রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি নাটক,
‘রাজা রানী’। সেখানে একটি সংলাপ। ‘জঠরাগ্নির বাড়া তো আর অগ্নি নাই।’
সেই জঠরাগ্নির দহনে এখন পুড়ছে আমার দেশ। খিদের জ্বালায় জ্বলছে ভারত।
দ্য হাঙ্গার ওয়াচ সার্ভে-২-এর রিপোর্ট সামনে এসেছে। ডিসেম্বর ২০২১— জানুয়ারি ২০২২ কালপর্ব সংঘটিত সমীক্ষার প্রতিবেদন। আর তাতেই স্পষ্টতর একটাই বিষয়। খিদের ভূগোল ক্রমশ বাড়ছে আমার দেশে।
গত মে মাসের গোড়ার দিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শিখর ছুঁয়েছিল। তখনই, অতিমারির সেই কালান্তক প্রহরে সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৪১ শতাংশ মানুষ জানাচ্ছেন, বেড়েছে তাঁদের খাদ্য-বিষয়ক নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তার প্রসৃতির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা। খাদ্যশস্য লাভের সুবিধাভোগী যাঁরা তাঁদের ৯০ শতাংশ মানছেন, তাঁরা খাদ্যশস্য পেয়েছেন, কিন্তু এঁদেরই ৪১ শতাংশের দাবি, অতিমারির প্রহরে তাঁদের খাবারের পুষ্টিগুণ মারাত্মকভাবে কমেছে। ৩৪ শতাংশ পরিবার জানিয়েছেন তাঁরা ডাল জাতীয় যে খাবার পান তা পর্যাপ্ত। আর ৫০ শতাংশ পরিবার মাসে বড়জোর দু-তিনবার ডিম, দুধ, মাংস ও ফল খাওয়ার সুযোগ পান বলে জানিয়েছেন।
দেশের ১৪টি রাজ্যের ৬,৬৯৭ জন মানুষের মধ্যে এই সমীক্ষাটি চালানো হয়েছিল।
এঁদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ ব্যক্তি জানিয়েছেন, অতিমারিপর্বে তাঁদের আয় কমেছে। এর মধ্যে আবার ৬০ শতাংশ ব্যক্তির কাছ থেকে জানা গিয়েছে, তাঁদের আয় প্রাক্-অতিমারি পর্বের তুলনায় অর্ধেকেরও কম হয়ে গিয়েছে। প্রায় ৪৫ শতাংশ পরিবার ভুগছেন দেনার দায়ে। এঁদের মধ্যে ২ শতাংশের ঋণভার ৫০ হাজার টাকারও বেশি।
৬,৬৯৭ জনের মধ্যে মাত্র ২,২৭৭ জন, অর্থাৎ ৩৪ শতাংশ জানাচ্ছেন ডিসেম্বর, ২০২১-এর পূর্ববর্তী মাসগুলোতে তাঁরা পর্যাপ্ত পরিমাণে ডাল বা দানাশস্য জাতীয় খাবার খাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। আর ৩,৩৪৮ জন বলেছেন, তাঁরা মাসে খুব বেশি হলে দু-তিনবার মাংস, ডিম, দুধ বা ফল খাওয়ার সুযোগ পান। এগুলো তাঁরা বলছেন কোন ভারতের বুকে দাঁড়িয়ে? যে ভারতের মহামান্য মোদি সরকার বুক বাজিয়ে দাবি করে চলেছেন, অতিমারিপর্বে খাদ্য সহয়তার ক্ষেত্রে দুর্দান্ত পদক্ষেপ করেছিলেন তাঁরা। মানুষের খিদে মেটাতে তাঁরা বৈপ্লবিক সাফল্য অর্জন করেছেন। অথচ, সমীক্ষার ফল বলছে, প্রথম ঢেউয়ের সময় যেরকম চরম ব্যর্থতার নজির রেখেছিল মোদি সরকার তার চেয়ে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় সামান্য উন্নতি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু অতিমারি আছড়ে পড়ার আগে ছবিটা যেরকম ছিল তেমনটা ফিরিয়ে আনা যায়নি। সে-কাজে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্র।
হাঙ্গার ওয়াচ-১-এর সমীক্ষার সময়টা হল ২০২০-র অক্টোবর-ডিসেম্বর। তখন দেখা গিয়েছিল ৭১ শতাংশ মানুষ মাসে একবারের জন্যও পুষ্টিকর খাবার পায়নি।
আয়ের ক্ষেত্রে অধোগতির চিত্রটাও মারাত্মক। ৬ শতাংশ মানুষ এখনও বেকার। প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় ৭ হাজার টাকারও কম। মাত্র ৫ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় ১৫ হাজার টাকা বা তার বেশি। প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ যেখানে জানাচ্ছেন তাঁদের আয় করোনার ঠেলায় অর্ধেকের নিচে এসে ঠেকেছে, সেখানে ২৬ শতাংশ মানুষ বলছেন, তাঁদের বর্তমান আয় আগের চেয়ে অর্ধেক ও তিন-চতুর্থাংশের মাঝামাঝি। ৬৭ শতাংশ মানুষের ঘরে রান্নার গ্যাস নেই। ১৮ শতাংশ পরিবারে অন্তত একটি স্কুলছুট শিশু আছে। পড়াশোনার খরচ আর পরিবার টানতে পারছে না বলেই এই দশা। ৬ শতাংশ মানুষ জানাচ্ছেন, তাঁদের বাড়ির একজন বাচ্চা, যার বয়স ১৪ বছরেরও কম, তাকে খেতের কাজে বা অন্য কোথাও কাজে পাঠাতে হয়েছে পরিবারের আয় বৃদ্ধির তাগিদে।
আরও পড়ুন: ভারতের সাহায্য চেয়ে বার্তা দিলেন ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত
এ-সব থেকে একটা কথা পরিষ্কার। জুমলার সরকার মুখে যা-ই বলুক না কেন, বাস্তবের ছবিটা একেবারে অন্যরকম। অতিমারির মারণগ্রাস থেকে মানুষকে বাঁচাতে মোদি সরকার যা যা করার দরকার সেগুলোর কোনওটাই আন্তরিকভাবে করেনি।
এই সমীক্ষা-প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর পাটনার এ এন সিনহা ইনস্টিটিউটের ভূতপূর্ব ডিরেক্টর সুনীল রায়, দিল্লি আইআইটি-র ঋতিকা খেরা প্রমুখ অর্থনীতিবিদের বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বা সম্প্রচারিত হয়েছে। এঁদের কথায় সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে কতিপয় দাবি।
১. গণবণ্টন ব্যবস্থার আশু উন্নতিসাধন আবশ্যক।
২. দানাশস্য থেকে ভোজ্যতেল— সবকিছু রেশন দোকানের মাধ্যমে বণ্টনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. এমজি নরেগা-খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
৪. পরিবারপিছু অন্তত ২০০ দিনের কাজ সুনিশ্চিত করতে হবে।
করতে তো হবে। কিন্তু শুনছেটা কে আর করবেই বা কে? বিভাজনের তাস খেলে ভোট লুঠ করতে ব্যস্ত যাঁরা রাজ্যে-রাজ্যে, সেই মোদি-যোগীদের এ-সব নিয়ে ভাবার সময় কোথায়?
রামায়ণে বাল্মীকি লিখে গিয়েছেন—
সর্বে ক্ষয়ান্তা নিচয়াঃ পতনান্তাঃ সমুচ্ছ্রয়া।
সংযোগী বিপ্রয়োগান্তা মরণান্তং তু জীবিতম।
অর্থাৎ, উন্নতির শেষে পতন আর জীবনের অন্তে মৃত্যু নিশ্চিত।
কিন্তু মোদি-জমানায় উন্নতি তো দেখাই গেল না। পতনের অভিঘাত টের পেলাম নিরন্তর। জীবন ভোগের আগেই মৃত্যু মহড়া দিচ্ছে এখন ‘অচ্ছে দিন’-এর আকাশে।