১৮৯৫ সালে ডিনামাইটের আবিষ্কারক সুইডিশ রসায়নবিদ আলফ্রেড নোবেল যে পাঁচটি ক্ষেত্রে পুরস্কার প্রদানের ব্যাপারে দলিলে উল্লেখ করে গিয়েছিলেন তারমধ্যে চিকিৎসাবিজ্ঞান একটি। নোবেল ব্যক্তিগতভাবেও পরীক্ষামূলক চিকিৎসাবিজ্ঞানে আগ্রহী ছিলেন। মেডেলের সম্মুখদিকে থাকে আলফ্রেড নোবেলের খোদিত ছবি যা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন বা সাহিত্যের জন্য প্রদত্ত মেডেলের মতোই; তবে অন্য পাশটা আলাদা। সেই পাশে মেধাবী এক চিকিৎসকের প্রতিকৃতি দেখা যায়, যে নিজের কোলে রাখা একটি উন্মুক্ত বই ধরে আছে এবং একই সাথে পাথরের বুক চিরে প্রবহমান জল দিয়ে একটি মেয়ের তৃষ্ণা মেটানোর চেষ্টা করছে। ১৯০১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ২২৯ জন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীকে ১১৫ বার চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ঔষধক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ১৯০১ সালে জার্মান শারীরবিজ্ঞানী এমিল ফন বেরিংকে ‘সিরাম চিকিৎসা’ বিষয়ে গবেষণা ও ডিপথেরিয়া রোগের বিরুদ্ধে কার্যকরী টিকা উদ্ভাবনের জন্য প্রথমবার চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। অতি সম্প্রতি এই নোবেল প্রাপকদের তালিকায় যুক্ত হয় আরও দুটি নাম— ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রুভকুন, তাঁরা মাইক্রোআরএনএ (miRNA) আবিষ্কার এবং পোস্ট-ট্রান্সক্রিপশনাল বা ট্রান্সক্রিপশন-পরবর্তী জিন নিয়ন্ত্রণের ভূমিকার জন্য এই পুরস্কার পান। এই বছরই গত ৭ অক্টোবর এই পুরস্কার ঘোষিত হয়।
আরও পড়ুন-উপাচার্য নিয়োগের রাশ মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই, সাধুবাদ জানালেন ব্রাত্য
কেন পেলেন এঁরা নোবেল?
আমাদের দৈহিক গঠন যে জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তা আমরা সকলেই কমবেশি জানি। আর তার সাথে এও জানি যে এই জিন হল আমাদের দেহের ব্লু প্রিন্ট। আরও একটু বিস্তারিত বললে বলতে হয় আমাদের দেহের কোষে নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকা ক্রোমোজোমের মধ্যে যে নির্দিষ্ট জিন সেটটি রয়েছে তারা একটি নির্দিষ্ট নির্দেশাবলি বহন করে আর হুবহু তা পালন করে। তবে জিন সেট যদি নির্দিষ্ট থাকে তবে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষেত্রে তা ভিন্ন হয় কীভাবে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে এই জিনগুলির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায়। যা প্রতিটি কোষকে শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক নির্দেশাবলিই নির্বাচন করে দেয় এবং এটি নিশ্চিত করে যে প্রতিটি কোষের মধ্যে শুধুমাত্র সঠিক জিনের সেটটিই সক্রিয় রয়েছে। বোঝার সুবিধার জন বলে রাখি এই জিন আসলে DNA-তে থাকা এমন সিকোয়েন্স, যা নির্দিষ্ট প্রোটিন বা পলিপেপটাইড উৎপাদনে সক্ষম, আবার এও পলিপেপটাইডই বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। তবে DNA থেকে প্রোটিন বা পলিপেপটাইড উৎপাদনের মাঝে উৎপন্ন হয় mRNA, এটি DNA-তে থাকা সংকেত অনুযায়ী পলিপেপটাইড তৈরি করে। আসলে ভিক্টর অ্যামব্রোস এবং গ্যারি রুভকুন কীভাবে বিভিন্ন কোষের বিকাশ ঘটে সে সম্পর্কে এতটাই আগ্রহী ছিলেন যে তারা মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কার করে বসে। একটি নতুন শ্রেণির ক্ষুদ্র আরএনএ অণু যা জিন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের এই আবিষ্কার এও আনিয়েছে যে মানব জিনোম এক হাজারেরও বেশি মাইক্রোআরএনএর জন্য কোড করে।
আরও পড়ুন-হাসিনা পদত্যাগ করেছেন কিনা জানেন না বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি! বর্তমান সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন
আবিষ্কারের নেপথ্যকাহিনি
১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে, ভিক্টর অ্যামব্রোস এবং গ্যারি রুভকুন রবার্ট হরভিটজের গবেষণাগারে পোস্টডক্টরাল ফেলো ছিলেন, যিনি সিডনি ব্রেনার এবং জন সালস্টনের পাশাপাশি ২০০২ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। হরভিটজের গবেষণাগারে, তাঁরা তুলনামূলকভাবে নিরবচ্ছিন্ন ১ মিমি লম্বা রাউন্ডওয়ার্ম, সি. এলিগানস অধ্যয়ন করেন। ছোট আকারের হওয়া সত্ত্বেও, সি এলিগান এমন কিছু কোষ সমন্বিত, যেমন স্নায়ু এবং পেশিকোষ যা জটিল প্রাণীদের মধ্যেও পাওয়া যায়, বহুকোষী জীবের মধ্যে কলাগুলি কীভাবে বৃদ্ধি ও বিকাশলাভ করে সেটি জানার জন্য তাঁরা এই রাউন্ডওয়ার্মটিকেই মডেল হিসেবে ব্যবহার করেন। অ্যামব্রোস এবং রুভকুন এমন জিনগুলিতেই আগ্রহী ছিলেন যা বিভিন্ন জেনেটিক প্রোগ্রামের সক্রিয়করণের সময় নিয়ন্ত্রণ করে, বিভিন্ন কোষের ধরন অনুযায়ী সঠিক সময়ে তাদের বিকাশ নিশ্চিত করে। তারা কৃমির দুটি মিউট্যান্ট স্ট্রেন, লিন-৪ এবং লিন-১৪ অধ্যয়ন করেছিলেন এবং তাদের কার্যকারিতা বুঝতে চেয়েছিলেন। অ্যামব্রোস পূর্বে দেখিয়েছিলেন যে লিন-৪ জিনটি লিন-১৪ জিনের নেতিবাচক নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। তবে কীভাবে এই লিন ১৪-এর কার্যকলাপ অবরুদ্ধ হয়েছিল তা কিন্তু অজানাই ছিল। অ্যামব্রোস এবং রুভকুন এই মিউট্যান্ট এবং তাদের মধ্যের সম্ভাব্য সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে পড়েছিলেন।
এই গবেষণার পর, ভিক্টর অ্যামব্রোস হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নতুন প্রতিষ্ঠিত গবেষণাগারে লিন ৪ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা করে দেখান যে এই জিন একটি অস্বাভাবিকভাবে সংক্ষিপ্ত আরএনএ অণু তৈরি করেছিল যার প্রোটিন উৎপাদনের জন্য কোডের অভাব ছিল। এই ফলাফলগুলি থেকে এটি স্পষ্টতই বলা যেতে পারে যে লিন-৪ থেকে এই ছোট আরএনএ লিন-১৪-এর কার্যকারিতা বাধা দেওয়ার জন্য দায়ী।
একই সঙ্গে, গ্যারি রুভকুন ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল এবং হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলে তাঁর নতুন প্রতিষ্ঠিত পরীক্ষাগারে লিন-১৪-এর নিয়ন্ত্রণের তদন্ত করেছিলেন। এই তদন্ত থেকে উঠে আসা তথ্যের সরলীকরণ করলে যা দাঁড়ায় তা হল লিন-৪ লিন-১৪ থেকে এমআরএনএ উত্পাদনকে বাধা দেয় না বরং প্রোটিন উত্পাদন বন্ধের মাধ্যমে জিন প্রকাশের প্রক্রিয়াটি এরা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়। কীভাবে? এই উত্তর দিতে গিয়ে দুই বিজ্ঞানী বলেন, লিন-৪ এর miRNA-এর ক্রমটি লিন-১৪ mRNA-এর সম্পূরক অনুক্রমের সঙ্গে ভালভাবে মিলছে। ফলে লিন-৪ এর miRNA লিন-১৪ এর mRNA-তে সম্পূরক অণুক্রমের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে লিন-১৪-এর প্রোটিনের উৎপাদনকে বাধা দিচ্ছে। এভাবেই পূর্বে অজানা এক ধরনের RNA, microRNA-এর মধ্যস্থতায় জিন নিয়ন্ত্রণের একটি নতুন নীতি আবিষ্কৃত হয়। তবে এই কাহিনি এখানেই শেষ নয়, আসলে দুই বিজ্ঞানীর এই গবেষণা সি এলিগানের একটি বিশেষত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল, সম্ভবত মানুষ এবং অন্যান্য জটিল প্রাণীর জন্যে এই আবিষ্কার ছিল অপ্রাসঙ্গিক। তবে এই ধারণাটি ২০০০ সালে পরিবর্তিত হয়েছিল যখন রুভকুনের গবেষণা আরেকটি মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কার করেছিল, যা লেট-৭ জিন দ্বারা এনকোড করা হয়েছিল। লিন-৪ এর বিপরীতে, লেট-৭ জিনটি অত্যন্ত সংরক্ষিত ছিল এবং সমগ্র প্রাণিজগতে উপস্থিত ছিল। আর এই আবিষ্কারের ফলেই আমরা আজ জানি যে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন মাইক্রোআরএনএর জন্য এক হাজারেরও বেশি জিন রয়েছে এবং মাইক্রোআরএনএ দ্বারা জিন নিয়ন্ত্রণ বহুকোষী জীবের মধ্যে সর্বজনীন।
পরিশেষে এটি বলা এতটুকুও বাহুল্য হবে না যে, আমরা আশা রাখি আর বিশ্বাস করি যে তাঁদের এই আবিষ্কার ক্যান্সার, কার্ডিওভাসকুলার রোগ এবং স্নায়বিক রোগ-সহ আরও অনেক রোগের চিকিৎসায় নতুন ধরনের থেরাপির সম্ভাবনা তৈরি করবে।