তারকার ছড়াছড়ি ছিল ‘মেরা নাম জোকার’ ছবিতে। রাজ কাপুর তো ছিলেনই, পাশাপাশি ছিলেন সিমি গারেওয়াল, মনোজ কুমার, রাজেন্দ্র কুমার, ধর্মেন্দ্র, দারা সিং, ঋষি কাপুর প্রমুখ। এতজনের ভিড়ে দর্শকদের নজরে পড়েছিলেন পদ্মিনী। সুন্দরী এই অভিনেত্রী অভিনয় করেছিলেন মিনু মাস্টারের চরিত্রে। প্রথমে মনে হয়েছিল বাচ্চা ছেলে, ঘটনাক্রমে জানা যায় তিনি নাকি একজন যুবতী! নাম মিনা। একটা সময় রাস্তায় জীবন কাটানো মিনা ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেন সহজ সরল রাজুকে। এই রাজুর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রাজ কাপুর। তিনিই ছবির পরিচালক।
আরও পড়ুন-প্রতিবন্ধীদের পাশে তৃণমূল কংগ্রেস
১৯৭০-এ মুক্তি পাওয়া ‘মেরা নাম জোকার’ ছবিটা সেই সময় বাণিজ্যিকভাবে সাফল্য পায়নি। তবে পরবর্তী সময়ে টেলিভিশনের দৌলতে বহু মানুষ দেখেছেন। উচ্চপ্রশংসিত হয়েছে পদ্মিনীর অভিনয়। ছবিটা তাঁকে দিয়েছিল সর্বভারতীয় খ্যাতি। যদিও তার আগে তিনি অভিনয় করেছেন অসংখ্য ছবিতে।
জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীর জন্ম তিরুবনন্তপুরমে। অভিনয় জীবন শুরু হিন্দি ছবির হাত ধরে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে। ছবির নাম ‘কল্পনা’। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪৮ সালে। তাঁকে দেখা গিয়েছিল একজন নৃত্যশিল্পীর ভূমিকায়। তারপর থেকে তিনটি দশক চুটিয়ে অভিনয় করেছেন। হিন্দির পাশাপাশি তামিল, মালায়ালাম, তেলুগু ছবিতে। রুশ ভাষার ছবিতেও অভিনয় করেছেন। তবে তামিল ভাষার ছবিতেই তিনি অভিনয় করেছেন সবথেকে বেশি। ১৯৫০ সালে মুক্তি পেয়েছিল তাঁর প্রথম তামিল ছবি ‘এজাই পদুম পদু’। শুরুতেই দর্শকদের চমকে দেন। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
আরও পড়ুন-বাল্যবিবাহ রোধে স্কুলে স্কুলে হবে কর্মশালা
বাংলায় যেমন ছিল উত্তম-সুচিত্রা জুটি, দক্ষিণে তেমন ছিল পদ্মিনী এবং শিবাজি গণেশনের জুটি। একসঙ্গে তাঁরা অভিনয় করেছেন প্রায় ৫৯টি ছবিতে। প্রায় প্রত্যেকটাই সুপারহিট। দর্শকদের মধ্যে ছিল এই জুটির দারুণ চাহিদা। শিবাজি গণেশন ছাড়াও পদ্মিনী বিভিন্ন সময় এম জি রামচন্দ্রন, এন টি রাসত্যায়ন, প্রেমনাজির, রাজকুমার, জেমিনি গণেশন, এস এস রাজেন্দ্রণের মতো বিখ্যাত অভিনেতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন।
বলিউডে তাঁর পছন্দের অভিনেতা ছিলেন রাজ কাপুর। ‘মেরা নাম জোকার’ ছাড়াও রাজ কাপুর-পদ্মিনীর জুটিকে দেখা গেছে ‘জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায়’, এবং ‘আশিক’ ছবিতে। হিন্দিতে তাঁর অন্যান্য বাণিজ্য সফল ছবিগুলো হল ‘পায়েল’ (১৯৫৭), ‘অমর দীপ’ (১৯৫৮), ‘আফসানা’ (১৯৬৬), ‘ভাসনা’ (১৯৬৮), ‘চন্দ অর বিজলী’ (১৯৬৯), ‘মহাভারত’ (১৯৯৫)।
আরও পড়ুন-রেণু-কাণ্ডে গ্রেফতার আরও ১
বিভিন্ন ভাষায় ২৫০-র বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন পদ্মিনী। তবে অভিনয় নয়, নাচ ছিল তাঁর প্রথম প্রেম।
তিনি এবং তাঁর বোনেরা ভারতনাট্যমের তালিম নিখেছিলেন তিরুভিদাইমারুদুর মহালিঙ্গম পিল্লাইয়ের কাছে। ভারতীয় নৃত্যশিল্পী ও গুরু গোপীনাথের কাছে নিয়েছিলেন কথাকলির তালিম। তিন বোন বিভিন্ন মঞ্চে আলো ঝলমলে আসরে নিজেদের মেলে ধরেছিলেন। সুনজরে পড়েছিলেন বহু গুণিজনের।
তিরুবনন্তপুরমে একটি আসরে পদ্মিনী পারিজাত পুষ্পপাহাড়নাম পরিবেশন করেন। সেই আসরে তাঁর প্রতিভার পরিচয় পান বিখ্যাত প্রয়োজক এন এস কৃষ্ণন। পদ্মিনীর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আগামীদিনে এই কন্যে বিখ্যাত অভিনেত্রী হবে।’ মৌখিক প্রশংসাতেই থেমে থাকেননি কৃষ্ণন, পদ্মিনীকে নিজের প্রযোজিত ‘মনমগল’ ছবিতে নায়িকা করেছিলেন।
পদ্মিনী ছিলেন বৈজন্তীমালার সমসাময়িক। দুজনেই সফল নৃত্যশিল্পী এবং সুঅভিনেত্রী। আজীবন তাঁদের মধ্যে সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতা বজায় ছিল। একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। ‘ভানজিকোটাই ভালিবান’ নামক তামিল ছবিতে তাঁরা একসঙ্গে ‘কান্নুম কান্নাম কালান্থু’ গানের তালে নাচ করেছিলেন। সুরকার ছিলেন পি লীলা এবং জিকি। দুই নৃত্যশিল্পীর সৌজন্যে গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
আরও পড়ুন-ললিতা থেকে লালেশ্বরী
শিল্পী জীবনে পদ্মিনী যতটা সফল, ততটাই সফল সংসার জীবনে। ১৯৬১ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন আমেরিকার ডাক্তার রামচন্দ্রনের সঙ্গে। সেইসময় কিছুদিন বিনোদন জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন পদ্মিনী। উড়ে যান আমেরিকায়। সেখানেই জন্ম হয় তাঁদের পুত্র প্রেম রামচন্দ্রনের। ১৯৭৭ সালে নিউ জার্সিতে পদ্মিনী একটি শাস্ত্রীয়নৃত্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন পদ্মিনী স্কুল অফ ফাইন আর্টস। স্কুলটি আজও বর্তমান।
জীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছেন পদ্মিনী। ১৯৫৭ সালে মস্কো যুব উৎসবে পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পী পদক, ১৯৫৮ সালে পেয়েছেন তামিলনাড়ু রাজ্য সরকারের কালৈমামণি পুরস্কার, ১৯৬০ সালে আফ্রো-এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভালে ভীরাপাণ্ডে কাট্টাবোম্মান ছবির জন্য সার্টিফিকেট অব মেরিট, একই বছর ‘জিস দেশ মে গঙ্গা বহতী হ্যায়’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, ১৯৬৬ সালে ‘কাজল’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, ২০০০ সালে চলচ্চিত্রের জন্য তামিলনাড়ু রাজ্য কালৈবনার পুরস্কার ইত্যাদি।
২০০৬-এর ২৪ সেপ্টেম্বর ৭৪ বছর বয়সে চেন্নাইয়ে প্রয়াত হন এই অভিনেত্রী। তবে শিল্পীর মৃত্যু হয় না। আগামিকাল, ১২ জুন পদ্মিনীর ৯০তম জন্মদিন। তাঁকে স্মরণ করবেন অগণিত ভক্ত। কেউ দেখবেন তাঁর অভিনীত ছবি, কেউ কেউ মেতে উঠবেন আলোচনায়। এইভাবেই ধূপের ধোঁয়ার মতো ধীরে ধীরে তিনি পৌঁছে যাবেন পরের প্রজন্মের কাছে।