একটি বাস্তব চিত্র
কাচেমোড়া অফিসটা খুব সুন্দর করে সাজানো। যেরকমটা কোনও ভাল কর্পোরেট অফিস হয়। সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশনড্। তাই বাইরে যখন জ্বালা-পোড়া গরম তখনও অফিসের ভিতরে হালকা চাদর গায়ে দিয়ে থাকতে হয় মৌমিতাদের। পাঁচবছর আগে যখন কাজে যোগ দিয়েছিল, প্রথমদিন অফিসে এসে রীতিমতো তাক লেগে গেছিল তার। বাড়ি ফিরে সাড়ম্বরে গল্পও করেছিল। এমন একটা জায়গায় চাকরি করে বলে মনে মনে একটু গর্বও ছিল তার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য সেই প্রাথমিক মুগ্ধতা কেটে গেছে অনেকদিন।
নিজের কিউবিক্যালের বাইরে এসে কফি মেশিন থেকে একটা কফি নিল মৌমিতা। চিনি মেশানো আছে তবু যেন একটা বিষম তিতকুটে ভাব। আসলে মেজাজটাই ভয়ঙ্কর তিতকুটে হয়ে আছে তার। একটু আগে বাৎসরিক পাওনা-গণ্ডার মেইল এসেছে। প্রতিবছরই আসে। সারা বছরের কাজের ভিত্তিতে কার প্রোমোশন হবে, কার কত মাইনে বাড়বে সেই সংক্রান্ত একটা চিঠি মানে আজকের পরিভাষায় মেইল পাঠানো হয় সব কর্মচারীকে। স্বাভাবিকভাবেই চাকরি যারা করছে তাদের অধীর আগ্রহ থাকে এই চিঠি ঘিরে। কম করে দশ থেকে বারো ঘণ্টা পরিশ্রম। ছুটির দিনেও বাড়িতে ভিডিও কল। বিশেষ করে মৌমিতার মতো যারা পদমর্যাদার সিঁড়িতে খানিকটা উঠে গেছে তাদের তো এককথায় বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টাই হুজুরে হাজির থাকার অবস্থা। এবার গোটা বছর ধরে এই যে প্রাণপণ লড়াইয়ের পর হাতে কী এল, সেজন্য আগ্রহ তো থাকবেই। সবার মতো মৌমিতাও তাই খুব উৎসাহ নিয়েই মেইলটা খুলেছিল। কিন্তু তার পরেই তার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়েছে। মেইলে স্পষ্ট ভাযায় লেখা আছে, তার পারফরম্যান্স খুবই খারাপ। সেজন্য এবছর তার কোনও প্রোমোশন তো হবেই না। এমনকী প্রতি বছর মাইনে বাড়ার যে একটা গল্প আছে, সেটাও তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। মানে আগামী একবছর কোনও মাইনে বাড়বে না মৌমিতা সেনের।
আরও পড়ুন-পরিসংখ্যান কোথায়? মঙ্গলবার ফের কমিশনে তৃণমূল
মেইলটা পড়ার পর থেকেই মাথায় যেন আগুন জ্বলছে মৌমিতার। একে তো নিশ্চিতভাবে একটা আর্থিক ক্ষতি। কিন্তু তার থেকেও যেটা বড়, সেটা হল সম্মানহানি। এই চিঠির অর্থ হল সারাবছর মৌমিতা কোনও কাজ করেনি। সে একজন অপদার্থ কর্মী। কর্পোরেট হাউসে একবছর প্রোমোশন না হওয়া মানে সবার চোখে ছোট হয়ে যাওয়া। অফিসের বেয়ারাগুলো পর্যন্ত তাদের দিকে তাচ্ছিল্যের চোখে তাকায়। কিন্তু কেন এটা হবে? এর আগে কখনও এরকম হয়নি। চিঠিতে কোনও কারণ লেখা নেই। তাকে যে টার্গেট দেওয়া হয়েছিল, সবই ঠিকঠাক পূরণ হয়েছে। তারপরেও কেন এরকম হল সেটা তো জানা দরকার। প্রশ্নটা তার বস নীলেশকে সরাসরিই করবে বলে ঠিক করে নিয়েছে মৌমিতা। মেসেজ পাঠিয়ে রেখেছে। ডাকলেই হাজির হবে তার চেম্বারে।
অপেক্ষা অবশ্য বেশিক্ষণ করতে হল না। একটু পরেই ডাক পড়ল মৌমিতার। ভুরুতে ভাঁজ ফেলে নীলেশ জিজ্ঞাসা করলেন,
কী ব্যাপার মৌমিতা? হঠাৎ এত আর্জেন্টলি অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়ে মেসেজ!
স্যরি স্যার। আসলে আমি আজ মেইলটা পেয়ে খুবই অবাক হয়েছি। আমাকে নন পারফর্মার বলে মেইলে উল্লেখ করা হয়েছে।
হ্যাঁ। তাতে আপনি অবাক হচ্ছেন কেন?
অবাক তো হবই স্যার। কারণ আমি তো আমার টার্গেট অ্যাচিভ করেছি। আমার কাজ নিয়ে কোনও ধরনের কমপ্লেইনও হয়নি…..
আপনি কোন টার্গেট অ্যাচিভ করেছেন মিসেস সেন?
কেন, জুলাই আর সেপ্টেম্বরের টার্গেট আমার কমপ্লিট হয়েছে।
নিশ্চয়ই। কিন্তু জানুয়ারি থেকে জুন?
নীলেশের কথায় রীতিমতো বিস্মিত হয় মৌমিতা।
জানুয়ারি থেকে জুন তো আমি ছুটিতে ছিলাম স্যার।
হ্যাঁ, তার মানে জানুয়ারি থেকে জুনের টার্গেট আপনি করেননি।
আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। আমি তো মেটারনিটি লিভে ছিলাম স্যার। সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য ছয়মাসের ছুটি আমার প্রাপ্য। কোম্পানির নিয়মেই প্রাপ্য। সেই ছয়মাসই আমি নিয়েছি। একদিনও বেশি নয়।
আমি তো বলিনি আপনি বেশি নিয়েছেন। কিন্তু আপনি ছয়মাস ছুটি নিয়ে বাড়িতে থাকবেন। আবার আশা করবেন আপনাকে ভাল পার্ফর্মার বলে চিহ্নিত করা হবে, আপনার মাইনে বাড়বে, প্রোমোশন হবে… এটা তো আর হতে পারে না।
স্যার আমি তো কোনও আনন্দ ফুর্তি করতে কিংবা ব্যক্তিগত কাজে ছুটি নিইনি। এটা আমার মাতৃত্বকালীন ছুটি। এই ছুটি না নিলে আমি সন্তানের জন্ম দেব কীভাবে?
মিসেস সেন, আপনাকে তো কেউ সন্তানের জন্ম দিতে বারণ করেনি। আপনি সন্তানের জন্ম দেবেন কি দেবেন না সেটা আপনার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনি মা হবেন ঠিক করেছেন এবং ছুটি চেয়েছেন। কোম্পানির নিয়ম মেনে আপনাকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আপনার যে সহকর্মী গোটা বছরই কোম্পানির জন্য প্রাণ দিয়ে খাটল, তার সঙ্গে তো আপনার পার্থক্য থাকবে। ছেলেরা মাতৃত্বকালীন ছুটি পায় না। পিতৃত্বের জন্য ছুটি তো কেউ চায়ও না। আপনার মহিলা সহকর্মীরা যারা বেচারিরা মা হয়নি বা কেরিয়ারের জন্য হতে চাইছে না, তাদের প্রাপ্য তো আমাকে দিতে হবে।
কিন্তু স্যার তাহলে তো এখানে চাকরি করে কারও পক্ষে সন্তানের কথা ভাবাই সম্ভব নয়।
দেখুন মিসেস সেন, আমি আপনাকে আগেই বলেছি, এগুলো আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে আমাকে তো কোম্পানির স্বার্থ দেখতেই হবে। এমনিতেই মহিলা কর্মীদের জন্য কোম্পানিকে বেশ খানিকটা বাড়তি চাপ নিতে হয়। এরকমভাবে টানা ছয়মাস একজনকে স্টাফকে সবেতন ছুটি দেওয়া তো কোম্পানির লস। তাছাড়া তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা, বেশি রাত হলে বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা, এরকম নানা ঝামেলাও থাকেই। এসবেরই কিন্তু একটা অর্থমূল্য আছে মিসেস সেন। কিন্তু তারপরেও আমাদের কোম্পনি যেহেতু একদম হাই লেভেলের কর্পোরেট তাই মেয়েদের এই ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। তবে এরপর আপনি যদি আবার প্রোমোশন-ইনক্রিমেন্টের আশা করতে থাকেন, তাহলে তো আমি নাচার।
তার মানে মা হয়েছি বলে আমাকে এই শাস্তিটা ভোগ করতে হবে?
শাস্তি হবে কেন! চাকরি তো আপনার যায়নি, রয়েছে। আমরা সেটা কনসিডার করি। সামনের বছর ভাল করে পরিশ্রম করুন। নিশ্চয়ই পুরস্কার পাবেন। তবে ছোট বাচ্চার দেখাশোনা, শরীর খারাপ এসবের জন্য ঘনঘন ছুটি নিলে কিন্তু বছরশেষে পরিস্থিতি একই জায়গায় এসে দাঁড়াবে।
নীলেশ মিত্রের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিজের কিউবিক্যালে বসে মৌমিতা। মাথা ঝিমঝিম করছে তার।
দিদি, আপনার গিফট্……
অফিসের বেয়ারা বরুণ এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে একটা বেশ বড়সড় রঙিন কাগজে মোড়া প্যাকেট। অবাক হয়ে যায় মৌমিতা।
গিফট্…..গিফট্ কিসের?
আরও পড়ুন-নারীদিবসে রাজ্যজুড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মসূচি
বরুণ কিছু বলার আগেই পাশের কিউবিক্যাল থেকে মুখ বাড়ায় রঙ্গন,
আরে বুঝতে পারলি না, তোদের স্পেশাল গিফট্। যেটা তোরা ফোকটে প্রতিবছর কোম্পানি থেকে পাস। আজ তো ৮ মার্চ, ওম্যানস্ ডে। মেয়েদের জন্য তাই দামি উপহার এসেছে। শুনলাম নাকি ছুটির পর খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। মিউজিক চালিয়ে নাচতেও পারবি । ভাল আছিস কিন্তু তোরা। বছরে ছয়মাস ছুটি, নারীদিবসে উপহার…এরপরেও তোরা আবার সমান অধিকারের কথা বলিস।
রঙ্গন আর বরুণের বাঁকা হাসির সামনে উপহারের প্যাকেটটা নিয়ে চোয়াল শক্ত করে বসে থাকে মৌমিতা।