শুধু আর্থিক বরাদ্দের খতিয়ান নয় মানবসম্পদের সমৃদ্ধিকরণের পথচিত্র

সামাজিক প্রকল্পে বিপুল ব্যয়বহন করতে গিয়ে পরিকাঠামো উন্নয়নেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। প্রমাণ করল, রাজস্ব শৃঙ্খলার মধ্যেই পরিকাঠামো উন্নয়নের ধারাকে রেখে সামাজিক উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন সম্ভব। লিখছেন অর্থনীতিবিদ ড. দেবনারায়ণ সরকার

Must read

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, ‍‘মানবিক উন্নয়ন ব্যতিরেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অস্থায়ী ও অনৈতিক।’ তৃণমূল সরকারের ২০২৫-২৬ (WB Budget 2025-26) অর্থবছরের রাজ্য বাজেটে এটাই সত্য প্রমাণিত হল।
প্রথমে সমৃদ্ধির নির্ধারণগুলিতে আসা যাক। রাজস্ব শৃঙ্খলা সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। প্রথমে এই বাজেটে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের যে প্রকৃত হিসাব দাখিল করা হল তাতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য এসেছে মূলধনী ব্যয়ের ক্ষেত্রে। অতীতের কয়েকটি বছরের হিসাবে দেখা যাচ্ছে ২০২১-’২২ ও ২০২২-’২৩ অর্থবছরে রাজ্যে প্রকৃত মূলধনী ব্যয় ছিল যথাক্রমে ১৭৫০০ কোটি টাকা ও ২১৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮৯৬৩ কোটি টাকা। এই অর্থ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের রাজ্যের জিএসডিসি’র ১.৭%। এই অনুপাত শিল্পোন্নত রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ু থেকেও পশ্চিমবঙ্গে বেশি। এমনকী মহারাষ্ট্রের মতো শিল্পোন্নত রাজ্যে এই অনুপাত সংশোধিত বাজেটে ধরা হয়েছিল ১.৭%। অন্যান্য রাজ্যগুলির মতো পাঞ্জাব, কেরালা ও হরিয়ানায় এই অনুপাত পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে কম। এখানে যেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হল পশ্চিমবঙ্গ সরকার সামাজিক প্রকল্পে বিপুল ব্যয় বহন করতে গিয়ে পরিকাঠামো উন্নয়নেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে বামফ্রন্টের শেষ বছরে (২০১০-১১) এই অনুপাত ছিল মাত্র ০.৫ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি, রাজকোষ ঘাটতি ও ঋণ যা ধরা হয়েছিল তার থেকে কিছুটা কমেছে।

এবারে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের প্রসঙ্গে আসা যাক। এটা সর্বজনবিদিত যে রাজ্যের রাজস্ব আয়ের ৪টি খাত রয়েছে— নিজস্ব কর রাজস্ব, নিজস্ব কর নিরপেক্ষ রাজস্ব, কেন্দ্রের নিকট হতে রাজ্যের করের অংশ এবং কেন্দ্রীয় অনুদান। তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে ২০২২-২৩ সালের চেয়ে ২০২৩-২৪ সালে রাজ্যের নিজস্ব কর রাজস্ব ৯৬০৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত বেড়েছে। বৃদ্ধির হার প্রায় ১০.৫%. প্রথম তিনটি ক্ষেত্রে রাজস্ব আয় অতিরিক্ত বেড়েছে প্রায় ১০.৫। প্রথম তিনটি ক্ষেত্রে রাজস্ব আয় অতিরিক্ত বেড়েছে প্রায় একুশ হাজার কোটি টাকা (বৃদ্ধির হার ১৩.৪%)। কিন্তু চতুর্থ ক্ষেত্র অর্থাৎ কেন্দ্রীয় অনুদান ২০২২-২৩ অর্থ বছরের তুলনায় ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি কমেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, যে কোনও রাজ্যেই হোক না কেন পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় পরবর্তী বছরে কেন্দ্রীয় অনুদান (যা মূলত রাজ্যেরই করের অংশ অর্থাৎ মাছের তেলে মাছ ভাজা) অবশ্যই বাড়ে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে দেখা গেল ২০২২-২৩ সালে এই অনুদান ছিল ৩৮,৩০৩ কোটি টাকা, ২০২৩-২৪-এ কমে দাঁড়াল মাত্র ২২,০৭২ কোটি টাকা। কেন এই প্রসঙ্গ তুললাম?
কেন্দ্রীয় অনুদান ২০২২-২৩ সালের তুলনায় ২০২৩-২৪ সালে ১৬ হাজার কমার দরুণ রাজ্যের মোট রাজস্ব আয় অতিরিক্ত বাড়ল পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো। বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশের কম। কার্যত, কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে হাতে না মেরে ভাতে মারার চেষ্টা করছে।

এবার আসা যাক ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত হিসাবের ক্ষেত্রে। এ বছরে রাজ্যের মোট রাজস্ব আয়ে বৃদ্ধির অনুপাত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ধরা হয়েছে ১৩.৫%। অতিরিক্ত আয় ধরা হয়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। কার্যত, কেন্দ্রের অনুদান কমলেই (অবশ্যই কমবে) এই বৃদ্ধি আরও কমবে। কার্যত পশ্চিমবঙ্গ নিজের আর্থিক ক্ষমতা দিয়েই এই বিরাট কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে জিএসডিপি-র অনুপাতে রাজস্ব ঘাটতি, রাজকোষ ঘাটতি ও ঋণ কিছুটা বেড়েছে।

আরও পড়ুন- ঠিক সময়ে যুদ্ধবিমান সরবরাহ করছে না হিন্দুস্থান অ্যারোনেটিক্স

এবার ২০২৫-২৬ সালের বাজেটে আসা যাক। ২০২৫-২৬ সালের বাজেটে (WB Budget 2025-26) রাজ্যের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩,৭৪,১৯১ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৪২,৩৪৭ কোটি টাকা বেশি। বৃদ্ধির হার ১২.৭৬%। রাজ্যের মোট রাজস্ব আয় ২০২৫-২৬ সালে ধরা হয়েছে ২,৬৬,০৬০ কোটি টাকা। আয় বৃদ্ধি ধরা হয়েছে প্রায় ১৭%। কেন্দ্রীয় অনুদান কমলেও দশ শতাংশের বেশি আয় বাড়বে এটা অবশ্যই আশা করা যায়। রাজ্যের রাজস্ব ঘাটতি ধরা হয়েছে জিএসডিসি-র ২ শতাংশের কম এবং রাজকোষ ঘাটতি ধরা হয়েছে প্রায় ৩.৫ শতাংশ। কার্যত রাজস্ব শৃঙ্খলা মেনেই রাজ্যকে ব্যয়ের খতিয়ানকে ঠিক করতেই হচ্ছে।

এবার ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রকল্প ভিত্তিক ব্যয়-বরাদ্দের প্রসঙ্গে আসা যাক। সবচেয়ে বেশি ব্যয় বেড়েছে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন ক্ষেত্রে। ২০২৪-২৫-এর তুলনায় বৃদ্ধির হার ৪৯% (প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত বেড়েছে)। এরপর গুরুত্ব পেয়েছে মহিলা, শিশু ও সামাজিক উন্নয়ন ক্ষেত্রে। ২৬,৫৯০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮,৭৬২ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ৪৮%।

অমর্ত্য সেন লিখেছিলেন, ‍‘ভবিষ্যৎ তৈরিতে আমরা যা চাই তার চাবিকাঠি হল মহিলাদের ক্ষমতায়ন’। মহিলা, শিশু ও সামাজিক উন্নয়ন খাতে প্রায় ৫০% বৃদ্ধি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গিই প্রমাণ করে।
স্কুল শিক্ষাক্ষেত্রে অতিরিক্ত বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। ছিল ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এবার বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার প্রায় ৮ শতাংশ। স্বাস্থ ও পরিবার কল্যাণ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির হার ৭.৫%। ২০২৪-২৫ সালে ছিল ১৯৮৫১ কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ সালে (WB Budget 2025-26) এই অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ২১৩৫৫ কোটি টাকা। এখানে উল্লেখ্য যে কেন্দ্রের ২০২৫-২৬ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে যেখানে দেশের জিডিপি-র ২ শতাংশেরও কম। পশ্চিমবঙ্গে এই অনুপাত প্রায় ৬ শতাংশ। মহিলা, শিশু ও সামাজিক উন্নয়নে কেন্দ্র যেখানে ব্যয় ধরেছে ১.২ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গের অনুপাত প্রায় ৯ শতাংশ। কেন্দ্রের শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় ধরা হয়েছে ২.৫ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে এই অনুপাত প্রায় ১৪ শতাংশ।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সামাজিক ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মোট ব্যয় রাজ্যের মোট ব্যয় বরাদ্দের ৫২.২ শতাংশ। সারা ভারতে এই ব্যয় সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় ছত্তিশগড় (৫০.৫%)। রাজ্যের জিএসডিপি-র অনুপাতে এই ব্যয় প্রায় ১০%। বামফ্রন্টের শেষ বছরে এই অনুপাত ছিল ৬.৪%।
কার্যত এই বাজেটে পশ্চিমবঙ্গ প্রমাণ করল যে, রাজস্ব শৃঙ্খলার মধ্যেই পরিকাঠামো উন্নয়নের ধারাকে রেখে সামাজিক উন্নয়নের বিরাট কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন সম্ভব।

Latest article