গরু কিংবা ষাঁড়ের মতো দেখতে, তবে ওটা কিন্তু এশিয়ার বৃহত্তম প্রজাতির হরিণ বিশেষ; পরিচয়ে নীলগাই, ওই সবুজ মাঠে ঘুরে বেড়ায়। এ যেন সুকুমার রায়ের সেই হাঁস ও সজারু মিলে হাঁসজারু এবং বক ও কচ্ছপ মিলে বকচ্ছপের অনুরূপ সংস্করণ!
প্রাণী-রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত মেরুদণ্ডী পর্বের স্তন্যপায়ী শ্রেণির বহুসংখ্যক পাকস্থলী বিশিষ্ট সমতল পায়ের পাতাযুক্ত ক্ষুর সমন্বিত জাবর কাটানো তৃণভোজী ‘আর্টিওডাক্টাইল’ ক্রমের ও ‘বোভিডে’ পরিবারের অধীনস্থ ‘বোসেলাফা’ গণের একমাত্র প্রজাতি এই নীলগাই। আক্ষরিক অর্থে নীলগরু হলেও এটি আসলে একটি হরিণ।
আরও পড়ুন-রাজ্য শাসন করতে চাইছে আদালত! ওবিসি মামলায় সওয়াল রাজ্যের আইনজীবীর
১৭৪৫ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক জেমস পারসন্স-এর দ্য ফিলোসফিক্যাল ট্রান্জাকসন্স অব দ্য রয়েল সোসাইটির ৪৩তম গ্রন্থে একটি পুরুষ নীলগাই-এর বর্ণনা অনুসারে ১৭৬৬ সালে প্রাসিয়ার প্রাণিবিদ ও প্রাকৃতিক ইতিহাসকার পিটার সাইমন পালাস সর্বপ্রথম নীলগাই-এর পরিচয় সাধারণের কাছে তুলে ধরেন। ১৮৮৩ সালে সর্বপ্রথম এই নির্দিষ্ট প্রজাতিটির বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘বোসেলাফাস ট্র্যাগোক্যামেলাস’ রাখেন ইংরেজ প্রাণিবিদ ফিলিপ স্ক্ল্যাটার। লাতিন শব্দ ‘বোস’ যার অর্থ গরু বা ষাঁড় এবং গ্রিক শব্দ ‘এলাফস’ যার অর্থ হরিণ, একত্রে মিলে হয়েছে বোসেলাফাস। আবার গ্রিক শব্দ ‘ট্র্যাগোস’ যার অর্থ পুং-ছাগল এবং ‘ক্যামেলস’ যার অর্থ উট, একত্রে মিলে হয়েছে ট্র্যাগোক্যামেলাস। এই দীর্ঘকায় হরিণটি দেখতে কখনও গরু, কখনও ষাঁড়, আবার কখনও উটের মতো!
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শে অন্তর্ভুক্ত ফ্যাশন ডিজাইন কোর্সও, প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উত্তরে
তবে বোসেলাফাস ট্র্যাগোক্যামেলাস বা নীলগাইকে অঞ্চলভেদে অনেকেই নানা নামে পরিচিতি দিয়েছেন। ১৭৭৭ সালে জার্মান প্রকৃতিবিদ জোহান ক্রিশ্চিয়ান পলিকার্প এরক্সলেবেন নাম দেন এন্টিলোপ অ্যালবাইপস। ১৮১৬ সালে ফরাসি প্রাণিবিদ হেনরি মেরি ডাক্রোটে ডে ব্লেইনভিলি বোসেলাফাস পিক্টা বলে চিহ্নিত করেন এবং ১৮২৮ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক জোশুয়া ব্রুকার্স নাম দেন ডি পিক্টা। ১৮৩৮ সালে এই প্রজাতিটিকে আইরিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম ওগলিবাই নামকরণ করেন ট্র্যাগেলাফাস হিপ্পেলাফাস ও ১৮৪৬ সালে সুইডেনের বিজ্ঞানী কার্ল জেকব সানডেভ্যাল পরিচয় দেন পি ট্র্যাগেলাফাস নামে।
মানুষের মতোই দিনের বেলায় কর্মব্যস্ত থাকে এই নীলগাই, সমীক্ষায় দেখা গেছে এরা প্রায় ভোরের দিকে, দুপুরে ও সন্ধ্যাবেলায় খাদ্যগ্রহণ করে এবং রাতে ঘুমাতে যায়। পুং-নীলগাইদের গায়ের রং সচরাচর নীল-ধূসর এবং স্ত্রী-নীলগাই ও যুবক নীলগাইদের গায়ের রং কমলা-বাদামী হয়ে থাকে। এদের দেহ লম্বায় প্রায় ৫.৭-৬.১১ ফুট এবং কাঁধের কাছে উচ্চতা প্রায় ৩.৩-৪.৯ ফুট হয়ে থাকে। পুং-নীলগাই ১০৯-২৮৮ কেজি দৈহিক ওজন, স্ত্রী-নীলগাই ১০০-২১৩ কেজির চেয়ে বেশি হয়। পাতলা পা বিশিষ্ট, ঢালু পিঠের গভীর ঘাড় বেয়ে গলা পর্যন্ত সাদা-সাদা ছোপযুক্ত লোমশ ঝুঁটি দেখা যায়। মুখমণ্ডল, কান, গাল, ঠোঁট, থুতনি ও জঙ্ঘা দেশে প্রায় দুটি করে সাদা রঙের ছোপ দেখতে পাওয়া যায়। কান লম্বায় প্রায় ৫.৯-৭.১ ইঞ্চি হয় এবং শুধুমাত্র পুং-নীলগাইদের একমাত্র শিং থাকে, প্রায় ৫.৯-৯.৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের। এদের দাঁতের সংকেত হল ০.০.৩.৩/৩.১.৩.৩।
আরও পড়ুন-মরণফাঁদ ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক, ক্ষোভ
নীলগাই সাধারণত পূর্ব আফ্রিকা, মধ্য-পুর্ব ও কেন্দ্রীয় এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের খুব সামান্য অংশ জুড়ে বসবাস করে। ভারতবর্ষ, নেপাল ও পাকিস্তানে এরা সর্বাধিক দর্শনীয়। বর্তমানে ভারতবর্ষের বহু জাতীয় উদ্যান মিলে প্রায় দশ লক্ষেরও বেশি নীলগাই দেখা যায়। এই নীলগাই সাধারণত প্রায় ১০ বছর বেঁচে থাকে। তবে দু-বছরের মধ্যেই স্ত্রী-নীলগাইরা পূর্ণযৌনগুণ লাভ করে এবং পুং-নীলগাইদের ক্ষেত্রে প্রায় ৪-৫ বছর সময় লাগে। এদের মধ্যে যৌনদ্বিরূপতা বিদ্যমান। যৌনমিলনের সময়কালে ২-৩ মাস বাদে বাকি সময় এরা আলাদাভাবেই বসবাস করে। সাধারণত দল বেঁধে থাকতে পছন্দ করে। এদের মধ্যে তিন ধরনের দল বেশি লক্ষণীয়— ১-২টি স্ত্রী-নীলগাই ও বাচ্চা সহযোগে একটি দল, কিংবা বাচ্চা ও ৩-৬টি প্রাপ্তবয়স্ক নীলগাই এবং পূর্ণযৌনগুণসম্পন্ন স্ত্রী-নীলগাই-সহ একটি দল, কিংবা ২-১৮টি পুং-নীলগাই মিলে একটি দল। এরা কোনওরকম বিপদসংকেত পেলে প্রায় ৯৮০-২৩০০ ফুট দূরত্ব পর্যন্ত লাফ দিতে দিতে পালাতে পারে।
নেপাল, পাকিস্তান ও উত্তর ভারতের উপমহাদেশের তরাই এবং হিমালয়ের পাদদেশে তৃণভূমি, সবুজ সমভূমি ও গুল্ম জাতীয় অরণ্যে বসবাস করে এই তৃণভোজী নীলগাই-এর দল। ক্রান্তীয় সবুজ অরণ্যের কাষ্ঠল উদ্ভিদ খেয়েও এরা জীবনধারণ করে। মনে করা হয় ভারতবর্ষে সেই ১৫০০-৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বৈদিক যুগ ও নব্য-প্রস্তর যুগের সেই প্রাচীন সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলেও এদের দেখা মিলত। ১৯২০-১৯৩০ সাল নাগাদ আমেরিকার টেক্সাস প্রদেশের একটি ছোট্ট এলাকায় নীলগাই-এর হদিশ পাওয়া গিয়েছিল। ২০০৮ সালে ওই এলাকায় এদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৭ হাজার; তবে দুর্ভাগ্য ২০১১ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে সংখ্যাটি কমে ৩০ হাজারে নেমে এসেছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে জানা যায় ১৬-১৭ শতকের মুঘল আমলে এদের শিকার করা হত। ১৮৮২ সালে এদের নাম নীলগাই হিসেবে নামাঙ্কিত হয়। মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময় নীলগাই-এর নাম নীলঘড় করা হয়; ঘড় বলতে ঘোড়া বোঝায়।
আরও পড়ুন-রাজ্যসভায় কেন্দ্রকে হুঁশিয়ারি ডেরেক ও’ব্রায়েনের
পশ্চিমবঙ্গের পাণ্ডুরাজার ঢিবি-তে এদের চিত্র খোদাই করে রাখা আছে, হিন্দুশাস্ত্র ঐত্রেয়ী ব্রাহ্মণ গ্রন্থে এদের পবিত্র পশুরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে নীলগাই একপ্রকার নিরীহ জন্তু হলেও ওরা খাদ্যের সন্ধানে কৃষিজমির ওপর হামলা করে, তাই অনেকেই এদেরকে শস্যাদির ক্ষতিকারক প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করে। ভারতবর্ষের বিহার, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যের চাষীরা সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন নীলগাইদের নিধনের জন্য। তবে এরা ভারতবর্ষের বন্যজীবন প্রতিরক্ষা আইন, ১৯৭২-এর অধীন রক্ষণশীল। বর্তমান সময়ের বিশ্বায়নের নামে যেসব স্বার্থান্বেষী অনাচার চলছে, তার ফলে ঘটে যাওয়া জীববৈচিত্রের ভাঙন, প্রাকৃতিক বাসস্থানের বিপর্যয়, দূষণ প্রভৃতি কারণে এদের আজ সমূহ বিপদ। অন্যান্য হরিণের তুলনায় এদের মাংস সুস্বাদু এবং হালকা সুগন্ধীযুক্ত হওয়ায় চোরা শিকারিদের কবলেও পড়তে হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্স-এর লাল তথ্য পুস্তিকায় নীলগাই-এর অস্তিত্ব ন্যূনতম উদ্বিগ্ন হিসেবে পরিগণিত; তাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত সকল প্রাণের খেয়াল রাখা।