কমবেশি ভুলে যান সবাই কিন্তু প্রায়শই ভুলে যাওয়া মোটেও সবসময় কোনও কাজের কথা নয়। এতে শুধু নিজের বিপদ নয়, অন্যদেরও। বিশেষ করে সেই ভুলে যাওয়ার যদি নির্দিষ্ট কোনও লক্ষণ থাকে তাহলে চিকিৎসা জরুরি। যেমন- সাম্প্রতিক ঘটনা, নাম, চেহারা ভুলে যাওয়া, কখনও অল্প সময়ের মধ্যে একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি, একটি জিনিস যে জায়গায় রাখার কথা ছিল সেখানে না রেখে অন্য জায়গায় অর্থাৎ ভুল জায়গায় রাখা, নিজের বাড়ির পথটা ভুলে যাওয়া কিংবা গোটা বাড়িটাই। একে বলে স্মৃতিভ্রংশ, যার যোগসূত্র আমাদের মস্তিষ্ক। ডিমেনশিয়া কমবেশি সবার থাকতে পারে। যাকে বলে স্বাভাবিক ডিমেনশিয়া। তবে তাঁদের মধ্যে অনেকেরই ভ্যাসকুলার ডিমেনশিয়া বা অ্যালঝাইমার্স রোগ থাকে।
যখন মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগ শরীরে ভিটামিনের বা খনিজ উপাদানের অভাব তৈরি করে, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, রক্ত জমাট বাঁধা, রক্ত চলাচল কম হয়। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ও স্ট্রেসফুল জীবনযাপন, হাঁটাচলা, ব্যায়াম ইত্যাদি প্রতিদিনের রুটিনে না থাকা, এর সঙ্গে যদি থাকে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এবং থাইরয়েডের তাহলে একটা সময় ডিমেনশিয়া বা আরও গভীরে গিয়ে অ্যালঝাইমার্স দেখা দেয়। ডিমেনশিয়া একটি বিশেষ ধরনের ক্লিনিক্যাল উপসর্গ। এটি একটি নির্দিষ্ট কোনও রোগ নয়, তবে নানাবিধ রোগের প্রভাব হয়।
আরও পড়ুন-প্রয়াত লিথিয়াম ব্যাটারির আবিষ্কর্তা জন গুডএনাফ
বেড়ে চলেছে অ্যালঝাইমার্স
এই মূহূর্তে অ্যালঝাইমার্স রোগ বিশ্বব্যাপী দ্রুত বেড়ে চলা স্নায়বিক ব্যাধিগুলির মধ্যে একটি। পরিসংখ্যান অনুসারে, শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর এই রোগে ৫০ লক্ষ (৫ মিলিয়ন) আক্রান্ত হন। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ২০৬০ সাল নাগাদ এর বার্ষিক আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়ে যেতে পারে। এই বিষয়গুলি মাথায় রেখে জুন মাস জুড়ে পালিত হয় অ্যালঝাইমার্স অ্যান্ড ব্রেন হেল্থ অ্যাওয়ারনেস মান্থ। বিশেষজ্ঞদের মতে, মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়লেই অ্যালঝাইমার্স রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। অ্যালঝাইমার্স ও অন্যান্য ডিমেনশিয়া নিয়ে আলাপ- আলোচনা চলে। গোটা মাস জুড়ে সারা পৃথিবীতে অ্যালঝাইমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা মানুষকে উৎসাহিত করতে উদ্যোগী হন, প্রতীক স্বরূপ পার্পলরঙা পোশাক পরেন, এই রোগটির বিরুদ্ধে লড়াই করার সচেতনতা বৃদ্ধিতে শামিল হন।
আরও পড়ুন-চিকিৎসকদের পরামর্শ একপ্রকার অগ্রাহ্য করেই বাড়ি ফিরলেন মুখ্যমন্ত্রী
ঈশ্বরের অভিশাপ !
প্রাচীন ইজিপ্টে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের স্মৃতিবিলোপ হতে শুরু করত। যদিও বহুযুগ ধরে এই রোগটি ধরা যায়নি। রোমান সাম্রাজ্যে এই রোগ যখন সবার অজানা তখন রোগটিকে ঈশ্বরের দেওয়া অভিশাপ বলে ধরে নিতেন বয়স্করা। ১৯০৬ সালে অ্যালয়িস অ্যালঝাইমার্স প্রথম একজন পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধার মেমরি লসের বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করলেন। ওটাই পৃথিবীর প্রথম অ্যালঝাইমার্স ডিজিজ হিসেবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
আরও পড়ুন-এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ব্লকে মুখ্যমন্ত্রী, কুশল জানলেন রাজ্যপাল
সহজে দেয় না ধরা
অ্যালঝাইমার্স হলে মানুষ ধীরে ধীরে সবকিছু ভুলতে থাকেন। পাশাপাশি তাঁর সামাজিক কাজকর্ম ও মানসিক সমস্যাও দেখা দিতে শুরু করে। এক্ষেত্রে মাথার ভিতরের অংশ ছোট হতে শুরু করে দেয়। এমনকী এও দেখা গিয়েছে যে অ্যালঝাইমার্স রোগে মাথার কোষেরও মৃত্যু হয়। এটাকে ডিজেনারেটিভ নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারও বলা হয়। তবে মাথায় রাখতে হবে যে এই অসুখের লক্ষণ সহজে দেখা দেয় না। রোগ হওয়ার প্রায় ১০ বছর পর উপসর্গ ফুটে ওঠে। তাই সচেতনতা জরুরি।
আরও পড়ুন-এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ব্লকে মুখ্যমন্ত্রী, কুশল জানলেন রাজ্যপাল
কমে যায় কোষের কর্মক্ষমতা
এই রোগে মস্তিষ্কের কোষের চারপাশে অ্যামলয়েড নামক এক প্রোটিনের প্রাচীর তৈরি হতে থাকে। পাশাপাশি, টাউ নামক প্রোটিনও কোষগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে যায়। এতেই কমতে থাকে কোষগুলোর কর্মক্ষমতা। মানুষের মাথায় প্রায় ১০০ বিলিয়ন নার্ভ সেল রয়েছে। এদের মধ্যে প্রত্যেকের ধরণ আলাদা। এই কোষগুলিই আমাদের স্মৃতি, শিক্ষা থেকে ব্যবহার ইত্যাদি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে। তবে এই কোষগুলো মরে গেলেই সমস্যা তৈরি হয়। মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যাহত হয়। কমে আসতে থাকে মানুষের স্বাভাবিক কগনিটিভ ক্ষমতা। কোনও বিষয়ে চিন্তা করতে হলে যথেষ্ট পরিশ্রম অনুভূত হয়। খুব সহজ অঙ্ক বা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করে না। এছাড়াও উপসর্গ হিসেবে অল্পেই রেগে যাওয়া, বিরক্তি প্রকাশ, মেজাজ হারানো ইত্যাদি দেখা যায়।
আরও পড়ুন-দিল্লি গিয়ে আন্দোলন করে বকেয়া টাকা আদায়, বললেন অভিষেক
মস্তিষ্ক ভাল রাখতে
মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য উন্নত মানেই দূরে থাকবে এই রোগ। সারাদিন বসে বসে কাজ করার ফলে সেই কগনিটিভ সমস্যা দেখা দেয়। এতে স্মৃতিভ্রংশ হতে পারে। তাই কর্মক্ষম থাকুন, হাঁটাচলার মধ্যে থাকুন। ব্যায়াম করুন নিয়মিত।
সারাদিন রাতে ঘুম পর্যাপ্ত পরিমাণে না হলে কাজ করার ক্ষমতা কমে যায়। দীর্ঘদিন ধরে কম ঘুমোলে মস্তিষ্কের কোষে টাউ নামক প্রোটিনটি জমতে শুরু করে। এর ফলে দেখা দিতে থাকে কগনিটিভ সমস্যা।
দিনে ৮ গ্লাস জল নিয়মিত খাওয়া উচিত। আমাদের শরীরে জলের ভাগ ৭০ শতাংশ। দীর্ঘদিন ধরে কম জল খেলে ডিমেনশিয়ার সমস্যা দেখা দেয়।
নিয়মিত ড্রাগ নেওয়া ও মদ্যপানের ফলেও অ্যালঝাইমার্স দেখা দিতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে ড্রাগ ও মদ খেলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে থাকে।
আরও পড়ুন-দুর্যোগের মুখে মুখ্যমন্ত্রীর কপ্টার, সেবক এয়ারবেসে জরুরি অবতরণ
মস্তিষ্ক ভাল রাখার ব্যায়াম
বই পড়া, লেখালেখি, ছবি আঁকা, ছবি তোলা, ডায়েরি লেখা, ছন্দ মেলানো—সবই মস্তিষ্কের জন্য ভাল। খেলার ছলেও মস্তিষ্কের ব্যায়াম হয়। রুবিকস কিউব, সুডোকু, জিগস পাজল, ক্রসওয়ার্ড পাজল, দাবার মতো খেলায় রোজ কিছুটা সময় কাটাতে পারেন। সেলাই বা বুননেও হয় মস্তিষ্কের ব্যায়াম হয়।
স্মৃতিভ্রংশ হবে না
আপনার রোজকার ডায়েট মাথাকে রাখবে সুস্থ। ভুলবেন কম। বেশি পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবার যেমন চিজ, মাখন, রেডমিট বাদ দিন।
বাদাম খান কারণ এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-ই, মোনোস্যাচুরেটেড চর্বি, এবং মিনারেল। যা স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। মস্তিষ্কের কোষের বৃদ্ধি করে।
আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা কুখ্যাত গ্যাংস্টার
ডিমের ভিটামিন স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে এবং এটা স্নায়ুকেও সুস্থ রাখে।
সাইট্রাস ফল যেমন লেবু বা কমলাজাতীয় খাবার মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভাল রাখে।
স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে জিঙ্ক বেশ জরুরি একটি খনিজ উপাদান। মিষ্টি কুমড়ার বীজে রয়েছে প্রচুর জিঙ্ক এবং আরও কিছু উপকারী খনিজ উপাদান। যা মস্তিষ্ক সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
ডার্ক চকোলেটে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও খনিজ। যা স্মৃতিশক্তি তীক্ষ্ণ করে।
চিনি দুধ এবং ক্রিম ছাড়া চা ও কফি আপনাকে সজাগ থাকতে সাহায্য করে, আলঝাইমার্স রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং মস্তিষ্কের দক্ষতার উন্নতি ঘটায়। লাল আটার রুটি, লাল চালের ভাত, ওটস ইত্যাদি মস্তিষ্কের জন্য উপকারী খাবার।