মহানগর নয়, চারুলতাই মানিককাকুর সেরা ছবি : জয়া বচ্চন

সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে বড়পর্দায় আবির্ভাব জয়া বচ্চনের। তখন তিনি ভাদুড়ী। অভিনয়ের কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। তবু প্রথম ছবিতেই ছিলেন সাবলীল। তারপর অসংখ্য ছবি। সাফল্য। বাংলায়, মুম্বইয়ে। ইন্ডাস্ট্রিতে পরিচিতি ছিল জেদি ও ঠোঁটকাটা হিসেবে। সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন। প্রথম ছবি ‘মহানগর’-এর ষাট বছর উদযাপন উপলক্ষে। তাঁকে দেখা যেতে পারে নতুন বাংলা ছবিতে। তৈরি হয়েছে সম্ভাবনা। জানালেন বিশ্বজিৎ দাস

Must read

বাবু ডাকলে আমি না করতে পারি না
কলকাতার ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে শ্যুটিং চলছে। অনিল-মাধবীর শট সবে শেষ হয়েছে। মানিকবাবু (সত্যজিৎ রায়) ঠিক করলেন এবার বাণীর শট নেওয়া হবে। শুধু অডিওটা নেওয়া হবে। অনিল-মাধবীর দৃশ্যে ব্যাকগ্রাউন্ডে ওটা ব্যবহার করা হবে। পিছনের ঘরে বাণী পড়ছে। পাশের ঘরে বাণীকে নিয়ে গেলেন। পড়তে বললেন। পড়তে পড়তে বাণী ‘ঘোঁওত ঘৎ’ করে অদ্ভুত একটা শব্দ করলেন। মানিকবাবু শ্যুটিং থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন— এটা কী করলে? বাণী উত্তর দিল— কেন পড়ার সময়ে কি মুখে মশা ঢুকতে পারে না! ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে এক চিলতে হাসি বিদ্যুতের মতো খেলে গেল। সেই ষাট বছর আগের বাণী আজকের জয়া বচ্চন। সত্যজিৎ-এর ‘মহানগর’ কলকাতায় আরও একবার নিয়ে এলেন বাবু (সন্দীপ রায়)। উপলক্ষ ‘মহানগর’-এর ষাট যাপন।

আরও পড়ুন-হোমস্টে মার্ডারস

‘‘বাবু ডাকলে আমি না করতে পারি না’’— জয়ার এই অকপট স্বীকারোক্তির পরে সন্দীপ রায় ভাবতে শুরু করলেন তাঁকে নিয়ে নতুন ছবির কথা।
সেই মেয়েটিকে পেয়ে গেছি মানিকদা
মানিকবাবু কী করে খুঁজে পেলেন জয়াকে! এ-প্রশ্নের কৌতূহল নিজেই মেটালেন জয়া— আমার বাবা তরুণ ভাদুড়ী ও আমি একবার পুরী বেড়াতে গেছিলাম। তখন ওখানে তপনবাবু শ্যুটিং করছিলেন ‘নির্জন সৈকতে’ ছবির। ওখানে আলাপ হয় রিঙ্কুদি (শর্মিলা ঠাকুর) আর রবিকাকুর (রবি ঘোষ) সঙ্গে। ওই আলাপের পরেই নাকি রবিকাকু রিঙ্কুদি দু’জন মিলে মানিককাকুকে বলেন যে— ‘the girl for that role was found at last’ শুনে মানিককাকু আমাকে ডেকে পাঠান। আলাপ হয়। কিছু ঘরোয়া প্রশ্ন করেন। তবে কী ভেবে আমাকে নিয়ে নিলেন তা আমি আজও বুঝতে পারি না।

আরও পড়ুন-ভগ্নপ্রায় রাজবাড়িতে বায়োপার্ক, কটেজ গড়বে প্রশাসন

অভিনয়ের সময় তুমি চশমাটা অবশ্যই পরবে
‘মহানগর’-এর আগে কনভেন্ট-ছাত্রী জয়ার অভিনয়ের কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। কখনও মঞ্চেও কাজ করেননি। তবু প্রথম ছবির অভিনয়ে তিনি ছিলেন সাবলীল। মনেই করতেন না কোনও ছবিতে কাজ করছেন। জীবনে প্রথম শটের কথা বলতে গিয়ে তাই চোখ ছলছল করে ওঠে— অনিলকাকু খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আমি টেবিলে বসে লিখছি। সেটা ছিল আমার প্রথম শট। আর আমি তখন চশমা পরতাম। মানিকদা নিশ্চয়ই সেটা লক্ষ্য করেছিলেন। তাই বললেন— ‘‘অভিনয়ের সময় তুমি চশমাটা অবশ্যই পরবে’’। ওইভাবে শটটা নিলেন। ডায়ালগ বিশেষ ছিল না। ছবিতে কাজ করেছি এটা আমার মনেই হয়নি। ‘মহানগর’ সম্পর্কে যেখানে যত ছবি ছাপা হয়েছে তাতে ওই শট বারবার দেখা যায়।

আরও পড়ুন-ইডেন মাতিয়ে অকপট যশস্বী, মালিঙ্গাকে খেলতে পারলে ভাল লাগত

ঋতু সত্যজিতের দ্বারা অনুপ্রাণিত
মহানগরের পরে বাংলা ছবিতে কম কাজ করেছেন জয়া। খুব সিলেকটিভ ছিলেন। তবে মুম্বইয়ে অনেক বাঙালি পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। বিশেষত যাঁদের বেঙ্গলি সেন্সিবিলিটি আছে। শেষ ঋতুর (ঋতুপর্ণ ঘোষ) একটা ছবিতে কাজ করেছেন ইংরেজি এবং হিন্দিতে। ছবিটা রিলিজ হয়নি। জয়া বিশ্বাস করেন— ঋতু সত্যজিতের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। ও স্ক্রিন-প্লে এবং ডায়ালগ লিখত ব্যতিক্রমী।
জয়া অকপট স্বীকার করলেন— খুব ভাল বাংলা বলতে তিনি পারেন না তবে খুব খারাপও বলেন না। বাড়িতে কেউ বাংলা বলেন না, শুধু অমিতজি ছাড়া। তবে অমিতজিও খুব বাজে বাংলা বলেন।

আরও পড়ুন-৩৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি গেলে পর্ষদ নীরব থাকবে না, নিয়ম মেনেই নিয়োগ, রায় চ্যালেঞ্জ কোর্টে

শেখায় তো। ডোমেস্টিক সায়েন্স শেখায়।
মহানগর একটি মেয়ের লড়াইয়ের ছবি। পুরুষ ইগো সামলানোর ছবি। পরিবারের সকলকে সামলানোর ছবি। এখানে স্টিরিও টাইপ নায়িকার কনসেপ্ট ভেঙে দিয়েছেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়। জয়াও মনে করেন— মহানগর আধুনিক ছবি। নারীর ক্ষমতায়নের ছবি। এত পড়াশুনা করে কী হবে! স্কুলে যাওয়ার দরকারই বা কী? এর উত্তরে বীণা তাই বলে— ‘‘শেখায় তো। ডোমেস্টিক সায়েন্স শেখায়।’’ সেদিনের মহানগরের ছবি আজ অনেকটাই বদলেছে। কিন্তু গ্রামের ছবিটা এখনও বদলায়নি। বদলে যাওয়া শহুরে জীবনযাত্রায় অর্থের প্রয়োজন বেড়েছে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই উপার্জন করতে হয়। মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই আত্মসম্মান নিয়ে আসে।
ফিল্ম ইনস্টিটিউটে তোমার অবশ্যই যাওয়া দরকার; ওইটাই তোমার জায়গা
সত্যজিতের সঙ্গে জয়ার চিঠি লেখার সম্পর্ক ছিল। জয়া বলছেন— ‘‘আমি খুব ঘনঘন চিঠি লিখতাম। আর মানিককাকু খুব প্রম্পট তার জবাব দিতেন। মানিককাকুর সঙ্গে আর একটা ছবি করার কথা ছিল। কিন্তু সে-সময় আমি ছিলাম পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে। সেজন্যে ওই ছবিটা আর করা হয়নি।’’

আরও পড়ুন-সুপ্রিম-নির্দেশ মেনে পথদুর্ঘটনায় রাজ্যের ৭ দফা গাইডলাইন, আহতের উদ্ধারকারীকে হয়রানি নয়

তবে পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়তে যাওয়ার পিছনেও সত্যজিতের অবদান ছিল। ‘পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে যেতে চাই’ জানিয়ে মানিককাকুকে চিঠি লিখেছিলেন জয়া। আবদার করেছিলেন একটা রেকমেন্ডেশন লেটারের জন্য। মানিককাকু সঙ্গে সঙ্গে লিখেছিলেন— ‘ফিল্ম ইনস্টিটিউটে তোমার অবশ্যই যাওয়া দরকার। ওইটাই তোমার জায়গা।’ এখনও যত্নে আগলে রেখেছেন সেই চিঠি।
‘ম্যায়নে আপকো দেখা-তো মুঝে লাগা আগর ইয়ে কর সাকতা হ্যায় তো— হোয়াই কান্ট আই ডু?’
অনেকেই বলেন জয়া বচ্চনকে দেখেই নাকি শাবানা আজমি ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়তে গেছিলেন। জয়াকে দেখার পর শাবানা তাঁকে সামনেই বলেছেন— ম্যায়নে আপকো দেখা-তো মুঝে লাগা আগর ইয়ে কর সাকতা হ্যায় তো— হোয়াই কান্ট আই ডু? তবে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ নিয়ে মানিককাকুর কাছে একটা অভিমানের প্রশ্ন জয়ার আজও আছে— He didn’t think about me…Why?

আরও পড়ুন-পথ দুর্ঘটনায় আহতের উদ্ধারকীরকে হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করতে উদ্যোগী রাজ্য

সবাই তোমার প্রশংসা করে করে তোমার মাথাটা খেয়েছে
নাগরিকের লাজুক জয়ার দস্যিপনা দেখেছি আমরা ‘দস্যি মেয়ে’-তে। হৃষীকেশ মুখার্জি একবার কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন এই জয়াকে। কী ছিল সেই শাস্তি? সেই ঘটনা ঘটেছিল ‘মিলি’ ছবির শ্যুটিংয়ে। হৃষীকেশ মুখার্জি রি-টেক পছন্দ করতেন না। আর যদি রি-টেক করতে হয় তাহলে সেটি তিনিই ভাববেন যে, করবেন কী করবেন না। মিলির একটা সিনে জয়া ভাদুড়ীর মনে হয়েছিল দৃশ্যটা আর একবার রি-টেক করা দরকার। তিনি সেটা হৃষীকেশ মুখার্জিকে বলেছিলেন যে, ‘‘আমার মনে হয় আমি আর একবার টেক দিই’’— এতেই তাঁর ওপর খেপে যান হৃষীকেশ মুখার্জি। তিনি পরিষ্কার বললেন, ‘‘পরিচালক কে? আমি না তুমি? কে ঠিক করবে রি-টেক হবে কি হবে না? তুমি না আমি? আমি যদি ভাল মনে করি রি-টেক করব আর তা না করি তাহলে এটাই থাকবে।’’ তৎকালীন দিনে তো এখনকার দিনের মতো উন্নত প্রযুক্তি ছিল না। তাই তখন সমস্ত সিন দেখে দেখে ডাব করতে হত। শ্যুটিং শেষে যখন ডাবিংয়ের সময় এল তখন হৃষীকেশ মুখার্জি জয়া ভাদুড়ীকে বললেন যে, ‘‘সবাই তোমার প্রশংসা করে করে না তোমার মাথাটা খেয়েছে। তা তুমি তো এখন বড় তারকা। ঠিক আছে তুমি এখন সিন না দেখে ডাব করো। আর পুরোপুরি ১০০ শতাংশ লিপসিং করতে হবে তোমায়, যাও করো।’’ যে-সময় সিন না দেখে ডাব করাই যেত না, সেই সময় জয়া ভাদুড়ীকে পুরো ‘মিলি’ সিনেমাটা সিন না দেখে ডাব করতে হয়েছে এবং শ্যুটিংয়ে যা যেভাবে বলা হয়েছিল সেটা তাঁকে মেলাতে হয়েছে।

আরও পড়ুন-CBSE-র দ্বাদশ শ্রেণির ফল প্রকাশ, পরীক্ষার্থীদের পাশের হার ৮৭.৩৩ শতংশ

আজকে আপনি যেই জায়গায় থেকে এই ধরনের ব্যবহার করছেন একবছর পর এই লোকটি কিন্তু এই জায়গাতেই থাকবে
ইন্ডাস্ট্রিতে বেশ জেদি ও ঠোঁটকাটা ছিলেন জয়া। টপ ফর্মে রাজেশ খান্নার মুখের ওপর কথা বলতে মনে হয় তৎকালীন এই একজন নায়িকাই পেরেছিলেন। ১৯৭২ সালে ‘বাওয়ার্চি’ ছবিটি বেরিয়েছিল হৃষীকেশ মুখার্জির। এই ছবিতে রাজেশ খান্না এবং জয়া ভাদুড়ী ছিলেন। সেই সময় অমিতাভ বচ্চন তো আর অমিতাভ বচ্চন হননি, তখন জয়া ভাদুড়ীর শ্যুটিং থাকলে অমিতাভ বচ্চন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। আর রাজেশ খান্না দেখতে পেলে আপত্তিকর এবং অপমানজনক ব্যবহার করতেন। বাওয়ার্চির শ্যুটিংয়েও অমিতাভ বচ্চন জয়া ভাদুড়ীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন এবং সেরকমই ব্যবহার রাজেশ খান্না করেছিলেন। তখন জয়া ভাদুড়ী তাঁকে মুখের ওপর বলে দেন যে, ‘‘আজকে আপনি যেই জায়গা থেকে এই ধরনের ব্যবহার করছেন, একবছর পর এই লোকটি কিন্তু এই জায়গাতেই থাকবে। এই লোকটিই কিন্তু একদিন শাসন করবে এই সিনেমা জগৎ।’’

আরও পড়ুন-প্রয়াত কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ, শোকজ্ঞাপন মুখ্যমন্ত্রীর

এই কথা মিলে যায় ওই একবছর পর ’৭৩ সালে ‘জঞ্জির’ মুক্তি পাওয়ার পর। তারপর এটা ২০২৩! সবাই জানে ইতিহাসটি কী। রাজেশ খান্নার মুখের ওপর কথা বলে সেটাকে মিলিয়ে দেওয়া এটা জয়া ভাদুড়ী ছাড়া তৎকালীন কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারবেন না।
জয়া ভাদুড়ী ও জয়া বচ্চন দু’জনেই বাঙালির হৃদয়ের চলচ্চিত্রে না-ভোলা চরিত্র হয়েই থাকবেন।

Latest article