্ববাদীরা দাবি করছেন যে এই মসজিদ মন্দিরের উপর তৈরি হয়েছে। সুতরাং মসজিদ ভেঙে মন্দির প্রকাশ হোক। এমনকী রাজস্থানের আজমির শরিফের নিচেও শিবমন্দির আছে বলে হিন্দুত্ববাদীরা দাবি করছেন এবং আদালতে গেছেন তাঁরা। সব মামলা আদালতের কাছে জমা আছে।

আরও পড়ুন-সংঘবদ্ধ সার্ভিসেসকে নিয়েই চিন্তা সঞ্জয়ের, আজ সন্তোষ সেমিফাইনাল

এই দেশে এত মন্দির বা মসজিদ আছে সবই যদি বিতর্কিত হয় এবং খুঁড়ে খুঁজে দেখতে হয় আসলে সেটা কী? তাহলে চাষের জন্য জমিতে লাঙল বা ট্রাক্টর চালাতে হবে না। হিন্দুত্ববাদীরা জমি খুঁড়ে চাষের জন্য তৈরি করে দেবে। যাক, সে সব কথা। আসল কথাতে আসি। নতুন করে সবাইকে মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে যে ১৯৯১ সালে এদেশে একটি আইন তৈরি হয়েছিল। ধর্মস্থান (বিশেষ ব্যবস্থা) আইন, ১৯৯১। এই আইনে প্রচুর কথা বলা থাকলেও মোদ্দা কথাটি ছিল, কোনও মন্দির, মসজিদ, গির্জা বা কোনও ধর্মস্থানের চরিত্র পাল্টানো যাবে না। ১৯৪৭ সালে, দেশের স্বাধীনতা লাভের সময় যেমন ছিল, যেখানে ছিল এবং যা ছিল তাই রাখতে হবে। শুধুমাত্র অযোধ্যর রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদকে এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল। তার কারণ এই বিষয়ে বিভিন্ন আদালতে মামলা ছিল। সুপ্রিম কোর্ট এই মামলা শোনার প্রতীক্ষায় ছিলেন।
১৯৯১ সালের এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করে বিজেপি নেতারা মামলা করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিজেপি নেতা হচ্ছেন অশ্বিনী উপাধ্যায়, সুব্রহ্মণ্যম স্বামী, বিশ্ব ভদ্র পুরোহিত, মহাসংঘ ইত্যাদি। কাশী-মথুরার মসজিদ প্রসঙ্গেও মামলা হয়। দাবি, মসজিদের জমি হিন্দু সংগঠনগুলিকে দিতে হবে। কারণ এগুলো নাকি মন্দির ছিল। রামমন্দির হলেই সমস্যা কমবে না সেটা বিজেপি তথা সংঘ পরিবার অবশ্য আগেই জানিয়েছিল। স্লোগান দিয়েছিল ‘অযোধ্যাতে স্রিফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়।’ অযোধ্যার মামলার দিকে একবার আপনার নজর ঘোরাতে চাইব। শত শত পাতার এই রায়ে মুসলিমদের দাবি কতখানি যুক্তিসঙ্গত তা বলা হয়েছে। বিচারপতি রায় দেবার আগের রাত্রে ঘুমোতে পারেননি। তারপর রায় দিয়েছেন রামমন্দিরের পক্ষে। কারণ সেটা বিরাট অংশ মানুষের অনুভব। যুক্তি বাদ দিয়েও রায় দেন আদালত সেটা আমরা দেখেছি। কিন্তু অযোধ্যার রায়েতে ৫/৬ পৃষ্ঠা জুড়ে ১৯৯১ সালের ধর্মস্থান (বিশেষ ব্যবস্থা) আইনকে সম্মান দেওয়া ও মান্য করার কথা আছে। এটাও সেই অযোধ্যা রায়েতে বলা হয়েছে যদি তা না করা হয় তাহলে দেশব্যাপী অরাজকতা শুরু হবে।

আরও পড়ুন-উত্তরের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা চা আর পর্যটন শিল্পের

সম্মাননীয় উচ্চ আদালত তাদের কথা বা নির্দেশের মর্যাদা রাখতে পারেননি। কাশীর জ্ঞানব্যাপী মসজিদ মামলায় এলাহাবাদ হাইকোর্ট সমীক্ষার নির্দেশ দিলেন। ১৯৯১ সাল তাঁদের অজানা নয়, বরং সবার চাইতে ভাল জানেন। তিনি বললেন সমীক্ষা করা মানেই ধর্মস্থানের চরিত্র বদলানো নয়। শাক দিয়ে একটা ছোট পুঁটি মাছের মাথাও তিনি ঢাকতে পারেননি। পরের মামলাতেই হিন্দুত্ববাদীরা প্রতিদিন পুজার্চনার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। মসজিদের দৈনিক প্রার্থনার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। তাহলে সুপ্রিম কোর্টেই ১৯৯১ সালের আইনকে লঘু করার পক্ষে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছে। আমি শীর্ষ আদালতের সমালোচনা করতে চাই না। তবে এই মহান প্রতিষ্ঠানের এজলাসকে ব্যবহার করে অনেক বিচারক এমন রায় দিয়েছেন যা দেশের গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিপক্ষে গেছে।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রোহিংটন নরিম্যান সঠিক বলেছেন— ‘রামমন্দিরের পক্ষে রায় বিচারের অপলাপ হয়েছিল। কিন্তু সেই রায়েও সুপ্রিম কোর্ট পাঁচ পৃষ্ঠা জুড়ে ধর্মস্থল আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিল। এখন হাইড্রার মাথার মতো রোজ নিত্যনতুন মন্দির-মসজিদ বিতর্ক মাথা তুলছে। তা ঠেকাতে হলে ১৯৯১-এর আইনকে সবার কাছে জানাতে হবে।’ তিনি জেলা আদালতের বিচারকদের শিক্ষার কথা বলেছেন। কিন্তু জ্ঞানব্যাপী মসজিদের ব্যাপারটি যখন সুপ্রিম কোর্টে এল তখন প্রধান বিচারপতি এলাহাবাদ হাইকোর্টের সমীক্ষার নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ দেননি। প্রধান বিচারপতির এই কর্মকাণ্ডে মন্দির, মসজিদ নিয়ে মামলা বেড়ে গিয়েছে। আদালতে এই সংক্রান্ত পিটিশনের পরিমাণ বেড়ে গেছে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি, এখন অবসরপ্রাপ্ত, তার কারণে মসজিদ/মন্দির বিতর্কের মুখ খুলে গিয়েছে। সম্ভল মসজিদ সম্পর্কে হিন্দুত্ববাদীদের দাবি যে, মৌলবাদী, বর্বর, হানাদাররা হামলা চালিয়ে হিন্দুমন্দির ধ্বংস করে মসজিদ তৈরি করেছিল। এখন সেটা ফেরত পাওয়ার সময় হয়েছে তথাকথিত হিন্দুদের। ১৯৯১ সালের আইনের জন্য তারা সম্ভল মসজিদ ‘পুনর্দখল’ করতে পারছেন না। সুতরাং আইনটা পাল্টানো হোক।
কেন্দ্রীয় সরকার এখনও তাদের মতামত এফিডেবিট করে সুপ্রিম কোর্টে কিছু জানায়নি। তারা সময় হত্যা করেছেন, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমাদের দেশের সংবিধানে যে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সৌভ্রাতৃত্বের কথা আছে, যা সংবিধানের প্রস্তাবনার মধ্যেই আছে সেই চিন্তনগুলিকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বিজেপি জনস্বার্থে মামলার মুখোশে। দেশের সামনে এতবড় বিপদ আসেনি। প্রধানমন্ত্রী, গৃহমন্ত্রী সংবিধানের ৭৫ বছর পূর্তিতে কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করছেন মাত্র। সেই সঙ্গে ভারত সংবিধানের অন্যতম প্রধান রূপকার বাবাসাহেব আম্বেদকর সম্পর্কে গৃহমন্ত্রীর কুৎসিত মন্তব্য অবশ্যই বিচার্য।

আরও পড়ুন-গান্ধীজির আসার দিন মনে রেখে আজও মেলা হয় এক্তারপুরে

তবে দেশের উচ্চ আদালতের উপর আমরা— দেশের কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস স্থাপন করে চলেছি। মহামান্য উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি এক নতুন ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি এবং তাঁর বেঞ্চ ধর্মস্থল (বিশেষ ব্যবস্থা) আইন সম্পর্কে আর্জি শুনবেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের রায় দেবার আগে দেশের কোনও আদালত মন্দির-মসজিদ সংক্রান্ত বিতর্কের পিটিশন নিতে পারবে না।
স্বাধীনতার এতবছর পরেও আমরা অবাক হচ্ছি যে, সুস্থভাবে জীবনধারণ করা, দেশ গঠনের কাজে যুক্ত হওয়ার চাইতে মন্দির/মসজিদ বিতর্ক বেশি জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এর পিছনে কেন্দ্রীয় সরকার এবং তাদের দলের মদত আছে। দেশের দারিদ্র, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধির মতো জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে ধামাচাপা দেবার জন্য এই সমস্ত কুৎসিত ঘটনাগুলোকে সামনে আনা হয়। আমরা অন্তত মহামান্য উচ্চ আদালতের কাছে প্রার্থনা করি, দেখুন, আপনাদের আসনটি যে উচ্চস্থানে থাকে। তারপর বাকিটা দেশের মহান জনগণ ঠিক করবেন।

Latest article