ভূতের গল্প নয়

এই কাহিনি আমাদের। আমাদের মানে লেখক এবং প্রকাশকের। দেবকীবাবু কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় খুবই প্রবীণ এবং নামী একজন প্রকাশক।

Must read

জয়ন্ত দে: এই কাহিনি আমাদের। আমাদের মানে লেখক এবং প্রকাশকের। দেবকীবাবু কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় খুবই প্রবীণ এবং নামী একজন প্রকাশক। প্রকাশনা সংস্থারও বেশ নামডাক আছে। সেই সঙ্গে একটু দুর্নামও আছে। সেটা অর্থকরী বিষয়ে। তাতে অবশ্য তাঁর কিছু যায় আসে না। তিনি মাঝে মাঝেই বলেন, গদ্য লেখকরা আসলে ঠিক শিল্পী নয়, লেখকের সঙ্গে শিল্পের তেমন কোনও যোগাযোগ নেই। বরং ওরা হল চাষার জাত। চাষ না করলে ওদের গায়ের ব্যথা মরবে না। এরা গায়ের ব্যথা মারতেই লেখে। সেই ফসল হল লেখা। তোমরা বলো সাহিত্য!

আরও পড়ুন-গর্জন তেল

উনি অবলীলায় এ-কথা বলেন। আমরা শুনি। কেউই খুব একটা প্রতিবাদ করেন না। বলছে— বলে যাক। তবে তার সঙ্গে উনি বলেন, এবার দেখতে হবে, আপনি কী ফলাচ্ছেন। ফসল যেমন, দাম তেমন। ভূতমুড়ি ধানের চাল, আর তুলাপাঞ্জির দাম ভিন্ন হবে। আপনি তুলাইপাঞ্জি ফলালে ভাল দাম পাবেন। ভূতমুড়ি হলে নিজেই খান, গরম খান, পান্তা-পষ্টি খান। মুড়ি ভাজুন। আপনার মাল, আপনার পেটেই সইবে।
আমরা অধম লেখকরা অপেক্ষা করে থাকি, উনি কবে আমাদের ফসলকে তুলাইপাঞ্জির গোত্রে তুলবেন। ইদানীং উনি আমাকে একটু আধটু খাতিরদারি করেন। তুলাপাঞ্জি, বাসমতীর না-হলেও মিনিকিটের দাম দেন। প্রতিবছরই কিছু টাকা-পয়সা দেন। আমিও মাথা পেতে নিই। সেইসঙ্গে আশা দেন হচ্ছে, হচ্ছে, এইবার হবে—।

আরও পড়ুন-হারাধনের স্বপ্নভঙ্গ

মাঝেমাঝে নিভৃতে ভরসাও দেন, লেখক হতে গেলে ধৈর্য লাগে। আপনার সাবান ফ্যাক্টারি নাকি কল টিপবেন আর টপা টপ সাবান পড়বে। আপনি গাছ পুঁতেছেন। সার-জল দিন, আলো-হাওয়া পেলে, ঠিক হবে, হতেই হবে—
সেই প্রকাশক একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। হয়তো আমার মতো আরও কাউকে কাউকে ডেকে পাঠিয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন। এক রৌদ্রমাখা চকচকে দুপুরে উনি আমাকে বললেন— ‘একটা ভূতের গল্পের বই দিন।’
‘ভূত! আপনি তো ভূতের বই করেন না।’
‘না, করি না। তবে এবার করব। আমাকে একটা ভাল দেখে, বেশ গা-ছমছমানো ম্যানস্ক্রিপট দিন।’
আমার জন্য চা আসে। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলি, ‘আমি ভূতের গল্প-উপন্যাস কমই লিখি, আর যা লিখি সাহিত্য মন্দির, দেবুবাবুরা নিয়ে নেন। ওঁরা ভূতের বই করেন।’

আরও পড়ুন-রেড রোডে বিদায় বেলায় আনন্দের সুর

‘এবার আমরা করব। আমাদের এখানে আপনার নেক্সট বইটি হবে ভূতের, কি মনে থাকবে?’
আমি হাসলাম, ‘আপনি হঠাৎ বিশুদ্ধ সাহিত্য ছেড়ে হঠাৎ ভূতের দিকে ঝুঁকলেন কেন।’
উনি একটু গুম মেরে থাকলেন। বললেন, ‘আমার বাবা আগে ভূত-রহস্য প্রচুর করেছেন। কিন্তু হঠাৎ বাধা পড়ে গেল, তাই আর করি না। তবে এবার করব।’
‘ভূতের বইয়ে বাধা মানে?’ আমি ওঁর দিকে একটু এগিয়ে বসলাম।
উনি চাপা গলায় বললেন, ‘চা খান, চা খান, প্রকাশকের ঘরের হাঁড়ির খবর নেবেন না।’
আমি ছাড়ার পাত্র নই, বললাম, ‘বাধা পড়ে তো শুনেছি পাঁঠাবলিতে। পাঁঠাবলিতে বাধা পড়ে অনেক বাড়িতে চালকুমড়ো বলি হয়। আখ বলি হয়। তা আপনার কীভাবে বাধা পড়ল?’

আরও পড়ুন-ঐতিহ্য-শিল্প-সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যের মেলবন্ধনে বিস্মিত বিদেশিরাও, রেড রোডে উৎসবের বিশ্বায়ন

উনি গলা খাঁকারি দিলেন, ‘আপনি এক্কেবারে পাঁঠাবলিতে চলে গেলেন, অনেক পরিবারে ভাইফোঁটা, জামাইষষ্ঠী হয় না। কোনও একসময় বাধা পড়ে বন্ধ হয়ে যায়।’
আমি হাসি। ‘যায়। খোঁজ নিন, নির্ঘাত এটা পরিবারের কোনও কৃপণ সদস্য করিয়েছিল। শুভ অনুষ্ঠানে বাধা পড়লে বন্ধ হওয়া উচিত কি? জীবন তো থেমে থাকে না। সেটা আবার চালু করা উচিত। শুভ, সবসময়ই শুভ।’
উনি হাসেন, ‘আমিও সেটা ভেবেছি। ভূতের বই আবার ছাপব। আর এক্ষেত্রে সব লেখককে অগ্রিম দেব।’
আমি বললাম, ‘সত্যি আপনার কথা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পাচ্ছি না।’
উনি বললেন, ‘খুব সহজ। ভূতের বইয়ের ক্ষেত্রে আমরা সব লেখককে অ্যাডভান্স পেমেন্ট করব। আগে টাকা, পরে লেখা।’

আরও পড়ুন-দীপাবলির আগেই দাম বাড়ল সিএনজি ও পিএনজির

‘অতি উত্তম প্রস্তাব। ঠিক আছে, আমি বাড়ি ফিরে গোছাই, একটা বই আপনাকে মাসখানেকের মধ্যেই রেডি করে দিতে পারব।’
উনি হাসলেন, ‘আপনাকে নিয়ে তিনজন, ফাইনাল হল। আমি তিনটেই করব। তারপর পর ভাবব, আর করা উচিত কি না? আপনি পরের সপ্তাহে আসুন, দশ হাজার টাকার একটা চেক দেব। আর এগ্রিমেন্টটা করিয়ে নেব।’
আমি বললাম, ‘সে ঠিক আছে। কিন্তু ভূতের বইয়ে বাধা পড়ার ঘটনাটা জানা হল না।’
‘থাক না, না-ই বা জানলেন।’
‘হঠাৎ আপনার ভূতের বইয়ের এমন ঝোঁক চাপল কেন?’
উনি ওপর দিকে মুখ তুলে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থাকলেন। আমি বললাম, ‘এখন ভূত-রহস্যের বাজার খুব ভাল। পাবলিক খাচ্ছে—?’
উনি গম্ভীর মুখে বললেন, ‘না।’

আরও পড়ুন-১০ লক্ষ ব্যবহারকারীর লগইন তথ্য ফাঁস হয়েছে, জানাল মেটা

[দুই]
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। পরের সপ্তাহে আমার আর যাওয়া হয়নি। গেলাম দিন পনেরো পরে। এক্কেবারে পনেরোটি গল্পের ফাইল নিয়ে। তার আগের দিন ফোন করেছিলাম। গিয়ে দেখলাম চেক রেডি। দিলেন, দশহাজার। এগ্রিমেন্ট পেপার। টেন পারসেন্ট রয়্যালিটি। আর একটা বই দিলেন।
বললেন, ‘এটা বইটা নিয়ে যান। তিন কপিই ছিল। অমরবাবু, তপনবাবুকে দিয়েছি, এটা আপনার— আপনাদের তিনজনকেই দিলাম। এই ভূতের বইটাই আমাদের শেষ ভূতের বই। আমার বাবা বের করেছিলেন। তারপর. বাধা পড়ে গেল। এবার আমি চেষ্টা করছি সেই বাধা কাটিয়ে আবার ভূতের বই প্রকাশ করতে, দেখা যাক—’
আমি আমার ভূতের গল্প সংকলনের ফাইল দিয়ে, বইটি আর দশহাজার টাকার চেক নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। তারপর বইটির কথা ভুলে গিয়েছিলাম, হঠাৎই একদিন রাতের দিকে ফোন করলেন তপনদা। বললেন, ‘তুমি তো দেবকীবাবুকে ভূতের বই দিয়েছ?’
‘হ্যাঁ দাদা দিয়েছি।’

আরও পড়ুন-রেড রোডে শুরু বিসর্জনের বর্ণাঢ্য মেগা কার্নিভাল

‘চেক পেয়েছ?’
‘হ্যাঁ, পেয়েছি। দশ হাজার।’
‘আর একটা বই পেয়েছ?’
‘হ্যাঁ, ওদের শেষ ছাপা ভূতের বই।’
উনি বললেন, ‘আরে আমাকে যে বইটি দিয়েছেন, তার লেখক জ্যোতির্ময় সেন। আমি জানতাম না, জ্যোতির্ময় সেন কোনও ভূতের লেখা লিখেছেন। আর সেই বই দেবকীবাবুর বাবা ছেপেছেন। জ্যোতির্ময় সেন তো খুব সিরিয়াস সাহিত্য করতেন। আজ এখন খুলে দেখি, পুরো সাদা পাতা, শুধু রক্তের ছিটে ছিটে। ওটা দেখে অমরকে ফোন করলাম। শুনলাম, ওর বইটারও তাই অবস্থা। যা-ই হোক, তুমি তোমার বইটি পড়ে আমাকে একটু পড়িও তো, জ্যোতির্ময় সেনের ভূতের গল্প পড়ার ইচ্ছে রইল—।’
‘ঠিক আছে দাদা, আমি পড়েই আপনাকে পাঠিয়ে দেব।’
বাড়ি ফিরে বইটি তাকেই রেখে দিয়েছিলাম, খুলিনি। আমি তপনদার ফোন ছেড়েই তাড়াতাড়ি বইটি নিয়ে প্যাকেট ছিঁড়ে দেখলাম, হ্যাঁ জ্যোতির্ময় সেন। রোমাঞ্চিত হলাম। ঠিক করলাম, আজ শনিবার। আজ রাতেই বইটি পড়ে ফেলব। আয়েস করে বিছানায় বসে খুললাম, কিন্তু কভারের পর থেকেই পর পর সাদা পাতা, আর মাঝে মাঝেই সাদা পাতায় রক্তের ছিটে লেগে…।

আরও পড়ুন-রাত জেগে সৎকারের তদারকি কাউন্সিলরের

কী রকম একটা অস্বস্তি অনুভব করলাম। আমাদের তিনজনেরই বইয়ের এই অবস্থা! ব্যাপারটা কী? কিন্তু প্রায় রাত এগারোটা এখন কি ফোন করা যায়? জানতে হবে। বুকের ভেতর দম যেন আটকে আসছে? কেন এমন? উনি তো কী একটা বাধার কথা বলেছিলেন। এখন কি ফোন করা যায়? প্রবীণ মানুষ। উচিত হবে? ঠিক আছে দেবকীবাবুর ছেলেকেই ফোন করি। ফোন করতেই উনি বললেন, ‘আরে বাবা জেগে আছে, বই পড়ছে, আপনি বাবার সঙ্গেই কথা বলুন।’
আমি দেবকীবাবুকে সরাসরি বললাম, ‘আচ্ছা তিনটি বইয়ের ভেতরই সাদা পাতা। অক্ষর নেই। লাল লাল রক্তের মতো ছিটে— ব্যাপারটা কী?’
ফোনের ওপারে দেবকীবাবু চুপ করে থাকলেন।
আমি আবার বললাম, ‘আপনি ভূতের বইয়ের কী একটা বাধা পড়ার কথা বলেছিলেন, সেটা কী?’
দেবকীবাবু খুব আস্তে আস্তে বললেন, ‘আসলে জ্যোতির্ময় সেন খুব সিরিয়াস লেখক ছিলেন। কোনওদিনই ওঁর বই সেভাবে বিক্রি হত না। কিন্তু খুবই অভাবী মানুষ ছিলেন। বাবার কাছে এসে মাঝে মাঝেই হাত পাততেন, বাবা ওঁকে দু-চার টাকা দিতেন। সেই সময়, বাবাই ওঁকে বলেন, অনেক তো লিখলেন, একটারও কাটতি নেই। একটা ভূতের লেখা লিখুন, লাক ট্রাই করুন। বাবার কথায় উনি সত্যি সত্যি একটা জমাটি ভূতের লেখা লিখলেন। বইও খুব হিট হল। উনি এসে হাত পাতলেন, দাও টাকা দাও। বাবা খাতা খুলে দেখলেন, আপনার সব বই ছেপে আমি লস করেছি। এটা শোধবোধ হল।’

আরও পড়ুন-উত্তর কোরিয়া গোপনে পরমাণু পরীক্ষার প্রস্তুতি চালাচ্ছে, আশঙ্কা আমেরিকার

কথাটা বলে দেবকীবাবু একটু থামলেন, বললেন, ‘উনি এক টাকাও পেলেন না। তখন ওঁর টিবি। উনি কাশতে কাশতে আমাদের দোকান থেকে ফিরে গেলেন। ক’দিন পর মারাও গেলেন। তারপরেই ঘটল ঘটনাটি। ওঁর ছাপা বই যা গোডাউনে ছিল, তার সব অক্ষর যেন রাতারাতি ভ্যানিস হয়ে গেল। তার বদলে রক্তের ছিটে—।’ দেবকীবাবু হাসলেন, ‘বাদ দিন। কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় এমন তো কতই ঘটে। আমি কিন্তু অ্যাডভান্স দিয়েছি।’
ফোন কেটে গিয়েছিল কখন। আমি চুপ করে বসেছিলাম। কোথাও যেন কাশির আওয়াজ…। এটা কি ভূতের গল্প, নাকি এক অভাবী লেখকের গল্প জানি না। সারারাত জ্যোতির্ময় সেন— এক অভাবী লেখকের পাথর বুকে নিয়ে শুয়ে থাকলাম।
সকালে তপনদা, অমরদাকে কনফারেন্স কলে ধরলাম। দুজনকেই দেবকীবাবুর বাবা এবং এক রোগগ্রস্ত অভাবী লেখক জ্যোতির্ময় সেনের কথা বললাম। সেই সঙ্গে বললাম, আর একটা কথা— ‘আমার কাছে কাল রাতেই একটা মেসেজ এসেছে—।’
অমরদা বললেন, ‘কী, দেবকীবাবুর চেক বাউন্স করেছে।’
আমি হ্যাঁ বলার আগেই তপনদা বললেন, ‘আমার কাছেও এসেছে।’
আমাদের মধ্যে কেউ একজন বললেন,
— অভাবী রোগগ্রস্ত লেখক জ্যোতির্ময় সেন তাঁর প্রতিবাদে আমাদের শামিল হতে বলছেন।

Latest article