খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে, মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা হল অটিজম। নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডার। শিশুর ৩ বছর অর্থাৎ ৩৬ মাস আগেই এর সিম্পটম ধরা পড়ে যায়। এরা নিজের মনের অনুভূতি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে অক্ষম হয়। অটিজমকে চিকিৎসা পরিভাষায় বলা হয় অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার বা এএসডি। এরা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু। অনেক গবেষকই মনে করছেন যে অটিজমের সঙ্গে মস্তিষ্কের জিনগত বিষয়টির গভীর যোগ রয়েছে। যমজ শিশুদের মধ্যে একই জিন থাকে তাই যমজদের একজনের মধ্যে অটিজম থাকলে অন্যজনের মধ্যেও তা দেখা দিতে পারে।
আরও পড়ুন-বন্ধ কলকারখানার জমিতে নতুন শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ শুরু রাজ্যে
কেন হয় অটিজম
এই বিষয়টা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। বিভিন্ন গবেষণা বলছে—
শিশুর জন্মের পর আমব্লিক্যাল কর্ড কাটা ও বাঁধার সময় যদি অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয় আর সেই ঘাটতির ফলে টিস্যু নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সেই শিশুর জন্মের পর অটিজমের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
জন্মের পর যদি নবজাতকের ওজন আড়াই কেজি বা তার চেয়ে কম হয়, তাহলে সেই শিশু অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে। বেশি বয়সে মাতৃত্ব আগত শিশুর অটিজমের কারণ হতে পারে।
কিছু শিশুবিশেষজ্ঞের মতে, গর্ভাবস্থায় মায়ের রুবেলা সংক্রমণ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাজমা থাকলে এবং অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ অতিরিক্ত খেলে গর্ভের শিশুর অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
থাইরয়েড সমস্যা থাকলে অর্থাৎ গর্ভাবস্থার ৮-১২ সপ্তাহে মায়ের মধ্যে থাইরক্সিনের ঘাটতি দেখা দিলে ভ্রূণের মস্তিষ্কে অটিজমের উপসর্গ আসার সম্ভাবনা থাকে। যদিও এই সব কারণ এখনও পুরোপুরি প্রমাণিত সত্য নয়।
চিনতে হবে উপসর্গ
অটিস্টিক শিশুকে প্রথমদিকে দেখে ধরা যায় না। একটু বড় অর্থাৎ ২ বছর থেকে উপসর্গ ধরা পড়তে থাকে কারণ শিশুটির সামাজিক বিকাশ ঠিকমতো হয় না। অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলো বা মেলামেশা করতে পারে না।
কিছু কিছু বাচ্চার ১ থেকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত খেলাধুলা, কথাবার্তা সব ঠিক থাকে কিন্তু হঠাৎ করে কথা ও সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। এটাকে বলা হয় রিগ্রেসিভ অটিজম।
এরা একা থাকতেই ভালবাসে। এবং অনেক ক্ষেত্রে কথা বলাও দেরিতে শুরু হয়।
স্বাভাবিক শিশুর মতো হাসি-কান্না কথা দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না।
কোন একটি নির্দিষ্ট জিনিসের প্রতি তাদের আকর্ষণ বেশি থাকে এবং একই কাজ এরা বারবার করতে থাকে। যেমন, দরজা-জানলা বারবার খোলা বা বন্ধ করা, জলের কল খোলা-বন্ধ ইত্যাদি।
এই শিশুদের তাকানোর ধরনটা একটু অন্যরকম হয়। সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না।
এই ধরনের শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি অন্য শিশুদের মতো হয় না। কখনও এরা খুব স্পর্শকাতর হয়।
অটিজমে আক্রান্ত অনেক শিশু দেখা, শোনা, গন্ধ, স্বাদ অথবা স্পর্শের প্রতি অতি সংবেদনশীল অথবা প্রতিক্রিয়াহীন থাকতে পারে।
অটিস্টিক শিশুদের প্রতি চারজনে একজনের খিঁচুনি সমস্যা হতে পারে।
আরও পড়ুন-হরিয়ানায় নিট কেলেঙ্কারির নেপথ্যে বিজেপির যুবনেতা
চিন্তা নয়, জরুরি চিকিৎসা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাচ্চার অটিজম ধরা পড়লে ভেঙে পড়ার কোনও কারণ নেই। আসলে বিষয়টা নিয়ে অনেকেরই স্বচ্ছ ধারণা নেই বলেই অনেক বাবা-মা সন্তান অটিস্টিক জানলে মনের দুঃখে ভেঙে পড়েন। কিন্তু অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার শুরুতে ধরা পড়লে এবং দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে শিশুর স্বাভাবিক জীবনযাপন করা মোটেও অসম্ভব নয়। বরং দেখা গিয়েছে অটিস্টিক বাচ্চার বুদ্ধি অনেক বেশি হয়। এদের কিছু বিশেষ দক্ষতাও থাকে। চার্লস ডারউইন, শিশু সাহিত্যিক হ্যান্স অ্যান্ডারসন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, মোৎসার্ট, আর হাল আমলের বিল গেটস, স্টিভ জোবস-সহ অনেক সফল মানুষই অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার নিয়েও খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছেন।
অটিজমের চিকিৎসা কী?
অটিজমের চিকিৎসা হচ্ছে একটি সমন্বিত চিকিৎসা। কোনও একজনের কাজ নয়। পেডিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞ, নিউরো রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট এবং ক্ষেত্র বিশেষে ফিজিওথেরাপিস্টের সহযোগিতায় পুরো ট্রিটমেন্টটা ডিজাইন করা হয়। এবার ওষুধপত্র, বিভিন্ন থেরাপি এবং স্কিল শেখার মাধ্যমে অটিজমে আক্রান্ত শিশুকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনা হয়। এডুকেশনাল প্রোগ্রাম এবং বিহেভেরিয়াল থেরাপি এক্ষেত্রে খুব ভাল কাজ করে। স্পেশ্যাল স্কুলেও এই সব বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পায়।
আরও পড়ুন-বিহারে কলেজের খাবারে মিলল সাপ
অভিভাবকদের কী কী করণীয়?
যে শিশুরা বিশেষ সাহায্য পেলে তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে জীবনে ফিরতে পারে, লোকলজ্জায় বাবা-মা তাদের লুকিয়ে রাখেন ঘরে। অনেকেই সমস্যা স্বীকারও করতে চান না। স্কুলে আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের সঙ্গে স্বাভাবিক পরিসরে মিশে তারা যে ক্রমশ জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারত, সেই রাস্তাও কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। কাজেই এই ক্ষেত্র সবচেয়ে জরুরি বাবা-মায়ের চেষ্টা এবং সচেতনতা। সেই সঙ্গে বিশেষ যত্নের। তাই প্রতিটি অভিভাবকের উচিত নিজেদের সন্তানের সঙ্গে আরও বেশি করে সময় কাটানো। সেই সঙ্গে মনোযোগ দিতে হবে সন্তানের মধ্যে প্রকাশ পাওয়া অটিজমের লক্ষণগুলির উপরেও। যদি দেখা যায়, সন্তান স্বাভাবিক আচরণ করছে না, সেক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। শিশুটির সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে হবে। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় বড় শব্দ অথবা বাক্যের পরিবর্তে ছোট-ছোট শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করে কথা বলতে হবে। অটিস্টিক শিশুর সঙ্গে অন্য কোনও শিশুর তুলনা করা চলবে না। তাকে নতুন-নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ করাতে হবে। শিশুর ওপর রাগারাগি, অযথা চাপ দেওয়া, বকুনি দেওয়া একেবারেই চলবে না। খুব ধৈর্যের প্রয়োজন যা অভিভাবককে রাখতে হবে।