‘তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল’

২১ অক্টোবর, ১৯৪৩-এ আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন নেতাজি। এটি দেশের প্রথম স্বদেশি সরকার। অথচ সেকথা প্রায় অনুল্লেখিত আমাদের ইতিহাস বইগুলোয়। কেন? লিখছেন দেবু পণ্ডিত

Must read

খুব কম লোকই তাঁকে অবিভক্ত ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চেনেন। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য হল এটাই যে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু অবিভক্ত ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
স্বাধীনতার জন্য নেতাজির অবদান সম্পর্কে জানা উচিত প্রতিটি ভারতীয়র।
অধিকাংশ ভারতীয় নেতাজিকে একজন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী, আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বোচ্চ কমান্ডার এবং একজন বিপ্লবী হিসেবে চেনেন। এখন তাঁরা ভাবতেই পারেন না যে নেতাজি সম্পর্কে আরও কী কী জানা বাকি রয়েছে। ভারতের স্বাধীনতার জন্য অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু খুব কম মানুষই তাঁকে অবিভক্ত ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চেনেন।

আরও পড়ুন-দীপাবলিতে উত্তরে দুর্গতদের পাশে মিজানুররা

১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন নেতাজি। এটি দেশের প্রথম স্বদেশি সরকার। এই সরকারের নিজস্ব পোস্টাল স্ট্যাম্প, মুদ্রা এবং একটি গোপন গোয়েন্দা সংস্থা ছিল। সীমিত সম্পদ নিয়ে এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা সাধারণ কীর্তি নয়, বড় কৃতিত্ব ছিল।
একটা সময় পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজির অবদানকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হত। দেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নেতাজির অবদানকে ছোট করে দেখানো হত। তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত বহু তথ্য প্রকাশ্যে আনা হয়নি এত বছরে। নরেন্দ্র মোদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেও নেতাজিকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার কাজ শুরু হয়নি।
আজাদ হিন্দ সরকারকে দেশের প্রথম স্বদেশি সরকার বলতে কারও দ্বিধা থাকার কথা নয়।
আগের কেন্দ্রীয় সরকারের ছিল। নরেন্দ্র মোদি সরকারেরও পূর্ণ মাত্রায় আছে। এঁদের কাজকর্ম তার প্রমাণ।
কিন্তু সত্য কথা হল—
১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর, নেতাজি নামে পরিচিত সুভাষচন্দ্র বসু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ (মুক্ত ভারত) সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপ্রধান এবং যুদ্ধমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন। ক্যাপ্টেন ডঃ লক্ষ্মী স্বামীনাথন মহিলা সংগঠনের নেতৃত্ব দেন এবং ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে এশিয়ার প্রথম নারী বাহিনী, কেবল মহিলাদের নিয়ে তৈরি যুদ্ধ ব্রিগেড, রানী ঝাঁসি রেজিমেন্টের নেতৃত্ব দেন।
আজাদ হিন্দ, অথবা আরজি হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ, জাপান, নাৎসি জার্মানি, ইতালীয় সামাজিক প্রজাতন্ত্র এবং তাদের মিত্রদের যেমন ইন্দোনেশিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মায়ানমার (তত্কালীন বার্মা) কয়েকটি দেশ দ্বারা সমর্থিত ছিল।
ব্রিটিশদের দখলে থাকা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলগুলিতে সরকার ভারতীয় বেসামরিক এবং সামরিক কর্মীদের উপর কর্তৃত্ব ঘোষণা করে। তারা মুদ্রা (আজাদ হিন্দ মুদ্রা), আদালত এবং একটি দেওয়ানি কোড-সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে।
সুভাষ চন্দ্র বসু আজাদ হিন্দের পতাকাতলে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য একটি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার বিষয়টিকে লক্ষ্য হিসেবে রেখেছিলেন কারণ তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের এটাই একমাত্র উপায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও ১৯৪৫ সালে অক্ষশক্তির পরাজয়ের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল। এজন্যই আজাদ হিন্দ ফৌজের সরকারের পতন হয়। ‘শক্তিশালী অবিভক্ত ভারত’ গঠনের জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রদানে সেই ‘আজাদ হিন্দ’ সরকারের ভূমিকা চির স্মরণীয়।

আরও পড়ুন-আলমারিতে সঞ্জয় রাইয়ের ভাগনির দেহ

আজাদ হিন্দ বাহিনী বিপাকে ফেলেছিল ব্রিটিশদের। ১৯৪৪ সালে কোহিমা ও ইম্ফলে ব্রিটিশদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ শুরু করে আজাদ হিন্দ ফৌজ। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিকারও অর্জন করেছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজে সাড়ে আট হাজার সেনা নিয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন হয়েছিল জাপানে। এই বাহিনীর প্রতিষ্ঠা ভারতের বিপ্লবী নেতা রাসবিহারী বসু টোকিওতে করেছিলেন।
১৯৪৩-এ ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বোচ্চ সেনাপতি হিসেবে স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার গঠন করেন সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি ছিলেন এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী। আজাদ হিন্দ সরকারের ছিল নিজস্ব ব্যাঙ্কও। এর নাম ছিল আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক। এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৪৩-এ। এই ব্যাঙ্কের ১০ টাকার কয়েন থেকে শুরু করে এক লক্ষ টাকার নোটও ছিল। এক লক্ষ টাকার নোটে ছিল সুভাষচন্দ্র বসুর ছবি। এই সরকারের ছিল নিজস্ব ডাক টিকিট ও তিরঙ্গা পতাকা।
আজাদ হিন্দ সরকার গঠিত হয়েছিল একটি ক্যাবিনেট নিয়ে। এই ক্যাবিনেটের সর্বাধিনায়ক ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি ছিলেন আজাদ হিন্দ সরকারের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং সমর ও পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী।
ক্যাপ্টেন ডাক্তার লক্ষ্মী স্বামীনাথন (পরে বিবাহিত জীবনে লক্ষ্মী সেহগল) ছিলেন নারী সংগঠন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। এই দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের মহিলা ব্রিগেড রানি ঝাঁসি রেজিমেন্ট কম্যান্ডের দায়িত্বেও ছিলেন। এশিয়ায় এই ধরনের নারীবাহিনী ছিল সর্বপ্রথম এবং এক সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। ডাঃ লক্ষ্মী ছিলেন সিঙ্গাপুরের এক বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। পরে তিনি তাঁর লোভনীয় কর্মজীবন ত্যাগ করে আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

আরও পড়ুন-দীপাবলির রাতে মেট্রোয় উঠে পড়ল কুকুর! প্রশ্নের মুখে নিরাপত্তা

অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকারের মন্ত্রিসভার অন্যান্য জনপ্রশাসন মন্ত্রীরা হলেন—
এস এ আইয়ার – সম্প্রচার ও প্রচারণা মন্ত্রী, লেফট্যানেন্ট কর্নেল এ সি চ্যাটার্জি – অর্থমন্ত্রী
আজাদ হিন্দ সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর মন্ত্রীরা ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিনিধি। এঁরা হলেন—
লেফট্যানেন্ট কর্নেল আজিজ আহমেদ, লেফট্যানেন্ট কর্নেল এন এস ভগত, লেফট্যানেন্ট কর্নেল জে কে ভোঁসলে, লেফট্যানেন্ট কর্নেল গুলজারা সিংহ, লেফট্যানেন্ট কর্নেল এম জেড কিয়ানি, লেফট্যানেন্ট কর্নেল এ ডি লোকনাথন, লেফট্যানেন্ট কর্নেল এহসান কাদির, লেফট্যানেন্ট কর্নেল শাহ নওয়াজ খান।
আজাদ হিন্দ সরকারের সংগঠন ও প্রশাসন পরিচালনার জন্য সুভাষচন্দ্রের একাধিক সচিব ও উপদেষ্টা নিযুক্ত ছিলেন। এঁরা হলেন—
আনন্দমোহন সহায় – সচিব, করিম ঘানি, দেবনাথ দাস, ডি এম খান, এ এল্লাপা, জে থিভি, সর্দার ইসের সিংহ, এ এন সরকার – সরকারের আইনি উপদেষ্টা।
আজাদ হিন্দ সরকারে এই সকল সচিব ও উপদেষ্টাগণ মন্ত্রীর সমমর্যাদা পেতেন। আজাদ হিন্দ সরকারের দৈনন্দিন কাজকর্মের বিবরণী ধারাবাহিকভাবে নথিবদ্ধ করা হয়নি। তাই সুভাষচন্দ্রের সহকারী মন্ত্রিত্বের দায়িত্বভার পালন ছাড়া সরকারি পদাধিকারীরা আর কী কী কাজ করতেন সে-বিষয়ে সঠিক জানা যায় না।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর এই অবদান স্কুলের পাঠ্যবইয়ে থাকা উচিত ছিল। সারা ভারতে। এখনও সেটা নেই। তেমন করে।

Latest article