আত্মহত্যা নয়

আন্তর্জাতিক ল্যান্সেট জার্নাল বলছে, ১৯৯০ সালে পৃথিবীর সব আত্মহত্যার প্রায় ২৫ শতাংশই করেছিলেন ভারতীয় নারীরা। আর ২০১৬ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩৬.৬%।

Must read

ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী আত্মহত্যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন ঘটনা আকছার ঘটে। আসল তথ্যটি হল প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় দশ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি বছর সারা বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা হল ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ। কিশোর-কিশোরী আর যাঁদের বয়স পঁয়ত্রিশ বছরের নিচে তাঁদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে গত বছর পর্যন্ত প্রতি পঁচিশ মিনিটে একজন গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন।

আরও পড়ুন-সুইসাইড পয়েন্ট

আন্তর্জাতিক ল্যান্সেট জার্নাল বলছে, ১৯৯০ সালে পৃথিবীর সব আত্মহত্যার প্রায় ২৫ শতাংশই করেছিলেন ভারতীয় নারীরা। আর ২০১৬ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩৬.৬%।
ল্যান্সেটে প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, ভারতে যত নারী আত্মহত্যা করেন তাঁদের ৭১ শতাংশেরও বেশির বয়স ১৫ থেকে ৪০-এর মধ্যে। বিশ্বে প্রতিবছর যত নারী আত্মহত্যা করেন, তার প্রতি দশজনের মধ্যে চারজনই ভারতীয় নারী। এই গুরুতর সমস্যার নানা দিকে নিয়ে আলোচনা করলেন বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ রিমা মুখোপাধ্যায়, ডায়মন্ড হারবার গভর্নমেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিন্সিপাল উৎপল দাঁ, বারাসত জেলা হাসপাতালের সুপার সুব্রত মণ্ডল।

ডাঃ রিমা মুখোপাধ্যায়
(মনোরোগ বিশেষজ্ঞ)

 খুব একটা আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই এই বিষয়টা নিয়ে। আমরা যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করি, তাতে নারীদের প্রতিটা ক্ষেত্রেই অনেক চাপের মধ্যে থাকতে হয়— পরিবার হোক, সামাজিক হোক বা কর্মক্ষেত্র হোক। নারীরা দশভুজা হয়ে উঠে সব দিক সামলিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা করেন, সমাজের কাছে পরিবারের কাছে ভাল হয়ে ওঠার জন্য, তার ফলে তাঁর নিজের ওপরে যে চাপ পড়ে তার দিকে খেয়াল রাখেন না তাঁরা নিজেরাই।

আরও পড়ুন-বিক্রম বেতাল-এর রূপকথা ও এক অদ্ভুত কাহিনি

একটি মেয়েকে ছোট থেকেই শেখানো হয় তোমাকেই মানিয়ে চলতে হবে। একদিকে যেমন পড়াশুনোর চাপও তাঁকে দেওয়া হয় বলা হয় কেরিয়ার গড়তে হবে। অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তুলনা দেওয়া হয়। আবার সেই বাবা-মা-ই আবার বিয়ে দেবার সময় মেয়ের মতামতকে স্বাধীনতা দেন না। বিয়ে হলে সেই মেয়েটাকেই বলা হয় অ্যাডজাস্ট করো। এখনও এই সমাজে মেয়েদের ডিভোর্স পরিবারের কাছে লজ্জার। মেয়েরা নিজেরাও সেই কথা বেশিরভাগ ক্ষেত্র গোপন করে।
এ তো গেল একটা দিক, আরেকটা দিক হল একজন মা নিজেই পুত্রসন্তান চান এবং কন্যাসন্তান হলে সেটা নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন। গোটা পরিবার অনেক সময় তাঁকে দোষারোপ করে। সেই মেয়েটি ছোট থেকেই জেনে যায় যে তাঁর বাবা-মা ছেলে চেয়েছিল মেয়ে নয়। সে ছোট থেকে একটা খারাপ অনুভূতি নিয়ে বেড়ে ওঠে কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না। এরপর যাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তারাও তো সেই মেয়েটির মতোই অনভিজ্ঞ। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে মনের ভার মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। এরপর কারও সঙ্গে সম্পর্ক হলে তাঁকেই ধ্যানজ্ঞান ভেবে বসে।

আরও পড়ুন-ইন্ডোরে পাল্টা লড়াইয়ের ডাক: নয়া স্লোগান- এজেন্সি নয়, চাকরি চাই

বাবা-মা সন্তানকে মানুষ করছেন বা সব সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেন বলেই তাঁরা  সন্তানকে বুঝে ফেলেছেন এটা ভেবে ফেলা খুব ভুল। যত দিন গড়াচ্ছে অবাধ মেলামেশা বাড়ছে। এখন বহু পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব, সম্পর্ক এগুলো আমঘটনা। নিজেদের দারুণ আপ টু ডেট ক্যাজুয়াল মনে করে তাঁরা মিশছে কিন্তু আসলে সেটাই হতে পারছে না। মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেকের সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে কোনও একজনের সঙ্গে মানসিক ভাবে ইনভলভ হয়ে যাচ্ছে। তখন-যখন আঘাত পাচ্ছে মনে হচ্ছে আর বেঁচে থেকে কী লাভ!
বাবা-মায়েদের তাঁদের ছেলেমেয়েদের উপর অতিরিক্ত প্রত্যাশা এবং ছেলেমেয়েদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা— এটাও আত্মহত্যা প্রবণতা বৃদ্ধির একটা কারণ। উঠতি মেয়েদের মধ্যে গ্ল্যামার জগতের প্রতি একটা তীব্র আকর্ষণ দেখা যায় এবং সেইদিকে তারা ছোটে। নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো বুঝতে পারে না এবং বেশিরভাগই পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজটা করে। হয়তো দেখা গেল প্রথম প্রথম তাঁরা সফলও হয় কিন্তু কিছুদূর গিয়ে যখন আটকে যায় সেটার সঙ্গে ক্লোজ-আপ করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। হাতে টাকা আসতে না আসতে নিজেদের লাইফস্টাইল অনেকটা বাড়িয়ে ফেলে। সমস্যায় পড়লে বাবা-মায়ের কাছে আর ফিরে যেতে পারে না বা চায় না। করোনাকালে যখন প্রায় প্রতিটা পেশাই কম-বেশি ধাক্কা খেয়েছে তখন কিন্তু অনেকটা সুইসাইড বেড়ে গিয়েছিল যার অন্যতম কারণ এটাও। প্ল্যানড সুইসাইড কিন্তু এক্ষেত্রে খুব একটা হয় না সবটাই মুহূর্তের ভুল— হুট করে ইমপালসিভ হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।

আরও পড়ুন-গণতান্ত্রিকভাবে বাংলাকে বিরোধীশূন্য করার চ্যালেঞ্জ

আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বিবাহিত মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি। পরিবার হোক, সামাজিক হোক বা কর্মক্ষেত্র হোক। নারীরা দশভুজা হয়ে উঠে সবদিক সামলিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা করেন, সমাজের কাছে পরিবারের কাছে ভাল হয়ে ওঠার জন্য, তার ফলে তাঁর নিজের ওপরে যে চাপ পড়ে তার দিকে খেয়াল রাখেন না তাঁরা নিজেরাই। শ্বশুরবাড়িতে  শারীরিক-মানসিক অত্যাচার নতুন কিছু নয়।  হাজার করেও স্বামী পরিজনদের এক্সপ্রেশন পূর্ণ করতে পারেন না তাঁরা। সেখানে লাঞ্ছিত হতে হতে যখন বাবা-মার আশ্রয় চায় তখন বাবা-মা বা পরিবার সেই সাপোর্টটা দিতে পারে না। ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার থেকে মেয়ের মরে যাওয়া ভাল— এমন কথা বাবা-মায়েদের বলতে শোনা যায়। ডিপ্রেশন সম্পর্কে এখনও সোশ্যাল স্টিগমা রয়েছে। কেউ নিজের অবসাদ কাউকে বলে না এবং সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবার কথা ভাবতেও পারে না। এটাকে দুর্বলতা বলে মনে করা হয়।  অনেকের এটা ধারণা, যে সুইসাইডের কথা বলছে সে কখনও করবে না, তাই মুখে বলছে। আসলে কিন্তু তা একেবারেই নয় যে সুইসাইড করে সে কখনও না কখনও মুখে কাউকে না কাউকে বলে। বেশির ভাগই এটা করে তাই এমনটা শুনলে সতর্ক থাকা খুব জরুরি।

আরও পড়ুন-পুজোয় হাজির বৌদি canteen

সমাধান
যখনই কেউ আত্মহত্যার কথা বলে তাকে নিয়ে সতর্ক হতে হবে। কাউকে খুব ডিপ্রেসিভ দেখলে বা কেউ একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দেখলে তাঁকে মানসিক সাপোর্ট দেওয়া। এর পাশাপাশি বাবা-মাকে ছোট থেকেই সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রে কারণ মেয়েরা ইমোশনালই খুব দুর্বল হয়। তাই কথা বলতে হবে যাতে সন্তান সবটা শেয়ার করে। কোথাও কোনও একাকীত্ববোধ তৈরি না হয়। মনস্ততাত্ত্বিকেরা শুধু কথা বলে অনেক সমস্যার সমাধান করে দেন। অনেক বাবা-মা শুধু মেয়ের পড়াশুনো কেরিয়ারের  দিকটাই ভাবে আর কিছু নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। আবার কিছু বাবা-মা শুধু মেয়ের বিয়ের কথাই ভাবেন। বড় হবে বিয়ে দিয়ে দেব। তাঁদের মনোজগতের খোঁজ তারা রাখেন না। এখানেই গলদ হয়ে যায়। এই সব কারণে দিনে দিনে একটানা সবার সঙ্গে ইচ্ছের বিরুদ্ধে মেনে এবং মানিয়ে চলতে চলতে মনে করে আমার কাউকে আর প্রয়োজন নেই। মানসিক অবসাদ, ক্রাইসিসে সবসময় সাহায্যের প্রয়োজন, এটা মনে রাখতে হবে।

আরও পড়ুন-গণতান্ত্রিকভাবে বাংলাকে বিরোধীশূন্য করার চ্যালেঞ্জ

উৎপল দাঁ (প্রিন্সিপাল)
(ডায়মন্ডহারবার গভর্নমেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল)
 এর পিছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। আমরা কিছুদিন আগে জুনিয়র  ডাক্তার, ফ্যাকাল্টি, নার্সিং, ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীদের  নিয়ে একটা প্রশিক্ষণ শিবির করেছি। এর থেকে যেটা দেখা গেল তা হল  মেডিকেল কোর্স খুব সময়সাপেক্ষ একটা কোর্স। চার-পাঁচবছর শুরুতে তারপর একবছর ইন্টার্নশিপ,তারপর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করতে হবে,  পাশাপাশি রয়েছে সুপার স্পেশ্যালিটি কোর্স। অর্থাৎ যদি কোনও গ্যাপ না থাকে তাহলেও মোটামুটি এগারো বছর সময় লাগে ডাক্তারি পড়া শেষ করে প্র্যাকটিস শুরু করতে। এই এতটা সময় দিতে গিয়ে মেডিকেল পড়ুয়ারা অনেক সময় মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়।
দ্বিতীয়ত, মেডিকেলে সুযোগ পাওয়া খুব কঠিন। যাঁরা সুযোগ পেল তাঁদের পরবর্তী ধাপ আরও কঠিন কারণ এবার তাঁকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েটে সুযোগ পেতে হবে। এখানে একটা প্রতিযোগিতা সবসময় থাকে।

আরও পড়ুন-পুজোয় হাজির বৌদি canteen

মেডিকেলে যাঁরা ঢুকছে ধরেই নেওয়া হয় তাঁরা সবাই ভাল ছেলেমেয়ে। কারণ তাঁরা কেউ ফার্স্ট বয় কেউ সেকেন্ড বয় খুব ভাল নম্বর পেয়ে এসছে বলেই মেডিকেলে এসেছে। তাঁরাই যখন মেডিকেল পড়তে ঢুকল কোনও সেমিস্টারে ফেল করে গেল। মেডিকেলে ফেল করে যাওয়াটা কোনও আলাদা বিষয় নয়। আগে এই পরিসংখ্যান বেশি ছিল এখন অনেক কম। কিন্তু যে ফেল করছে এর আগে সে কখনও করেনি। যখন এখানে এসে এটা হল তখন তাঁর মধ্যে একটা ভয়, লজ্জা, ডিপ্রেশন আসতে শুরু করল।

আরও পড়ুন-জুয়ানের সঙ্গে কথা বলবেন কর্তারা

তৃতীয়ত, মেডিকেলে মাল্টিপল সাবজেক্ট রয়েছে। এমবিবিএস-এ মোট তেরোটা বিষয় পড়তে হয়। ল্যাঙ্গুয়েজ বা ভাষার সমস্যা এর সঙ্গে আরও একটা বড় সমস্যা। এখানে রাজ্যের যেমন কোটা আছে সেন্ট্রালেরও কোটা আছে। বাইরে থেকে যাঁরা এ রাজ্যে পড়তে আসে তাঁরা অধিকাংশ বাংলা জানেন না। এখানে যাঁরা বাংলা মিডিয়ামে পড়েছেন তাঁরা ইংরেজি জানেন না ভাল। মেডিকেল পুরোটাই ইংরেজিতে। ল্যাঙ্গুয়েজ প্রব্লেমের কারণে অনেক ছাত্র-ছাত্রী পড়া ধরতে পারেন না। ইংলিশ মিডিয়াম থেকে আসেন যাঁরা তাঁদের   পক্ষে অনেকটা সহজ হয়ে যায়। ফলে বাংলা মিডিয়াম এবং অন্য রাজ্য থেকে আসা ছাত্র বা ছাত্রী হয়তো ফেল করে গেল এবং ইংলিশ মিডিয়াম থেকে আসা মেডিকেল স্টুডেন্ট সেমিস্টার পাশ করে গেল। এই যে অকৃতকার্য হল কোনও  ছাত্র তার থেকে তৈরি হয় হীনমন্যতা, স্ট্রেস এবং ডিপ্রেশন।

আরও পড়ুন-গঙ্গাভাঙন রুখতে তৎপর প্রশাসন

এর পাশাপাশি সবচেয়ে বড় কারণ বাবা-মা বা অভিভাবকদের অতিরিক্ত উচ্চপ্রত্যাশা। সন্তান পড়াশুনোয় ভাল মানেই ডাক্তার হতে হবে বা ইঞ্জিনিয়ার। আর ডাক্তারি পড়লে চাকরির ভরসায় থাকতে হবে না নিজেই কিছু করে নিতে পারবে। স্টুডেন্টরা অনেক সময় বাবা-মায়ের চাপে পড়ে কেরিয়ার বাছাই করছেন। তারপর গিয়ে দেখছে বিশাল সিলেবাস, প্রচুর সময়সাপেক্ষ একটা কোর্স এবং ইংরেজিতে পুরোটা পড়তে হবে এটাই হয়ে যাচ্ছে সমস্যার আসল কারণ। দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন অনেক ছাত্রছাত্রী। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বাবা-মাকে বললে তাঁরা তো বুঝতেই চাইছেন না উল্টে বকাবকি করছেন এর ফলে ভীষণ মানসিক চাপ, ডিপ্রেশন অনিশ্চয়তা থেকে সুইসাইডের মতো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছেন।

আরও পড়ুন-রোডম্যাপ, যুব ফুটবলে জোর কল্যাণের

ডায়মন্ড হারবার মেডিকেল কলেজে একটা নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের ডিপ্রেশন দূর করত। একজন টিচারের আন্ডারে দশজন করে স্টুডেন্টকে দেওয়া হয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে গেটকিপার ট্রেনিং। সপ্তাহে একবার বা দু-সপ্তাহে একবার সেই শিক্ষক বা শিক্ষিকা ওই ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বসে কথা বলবেন। স্টুডেন্টরাও কথা বলবেন। এবার কথা বলতে বলতে যখনই কোনও  মানসিক সমস্যা ধরা পড়ে বা স্টুডেন্ট নিজেই জানান তাঁর কোনও অ্যাংজাইটি বা ডিপ্রেশনের কথা তখনই তাঁকে সাইকায়াট্রি টিচারের কাছে পাঠানো হয়। তিনি তখন সেই স্টুডেন্টকে কাউন্সিলিং করেন কারণ এই সময় কথা বলাটা খুব দরকার। কারও মনে কোনও চাপ থাকলে সে যদি কাউকে সেটা বলতে না পারে তখনই একটা সময় গিয়ে তা মারাত্মক হয়ে যায়। এই পদ্ধতিতে মেডিকেল স্টুডেন্টদের অবসাদ অনেকটাই কাটানো সম্ভব হয়েছে।

আরও পড়ুন-ব্রিটেনের ৭০ বছরের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ প্রয়াত, শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর

সুব্রত মণ্ডল (সুপার)

(বারাসত জেলা হাসপাতাল)
 আমি হাসপাতালের দায়িত্বে থেকে লক্ষ্য করেছি এখনকার চিকিৎসকেরা কেউ রোগী বা তাঁর পরিবার অর্থাৎ পেশেন্ট পার্টির সঙ্গে কোনও কথা বলেন না। আমরা অনেক বলেছি চিকিৎসা মানে শুধু ওষুধ দেওয়া বা মেডিকেল  ট্রিটমেন্ট নয় চিকিৎসার একটা বড় জায়গা হল মন। রোগী যদি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে মানসিক বল পায়, আত্মবিশ্বাস ফিরে পায় তখন সেই চিকিৎসা অর্ধেক সফল হয়ে যায়। আজকের যাঁরা নতুন নতুন প্রতিভার চিকিৎসক এই পেশায় আসছেন প্রত্যেকে খুব ভাল চিকিৎসা করছেন কিন্তু রোগীর সঙ্গে বা তাঁদের বাড়ির লোকের সঙ্গে কোনও ইন্টারাকশন তাঁরা করেন না। এই কারণেই কিন্তু এখন মেডিকেল স্টুডেন্টদের সিলেবাসের সঙ্গে তাঁরা পেশেন্ট  এবং তার পরিবারের সঙ্গে কীভাবে কথা বলবেন সেই বিষয় একটা আলাদা প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়। এটাকে একটা বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে। আগে কিন্তু এমনটা দেখা যেত না। ডাক্তারের কথাতেই রোগী সুস্থ অনুভব করতেন।

আরও পড়ুন-ফেসবুক লাইভে গুলি, হত ৩

এর কারণ খুঁজতে হলে বুঝতে হবে গলদটা হয়ে রয়েছে গোড়াতেই। এখন সব নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। বাবা-মার একটা সন্তান দুজনেই চাকরি করেন। বাচ্চা একা বড় হয়ে উঠছে কেয়ার গিভারের কাছে। তাঁদের সঙ্গ দেবার কেউ নেই, কথা বলার কেউ নেই। পড়াশুনোই একমাত্র কাজ বা তার বাইরে মোবাইল ফোন। একা বেড়ে ওঠা এই সব শিশুরা এমনিতেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। ছোট থেকেই কথা বলতে বা নিজের মনের কথা শেয়ার করতে পারে না। বাবা-মা সন্তানের কেরিয়ার গড়তে টাকা ঢেলেছেন। আঁকার ক্লাস, গানের ক্লাস সব দিয়েছেন কিন্তু খোলা মাঠ দেননি, বন্ধুবান্ধব দেননি, সঙ্গ দেননি। দিনে দিনে মেকানিক্যাল হয়ে উঠেছে তারা। আগেকার মানুষের জীবনদর্শন আজকের জীবনদর্শনের আকাশপাতাল ফারাক হয়ে গেছে। কাজেই তারই প্রতিফলন ঘটেছে সমাজে। এরাই যখন ডাক্তার হচ্ছে বা অন্য বড় কোনও পেশায় যাচ্ছে সেই প্রতিযোগিতার চাপটা কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারছে না। বাবা-মায়ের অতিরিক্ত প্রত্যাশা মেটাতে গিয়ে গভীর অবসাদের শিকার হয়ে পড়ছে। হাসপাতালে প্রত্যেকদিন যে শয়ে-শয়ে রোগী আসে শুধু সুন্দর ব্যবহার, সহানুভূতি আর কথা দিয়েই তাঁদের অর্ধেক মনের জোর ফিরিয়ে দিতে পারেন ডাক্তাররা কিন্তু এখনকার বেশিরভাগ চিকিৎসক সেই কথাটাই আর খরচ করেন না। এখনকার ডাক্তারি ছাত্রদের অধিকাংশ যারা পাশ করে বেরোচ্ছে একটা মেশিনের মতো হয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন-বিজেপির প্ররোচনায় মিলছে না বকেয়া টাকা

এর পাশাপাশি এত লম্বা একটা কোর্স, প্রচুর সিলেবাস, প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়ার ভয়, ক্রমাগত প্রতিযোগিতায়  ভাল ফল করার চাপ তাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ তৈরি করছে এবং এটা তারা শেয়ার করতে পারছে না ফলত কিছু সুইসাইডের মতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছে।

Latest article