‘আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে’

বঙ্গদেশে বহুকাল ধরে শিরোনামে উদ্ধৃত প্রবচনটি চালু আছে। এর সার কথা হল, আমাদের সমাজে, আমাদের প্রজাতন্ত্রে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন, যাঁরা উপদেশ দিতে পছন্দ করেন। কিন্তু তাঁদের নিজেদের জীবন বা আচরণে সেই উপদেশ প্রতিফলিত হযেছে কি না— সেই দিকে বিশেষ নজর দেন না। এমন ব্যক্তিরা যখন কাউকে কোনও কিছু শেখাতে চেষ্টা করেন, তখন তা গ্রহণযোগ্যতা পায় না। একজন মানুষ কেবল নিজের চর্চার মধ্য দিযে যদি কোনও কথা বলেন, তা হলেই কেবল সেটা মানুষের কর্ণগোচর হয় ; গুরুত্ব দিযে মানুষ কথাটি ভেবে দেখে। মোদির সাম্প্রতিক রাজনীতির বিপরীতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে ভূমিকা সেই আপ্ত বাক্যটি পুনরায় মনে করিয়ে দিল। লিখছেন শ্রীপর্ণা রায়

Must read

বোঝা গিয়েছিল সেদিনকেই যেদিন মোদিজি রাজধর্ম পালন না করে দলীয় রাজনীতিকে তন্মাত্র জ্ঞান করে বিবৃতি দিয়েছিলেন।
বানভাসি জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারে বিজেপি নেতৃত্বের উপর যে আক্রমণ হয়েছে, এক কথায় তা নিন্দনীয়। এই অবস্থায় বঙ্গ বিজেপির পাল্টা মারের হুমকি কিংবা মহামহিমের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার অভিযোগ তোলার মধ্যে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। এসব রাজনীতিতে হয়েই থাকে।
কিন্তু, ভরা দুর্যোগের মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তৃণমূল কংগ্রেস ও রাজ্য সরকারকে আক্রমণ করলেন তখনই মুখোশ ছিঁড়ে প্রকাশ পেয়েছিল মুখটা। বোঝা গিয়েছিল গেরুয়া গড়ে দলের নেতাদের হেনস্তায় প্রধানমন্ত্রী বুঝেছেন, অতি-বৃষ্টিজনিত ভূমি ধসের চেয়েও উত্তরবঙ্গে দ্রুত সরছে বিজেপির পায়ের তলার মাটি। তাই বিচলিত প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি আক্রমণ।
গেরুয়া পার্টি খুব ভাল করেই জানে, ছাব্বিশের ভোটে দক্ষিণবঙ্গের দু’টি-একটি জেলায় কিছু আসন পেলেও মূল ভরসা উত্তরবঙ্গ। আর সেখানেই যদি নেতারা তাড়া খান, তাহলে ক্ষমতা দখল দূরের কথা, আসন ধরে রাখাই কঠিন।
উত্তরবঙ্গের যে দু’টি এলাকায় বিজেপি নেতৃত্ব লাঞ্ছিত হয়েছে, সেখানকার বিধায়ক এবং সাংসদ তাঁদেরই দলের। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার বিজেপির পক্ষে। তারপরেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে সাংসদ খগেন মুর্মু এবং শিলিগুড়ির বিধায়ক শঙ্কর ঘোষকে উত্তেজিত লোকজন রীতিমতো তাড়া করেছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকায় কোনওরকমে গাড়িতে উঠেছেন তাঁরা।
সেদিন গাড়ির লম্বা কনভয় দেখে বানভাসিরা ভিড় জমিয়ে ছিলেন। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, নেতারা বিপদের সময় পাশে দাঁড়ানোর জন্য ত্রাণ দিতে এসেছেন। কিন্তু ত্রাণসামগ্রী দেখতে না পেয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, খালি হাতে কেন? এখানে ফটো তুলতে এসেছেন?
ক্ষোভের প্রকাশ ভঙ্গি নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে, কিন্তু ক্ষোভের কারণ নিয়ে আপত্তি তোলার জায়গা নেই। সাধারণত কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলে ত্রাণের দাবিতে অবরোধ ও বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। ত্রাণের গাড়ি লুটপাটের নজিরও রয়েছে বিস্তর। এখানেও তেমন একটা ঘটনাই ঘটেছে। বিজেপিকে ঘিরে তাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। তার জন্য বারবার ভোট দিয়ে বিজেপিকে জিতিয়েছে। কিন্তু উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। তা নিয়ে অসন্তোষ ছিল। বন্যার সময় নেতৃত্ব ত্রাণ ছাড়াই এলাকায় যাওয়ায় বিস্ফোরণ ঘটেছে সেই ক্ষোভের।
সোজা কথায় উত্তরবঙ্গের মানুষ গত কয়েকটি নির্বাচনে বিজেপিকে নিরাশ করেনি, কিন্তু আজ যখন মহা দুর্যোগের মধ্যে নিতান্ত অসহায় অবস্থায় তারা, তখন সেই কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি তাদের নিরাশ করে দিতে সম্পূর্ণ সফল। দুর্যোগের পর না তাদের তরফে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য পাওয়ার কোনও চেষ্টা দেখা গেল, না পাওয়া গেল তাদের বারোজন সাংসদ অথবা ষাট পঁয়ষট্টির দোলাচলে থাকা বিধায়কদের তরফে কোনও ব্যক্তিগত আর্থিক সাহায্য!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কার্নিভালে উপস্থিতি নিয়ে বিজেপি ফায়দা তোলার চেষ্টা করেছিল। বুমেরাং হয়ে ফিরছে সেটা। উল্টে সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় উঠে এসেছে পুলওয়ামায় জঙ্গিহানার দিন ডিসকভারি চ্যানেলের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও শ্যুটের প্রসঙ্গ। উঠে এসেছে পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হানার পর সেখানে না গিয়ে বিহারে নির্বাচনী প্রচারে যাওয়ার কথাও।
নাগরাকাটার ঘটনার পর সুকান্ত মজুমদার পাল্টা মারের নিদান দিয়েছিলেন। কিন্তু, সেটা বাংলায় না হয়ে হল ত্রিপুরায়। তার কারণ পাল্টা মার দেওয়ার মতো সাংগঠনিক শক্তি বঙ্গ-বিজেপির নেই। এই পটভূমিকায় মিঠুন চক্রবর্তীকে ডায়লগ লেখার দায়িত্ব দিলে তিনি হয়তো লিখতেন, ‘মার খাব বাংলায়, মারব ত্রিপুরায়।’
সে যাই হোক, শেষ অবধি যা দেখা গেল এবং যাচ্ছে সেটা হল উত্তরবঙ্গের দুর্গত মানুষের পাশে রয়েছেন শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল সরকার এবং সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সমগ্র তৃণমূল কংগ্রেস পরিবার।
দলীয় সাংসদ আক্রান্ত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী উদ্বিগ্ন হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তিনি ঘটনার নিন্দা করবেন, সেটাও প্রত্যাশিত। কিন্তু বাংলার দুর্গতদের সাহায্যের জন্য তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন না কেন? সবচেয়ে বড় কথা, প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন পরিস্থিতি কঠিন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জেরে যখন হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে, মানুষ কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে, তখন তাদের পাশে দাঁড়ানো, আর্থিক সাহায্য করা কি প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না?
উল্টো দিকের ছবিটা দেখেও যদি শিক্ষা নেন তবে ভাল হয়।
উত্তরবঙ্গের দুর্গত(relief fund) মানুষের জন্য অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ব্যক্তিগতভাবে এক লক্ষ টাকা সাহায্য করে এক অনবদ্য মানবিক নজির সৃষ্টি করেছেন। বিজেপির মতো বিরোধীরা যখন উত্তরবঙ্গের বন্যাকবলিত মানুষের পাশ থেকে সরে সামাজিক বিভেদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে রাজনৈতিক লাভ লোকসানের হিসেব কষতে ব্যাস্ত তখন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজগুণে প্রমাণ করে দিলেন প্রকৃত জননেতার আসল সংজ্ঞা। সেবাশ্রয় যাঁর ধ্যানজ্ঞান তাঁর মানবিক মুখ আজ সর্বজনবিদিত। তিনি যে রাজনীতির সঙ্গে সবকিছুকে গুলিয়ে ফেলেন না, তিনি যে কখনও মানবিকতাকে রাজনীতির লাভ লোকসানের হিসেব খাতায় চড়িয়ে অঙ্ক কষেন না, তার সর্বোত্তম নজির হল তাঁর এই সাম্প্রতিক মহানুভবতা। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আজ তাই বাংলার মাটি ছাড়িয়ে সারা ভারতবর্ষের বুকে এক উজ্জ্বল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যুব আইকন।
বাংলার মাটিতে একদিকে আজ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি সাম্প্রদায়িকতা ও বিভাজনের রাজনীতিতে ব্যস্ত। লক্ষ্য তাদের ছাব্বিশে বাংলার ক্ষমতা দখল আর বিপরীতে অক্লান্ত সর্বাধিনায়িকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তার সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীরব মানবসেবা, আর্তের আত্মীয় হওয়ার সর্বতোপ্রকার প্রচেষ্টা। বাংলার মানুষ খাঁটি সোনা চিনতে ভুল করে না সেটা তারা একুশে ও চব্বিশের নির্বাচনে প্রমাণ করে দিয়েছে, আগামীতেও বারবার তা প্রমাণ করে দেবে। বিজেপির ওয়াশিং মেশিনে গায়ে লেগে থাকা দুর্নীতির কালি মুছে ফেলা কোনও উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব নয়, বাংলার সাধারণ মানুষের একান্ত আপনজন, তাদের সেবাশ্রয়ের স্রষ্টা, তাদের সুখ-দুঃখের সাথী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি তাদের আস্থা ও ভালবাসা চির-অটুট থাকবে— এই দেওয়াল লিখন আজ আরও স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে প্রতিদিন।

আরও পড়ুন-বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে হাজির কৃষি দফতর

Latest article