অবাক হওয়ার কিছু নেই ওরা এরকমই নারীবিদ্বেষী

আফগানিস্তানে তো করেই থাকে৷ তা-বলে ভারতের মাটিতে বসেও! তালিবান নেতার ‘ফতোয়া’ ঘিরে রীতিমতো উত্তপ্ত জাতীয় সাংবাদিক মহল৷ অভিযোগ, গত শুক্রবার নয়াদিল্লিতে আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি যে সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন, সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি কোনও মহিলা সাংবাদিককে৷ এনিয়ে বিরক্তি ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, করেছেন অনেকেই। কিন্তু সত্যিই কি এতে বিস্ময়ের কিছু আছে! বিজেপির উৎস যে আরএসএস তার মত ও আদর্শ বিশ্লেষণ করলে তো তেমনটা মনে হয় না। মনে করিয়ে দিচ্ছেন অধ্যাপক ড. অর্ণব সাহা

Must read

সংঘ (RSS) পরিবার কখনওই মেয়েদের অধিকারের পক্ষে নয়। ১৯২৫-এ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শাখায় পুরুষ ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার বা অংশগ্রহণের অধিকার ছিল না| এখনও নেই! ১১ মার্চ, ১৯৯৪-এ বালাসাহেব দেওরসের হাত থেকে দায়িত্বভার গ্রহণ করা রাজেন্দ্র সিং ছাড়া কেশব বালিরাম হেডগেওয়ার থেকে শুরু করে আজ অব্দি আরএসএস-এর সমস্ত সরসংঘচালকই হয় চিতপাবন অথবা অন্য মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ এবং এরা প্রত্যেকেই ঘোরতর শভিনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী!

১৯৩৬-এ লক্ষ্মীবাই কেলকর ডাক্তারসাহেব হেডগেওয়ারের কাছে দাবি তোলেন, মেয়েদেরও সংঘের অন্তর্ভুক্ত করা হোক! হেডগেওয়ার প্রথমে রাজি হননি! তাঁর মতে, মেয়েদের ‘জীবন, মনস্তত্ত্ব ও কার্যকলাপ’ ছেলেদের চেয়ে ‘সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র’! তাই ওইবছরেই গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতি’! লক্ষ করুন, ছেলেরা ‘স্বয়ংসেবক’! কিন্তু মেয়েরা শুধুই ‘সেবিকা! ‘স্বয়ম’ শব্দটির মধ্যে যে আত্মনির্ভর স্বাতন্ত্র বিদ্যমান, তা ‘সেবিকা’ শব্দে অনুপস্থিত! অর্থাৎ, গোড়াতেই মেয়েদের শুধু এক্সক্লুডেড করা হল, তাই নয়, তারা যে পুরুষের তুলনায় খাটো, এটাও বুঝিয়ে দেওয়া হল! এক্ষেত্রে বালাসাহেব দেওরসের যুক্তি ছিল: “সকালে মেয়েদের ঘরের কাজেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, শাখায় আসা তাদের পক্ষে কঠিন!” রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতির প্রধানতম কর্তব্য হিসেবে গণ্য হয়েছিল তারা মেয়েদের পশ্চিমি প্রভাব থেকে দূরে রাখবে, সন্তানদের মধ্যে সংঘী সংস্কারের সঞ্চার করবে। সংঘের নজরদারিতে তাঁদের প্রশিক্ষণ চলত।

এবার আরএসএস-এর (RSS) তাত্ত্বিক গুরুদের কথায় আসি! মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার তাঁর বিখ্যাত ‘বানচ অফ থটস’-এর ‘Call to the Motherland’ অধ্যায়ে মেয়েদের কাজ স্পষ্ট করে দিয়ে গেছেন! (সাহিত্য সিন্ধু প্রকাশন, ২০২২, পৃ. ৩৭১-৩৭৭)। তাতে তিনি পরিষ্কার বলেছেন, মেয়েদের প্রধান কাজ সন্তানদের দেশের জন্য বলিপ্রদত্ত যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলা এবং মুখ্যত সন্তানপালন করা। বোঝা যায়, নারী ও পুরুষের স্বাভাবিক মেলামেশার আধুনিক পরিসর না রাখাটাই ছিল তাঁর সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী প্রকল্প! তিনি নারীকে গোমাতার চেয়েও হীন বলে প্রতিপন্ন করেছেন! কারণ, গোমাতার ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ ও সম্ভাবনা নেই, কিন্তু মেয়েদের তা পুরোমাত্রায় আছে| সর্বোপরি, নারীর রয়েছে এক বিপজ্জনক যৌন আকর্ষণ, যা পুরুষকে প্রলুব্ধ করতে সক্ষম! এবং এর ফলে মেয়েরা ‘অপবিত্র’ ও ‘হীন’ হয়ে যায় অর্থাৎ শেষত মেয়েরা পুরুষের দ্বারা রক্ষাপ্রাপ্ত এক হীন প্রজাতি! অবিকল একই মনোভাব পোষণ করে নাৎসি জার্মানিতে ফ্যুয়েরার হিটলারও বলেছিলেন—“মেয়েদের একমাত্র সম্মান তাঁদের মাতৃত্বে। রান্নাঘর, শিশুপালন ও চার্চ—এই তিনটেকে ঘিরেই গড়ে উঠবে তাদের জীবন”। ১৯৭৮-এর পরে প্রকাশিত ‘রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতি’র একটি সাংগঠনিক দলিলে স্পষ্টই বলা হয়েছে, যেহেতু ১৯৩০-এর দশক থেকেই পাশ্চাত্য নারীবাদী আন্দোলন ও নারীর ‘ক্ষমতায়নের’ ধারণা ভারতেও আসছিল, সমিতির উদ্দেশ্য ছিল এই ‘ক্ষতিকর’ প্রভাব থেকে ভারতীয় মেয়েদের দূরে রাখা—‘due to western impact women were struggling for equal rights and economic freedom…There was every risk of women being non-committed to love, sacrifice, service…This unnatural change in the attitude of women might have led to disintegration of family, the primary and most important unit of imparting good manners’. (Samiti, Preface to Rashtra Sevika Samiti, Nagpur: Sevika Prakashan. Pp. 13) সংঘের আরেক প্রধান তাত্ত্বিক সাভারকার ‘মনুস্মৃতি’-র ভূয়সী প্রশংসা বারবার করেছেন, যে ‘মনুস্মৃতি’ নারী এবং শূদ্রদের জন্য ভয়াবহ বৈষম্যমূলক বিধানের জন্য কুখ্যাত। সাভারকার খোলাখুলি বলেছিলেন—‘This book for centuries has codified the spiritual and divine march of our nation. Even today the rules which are followed by crores of Hindus in their lives and practice are based on Manusmriti. Today Manusmriti is Hindu Law. That is fundamental’. (Women in Manusmriti, Savarkar Samagra, Prabhat Publication, Delhi, Vol. 4, pp.415)

আরও পড়ুন-রাজ্য থেকে বর্ষা বিদায় পর্ব শুরু

পিতৃতন্ত্র এবং পুরুষতন্ত্র এমনই এক মতাদর্শ যা স্ত্রী-পুরুষ নিরপেক্ষভাবে কাজ করে চলে। আরএসএস-এর (RSS) দুটি প্রধান মহিলা সংগঠন ‘দুর্গা বাহিনী’ এবং ‘বিজেপি মহিলা মোর্চা’র কার্যকলাপ থেকেও তা বারবার প্রমাণিত হয়। ১৯৮৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাজস্থানের দেওরালা গ্রামে আঠারো বছর বয়সী রূপ কানোয়ারকে স্বামীর চিতায় জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়। গোটা দেশ এই ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠলেও সংঘের নারী-সংগঠনগুলি সেসময় হিন্দু নারীর ‘সতীদাহ’কে মহিমান্বিত করতে উঠেপড়ে লাগে। সেসময় বিজেপির সহসভাপতি বিজয়রাজে সিন্ধিয়ার নেতৃত্বে বিজেপির মহিলা মোর্চা পার্লামেন্ট অভিযান অব্দি করেছিল ‘সতীদাহ’ কেবল হিন্দু নারীর কাছে গর্বেরই নয়, এটা তাদের অধিকার—এই দাবিসনদ পেশ করতে। অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে আছে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মহিলা শাখার নেত্রী কৃষ্ণা শর্মাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, স্বামীর হাতে মার-খাওয়া স্ত্রীকে আপনি কী উপদেশ দেবেন? তিনি বউপেটানোর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। বিজেপির মহিলা মোর্চার নেত্রী মৃদুলা সিনহার এপ্রিল, ১৯৯৪-এ দেওয়া সেই বিখ্যাত সাক্ষাৎকারটির কথাও আমরা ভুলিনি, যাতে তিনি পণপ্রথার সপক্ষে, স্বামীর হাতে স্ত্রীর মার-খাওয়ার ন্যায্যতা বিষয়ে নিজের মত রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নিতান্ত আর্থিক প্রতিবন্ধকতা ব্যতীত মেয়েদের সংসার ফেলে বাইরে চাকরি করা অনুচিত।

সম্ভবত এই জায়গা থেকেই গোলওয়ালকার এবং তৎকালীন হিন্দু মহাসভা ও পরবর্তী ভারতীয় জনসংঘের নেতারা সদ্য-স্বাধীন ভারতীয় পার্লামেন্টে মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আনা ‘হিন্দু কোড বিল’-এর সর্বাত্মক বিরোধিতা করেছিলেন। চরম প্রতিক্রিয়াশীল, সামন্তবাদী ভাবনা ও বর্ণাশ্রমের সমর্থক, মেয়েদের অবরোধের আড়ালে নিয়ে যেতে চাওয়া দণ্ডী সন্ন্যাসী কর্পাত্রি মহারাজের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দল ‘রামরাজ্য পরিষদ’ এই বিলের বিরুদ্ধে সংসদ ভবন ঘেরাওয়ের ডাক দেয়। মণিকুন্তলা সেনের আত্মজীবনীতেও আছে কীভাবে হিন্দু কোড বিলের সমর্থনে ডাকা তাঁদের সভা ভণ্ডুল করেছিল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের গুন্ডারা। বিগত একশো বছরে সংঘ পরিবারের বাইরের মুখোশটা পাল্টালেও তাদের অন্দরের নারীবিদ্বেষী ও নারীবিরোধী মুখ এতটুকু বদলায়নি। তাই এই মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো আশু প্রয়োজন।

Latest article